রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

রঙ্গনা আবাসনে এলাম ১৯৯৬ সালে। টপ ফ্লোর। দমদম এলাকাটা ঘিঞ্জি হলেও আমাদের দক্ষিণে একটা ঝিল ছিল। কিছু দিন পর আমার উলটো দিকের ফ্ল্যাটেই এক ভদ্রলোক এলেন। পেতলের নামফলকে চকচক ‘আর ডি বিশ্বাস, ডব্লুবিসিএস’।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০০
Share:

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

Advertisement

রঙ্গনা আবাসনে এলাম ১৯৯৬ সালে। টপ ফ্লোর। দমদম এলাকাটা ঘিঞ্জি হলেও আমাদের দক্ষিণে একটা ঝিল ছিল। কিছু দিন পর আমার উলটো দিকের ফ্ল্যাটেই এক ভদ্রলোক এলেন। পেতলের নামফলকে চকচক ‘আর ডি বিশ্বাস, ডব্লুবিসিএস’। বিরলকেশ লোকটি উচ্চতায় হ্রস্ব, মুখে স্মিত হাস্য। এক দিন নিজেই আমার ফ্ল্যাটে এলেন আলাপ করতে। আমি সোফায় বসতে বললে, উনি মাথা নাড়িয়ে বললেন, ব্যালকনিতে বসি? আমার স্ত্রী ঝোলানো যা-দেখতে-নেই দ্রুত সরিয়ে দিলে, ব্যালকনিতে রাখা মোড়ায় বসি। বাইরের ঝিলে ঝিরঝির জলের দিকে তাকিয়ে উনি বললেন, ‘আমরা দুজন ফ্ল্যাটের মাথায় থাকি/ একই ঝিলের ধারে মোদের বাস/ আমরা দেখি এক কচুরিপানা/ আমরা দেখি এক জোড়া হাঁস।’ সম্ভবত একটা ‘বাহ্’ শোনার বাসনা নিয়ে আমার মুখপানে চেয়ে থাকলে, আমি প্রশংসাসূচক অব্যয়ধ্বনিটি ছাড়ামাত্রই উনি পুনরায়, ‘আমাদের এই ফ্ল্যাটের নাম রঙ্গনা/ আমাদের এই ঝিলের নামটি অঙ্গনা/ আমার নামটি...’ বাক্য শেষ হল না। ওঁর নাম তো আর ডি বিশ্বাস। মিলছে না, তাই বোধ হয় দাঁড়ি পড়ল। আমি বলি, আপনার পুরো নামটা তো জানি না। উনি বললেন, নাম শুনে কাম কী? বলি, পাশাপাশি থাকি, নামটা জেনে রাখা ভাল। উনি বললেন, আমার নামটি বড় অকাব্যিক। লেখালিখির লাইনে আছি, দুটি কাব্যগ্রন্থ আছে, দেবো। সমুদ্র বিশ্বাস নামে লিখি। আবার বলি, আসল নামটা বলতে আপত্তি আছে? উনি মুখ ও স্বর নিচু করে বললেন, রাবণদমন বিশ্বাস। যেন কিছু খারাপ শব্দ বলছেন। তার পর সংযোজন, মানে রাম। বাবা বৈষ্ণব কবি। লক্ষ করবেন, অনুপ্রাস আছে। এই হল প্রথম আলাপ। তার পর জেনেছি ওঁর মা-বাবা দেশে, মানে বর্ধমান জেলার রসুলপুরে থাকেন। এখানে স্ত্রী ও একমাত্র পুত্র। পুত্র ইংলিশ মিডিয়াম, ক্লাস টেন।

আর ডি, তথা সমুদ্র বিশ্বাস সকালে বলতেন, প্রাতঃকালীন অভিনন্দন। সন্ধ্যায় সন্ধ্যাকালীন। এ ভাবে দ্বিপ্রাহরিক, গোধূলিকালীন, বাসন্তিক, নানা রকম।

Advertisement

কিছু দিনের মধ্যেই ফ্ল্যাটের পরিচালন সমিতি তৈরি হল। আর ডি প্রশাসনিক আমলা, তাই প্রেসিডেন্ট। পর দিনই নোটিস বোর্ডে একটা কাব্যিক নির্দেশনামা।

‘সরণীতে কেহ ফেলো না কাগজ কুচো/ পানপরাগেতে দেওয়াল কোরো না রাঙা/ নোংরা দেওয়াল নিজ ব্যাকরণে মুছো/ চাতালে রেখো না মদিরা বোতল ভাঙা।’ এই ভাবে ষোলো লাইন। শেষ দিকে ছিল— ‘ফ্ল্যাটকে ভেবো না বন্দি জীবনে খাঁচা/ নীড় ভেবে নিয়ে নিভৃত পুচ্ছ নাচা।’

আমাকে বললেন, নোটিসটা দেখেছেন? আমি উপলব্ধি করি বাংলা শব্দভাণ্ডারে প্রশংসাসূচক শব্দ বড় কম। বলি, দারুণ। জিজ্ঞাসা করলাম, অফিসে সার্কুলার দিতে হলে কী ভাবে দেন? উনি বলেন, যতট়া পারি বাংলায়, ‌ভিতরে কিন্তু গোপনে কবিতা থাকে। অন্ত্যমিল রাখি না বলে ওরা ভাবে ওগুলো কবিতা না। এ ভাবেই কবিতা যাপন করি আমি।

দেশে ক’দিন থেকে ফিরে এসে শুনলেন, রতন ঘোষ নামে এক আবাসিকের আকস্মিক মৃত্যু হয়েছে। মৃত ব্যক্তিকে ঠাহর না করতে পেরেও শোকবিহ্বল হলেন। একটি শোকসভা আহ্বান করলেন, এবং উনি একটি শোকগাথা পাঠ করবেন জানালেন।

মৃত ব্যক্তিকে না জেনেই শোকগাথা রচনার জন্য একটি ছবি খোঁজ করছিলেন। পাওয়া গেল না। মৃতের স্ত্রী এ সময়ে পিত্রালয়ে। শুনলেন, মৃত মানুষটির হাতিছাপ জামা ছিল। সমস্যার সমাধান হল। মেট্রো স্টেশনের লাইন ঘটিত ঝগড়ায় এই হাতিছাপই তো বলেছিল, ‘লাইনেই তো ছিলাম বাবা।’ শঙ্খ ঘোষের কবিতার লাইন। মানে কবিতা-পাঠক। হাতিছাপকে কল্পনা করে শোকগাথা তৈরি। শুরুটা— ‘জ্যান্ত কবিতা ছিলে ফ্ল্যাটের রতন/ কবিতার মতো হল ছন্দপতন।’ শোকসভা চলাকালীন এক জনের প্রবেশ। গায়ে হাতিছাপ জামা। নতুন প্রোমোটার। আর ডি-র দার্শনিক উপলব্ধি— পৃথিবীতে বহু হাতিছাপ জামা আছে এবং কবিতার বহু লাইন অকবিদের কাছ থেকেই কবিরা গ্রহণ করেন!

আর ডি-র বাবা অসুস্থ, খবর পেয়ে দেশে গেলেন। পর দিনই ফোন পেলাম। ‘বাবা কোমায়। আজই হয়তো বিদায় নেবেন। আমরা দুজন ফ্ল্যাটের মাথায় থাকি, আমরা দুজন সরস্বতীর সেবক। একটা উপকার করুন। আপনার চেনা কবিদের খবর দিন। আমার বাড়িতে আসতে বলুন। যাতায়াত ও সম্মানদক্ষিণা দেব। বাবার মৃত্যুশয্যায় মৃত্যুচেতনা বিষয়ে স্বরচিত কবিতা পাঠ হবে।

অনুরোধ রাখিনি। শুনেছিলাম বহ্নিমান চিতার সামনে দাঁড়িয়ে স্থানীয় কবিরা চিতা না নেভা পর্যন্ত কবিতা পাঠ করে গিয়েছিলেন।

কিছু দিন পর আরও ভাল ও দামি ফ্ল্যাটে চলে যান আর ডি। যোগাযোগ কমে যায়। বছর দুই আগে ওঁর একটা ফোন পাই। বলেন, খুবই অসুস্থ। দয়া করে যেন ওঁর ফ্ল্যাটে যাই। দেখা করলাম। ক্যান্সার। আর ডি তথা সমুদ্র বিশ্বাস একটা মুখবন্ধ খাম দিলেন আমায়। বললেন, মাইকেল মধুসূদনও মৃত্যুর আগে নিজের এপিটাফ লিখে গিয়েছিলেন। চুল্লিতে ঢুকে যাওয়ার আগে যেন পাঠ করা হয়। ছেলের দ্বারা হবে না, ইংলিশ মিডিয়াম। আর যদি আপনিও...

খামটা খোলা হয়নি। উনি লড়াই করছেন এখনও।

swapnoc@rediffmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement