চেঁচাচ্ছিস কেনো, আমি কি কালা?
আমাদের ক্লাসে ইতিহাস পড়াতেন অধীরবাবু। আড়ালে সবাই তাঁকে কালা-অধীর বলত। কারণ, উনি কানে একটু কম শুনতেন। কিন্তু, কিছুতেই তা মানতে চাইতেন না। কেউ একটু চেঁচিয়ে কথা বললেই উনি বলতেন— ‘চেঁচাচ্ছিস কেনো, আমি কি কালা?’ বিয়ে করেননি। ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। পাশের হোটেল থেকে খাবার আসত। বড় হয়ে শুনেছিলাম, বউদির সঙ্গে প্রেমঘটিত কারণে উনি বাড়ি থেকে ত্যাজ্যপুত্র ছিলেন। ওঁর পড়ানো বলতে, মুখস্থ ধরা। কমা-দাঁড়ি-সেমিকোলন সহ। না পারলেই মার ও নানা রকম শাস্তি। কাঁকরে হাঁটু রেখে দাঁড়ানো, হাঁটুর ভেতর হাত গলিয়ে কান ধরে বসা ইত্যাদি। পড়া পারলে উনি কখনও ‘বসো’ বলতেন না। বলতেন, ‘বুসো’।
আমাদের ক্লাসে সবচেয়ে দুষ্টু ছিল রাখহরি। এক দিন সে বলল, ‘দাঁড়া কালা-অধীরকে ঢিট করব।’ সে দিন মুঘল সাম্রাজ্য বিষয়ে পড়া ধরা চলছিল। আমরা কয়েক জন মার খেয়ে কাঁকরে হাঁটু রেখে দাঁড়িয়েছি, কেউ কেউ পড়া পেরে ‘বুসেছে’। এর পর এল রাখ’র পালা।
ও প্রথমেই প্রচণ্ড চেঁচিয়ে শুরু করল, ‘ঔরঙ্গজেবের রাজত্বের শেষের দিকেই মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের....’ আর বলতে হল না। কালা অধীর চেঁচিয়ে উঠল— ‘এত চেঁচাচ্ছিস কেনো, আমি কি কালা?’ এর পর রাখ গলা নামিয়ে ফিসফিসিয়ে যা বলতে শুরু করল যা আমরা কয়েক জন শুনতে পেলেও স্যরের পক্ষে শোনা সম্ভব ছিল না। ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে কালা অধীরের সাক্ষাৎ হয়েছিল, তার সাম্রাজ্য বিস্তৃতির কারণে কালা অধীর তাকে কাঁকরে হাঁটু রেখে দাঁড় করান, ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে কান ধরে ওঠবোস করান ইত্যাদি। ‘সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি’, ‘ধর্মীয় গোঁড়ামি’ এই কথাগুলো ও খুব জোরে বলছিল যাতে স্যর শুনতে পান। আমরা কোনও রকমে মুখ টিপে হাসি চাপছিলাম, কেউ কেউ বেঞ্চের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে হাসছিল। এই ভাবে কিছু ক্ষণ চলার পর ও চেঁচিয়ে ‘এই সব কারণে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন হয়’ বলে বক্তব্য শেষ করল। স্যর কিছু ক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, ‘বুসো’।
এর পর কলেজ-চাকরি-বিয়ে। বহু দিন গ্রামে আসা হয়নি। এক বার সপরিবারে গ্রামে ফিরে শুনলাম, অধীরবাবু রিটায়ার করেছেন এবং খুব অর্থকষ্টে আছেন। তখন তো মাস্টারদের মাইনে এত ছিল না, পেনশন শুরু হতেও অনেক দেরি হত। বাড়িওয়ালার সঙ্গেও বাড়ি ছেড়ে দেওয়া নিয়ে ঝামেলা বেঁধেছিল। এক দিন ছেলেকে নিয়ে বেরিয়েছি, দেখলাম ওঁর বাড়ির সামনের রোয়াকটাতে উনি বসে আছেন। পরনে একটা তেলচিটে গেঞ্জি আর নোংরা লুঙ্গি। মুখে প্রায় মাসখানেকের খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চুল প্রায় উঠেই গেছে। প্রণাম করে ছেলেকে প্রণাম করতে বললাম। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছেলের সেটা পছন্দ হল না মনে হয়।
বললাম, ‘স্যর, ভাল আছেন?’
উনি প্রায় ঘোলাটে চোখ তুলে তাকালেন, ‘ভাত এনেছিস, ভাত? এত দেরি করলি কেন, কত খিদে পেয়েছে।’
‘স্যর, আমি সতু’— চেঁচিয়ে বললাম।
‘চেঁচাচ্ছিস কেনো, আমি কি কালা? বিয়ে করেছিস, বিয়ে? বউ কোথায়?’
বুঝলাম চোখ-কানের সঙ্গে মাথাটাও একটু গেছে বোধহয়। বাড়িওয়ালা বোধহয় ইচ্ছে করেই ওঁর বাড়ির পাশে যত রাজ্যের পচা নোংরা জিনিস জড়ো করে রেখেছে। গন্ধে টেকা দায়।
ছেলে এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য হাত ধরে টানছিল। দেখলাম, উনি বিড়বিড় করছেন, ‘বাড়ি ছাড়ব কেন, হুঁ? এত দিন আছি।’
ফেরার সময় আমি ভাবছিলাম স্যরকে তখন কত গাল দিয়েছি, কিন্তু এতটা খারাপ বোধহয় কখনও চাইনি।
ছেলে বলল, ‘বাবা, তুমি কাঁদছ?’
আরও কিছু দিন পরে শুনলাম, স্যর মারা গিয়েছেন। কখন মারা গেছেন, কেউ জানতেও পারেনি। দুপুরে ছেলেটা ভাত দিতে গিয়ে জানতে পারে। তখন নাকি পিঁপড়ে ধরে গিয়েছিল।
সৌমেন গঙ্গোপাধ্যায়, গোয়ালতোড়
স্কুলের শিক্ষক/শিক্ষিকা কি নিষ্ঠুর বা উদ্ভট ছিলেন? বিবরণ লিখে পাঠান ৪০০ শব্দে এই ঠিকানায়: গাঁট্টা, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১।
দেওরের সঙ্গে অষ্টমঙ্গলায়
চাকরি করতাম এক বিখ্যাত বাংলা খবরের কাগজে। অস্থায়ী পদে। অফিস থেকে স্থায়ী পদের আশ্বাস পাওয়া সত্ত্বেও বাবা তার কালো মেয়ের জন্য সরকারি চাকুরে পাত্রের লোভ সামলাতে পারেননি। কনে দেখানো আর বিয়ে দেওয়ার মধ্যে মাত্র চারটে রাতের দূরত্ব ছিল। কিচ্ছু খোঁজখবর না নিয়েই বাবা মেয়েকে তুলে দিলেন অন্য রাজ্যে চাকরি করা সরকারি চাকুরের হাতে।
বেশ বড় পরিবার। শ্বশুরঘরে পা দেওয়ার পর থেকেই ফিসফাস কানে আসছিল— ‘যেমনটা চেয়েছিল, তেমনটা পায়নি।’ শাশুড়ি বললেন, ‘আমার মেজো ছেলেটা সবাইকে বলল, লম্বা ফরসা মেয়ে দেখে বিয়ে করতে, আর তার কপালেই কিনা...।’ বড়জা বলে গেল, ‘তোর ছবি দেখে পছন্দ করতে বললে করত না। মেজো’র তো আবার কালো মেয়ে পছন্দ নয়।’ আরও অনেক বাঁকা চোখ আর কথা হজম করলাম বধূবরণে। ফুলশয্যায় স্বামী আমার সঙ্গে কথা বলেনি। যদিও তার জেদেই বিয়েটা এত তাড়াতাড়ি হয়েছিল। তার পর থেকে বড়জা রোজ সকালে খবর নিত, রাতে আমার স্বামী আমাকে কী কী বলল। কোনও কথা হয়নি শুনলে খুব খুশি হত। বিয়ের তিন দিন পর বাবা এলেন। অষ্টমঙ্গলায় জোড়ে মেয়ে-জামাইকে যেতেই হবে। শাশুড়িমা তাঁকে আশ্বস্ত করলেন, তিনি ছেলে আর বউমাকে নিশ্চয়ই পাঠাবেন।
অষ্টমঙ্গলায় যাওয়ার দিন এসে গেল। কিন্তু বাড়িতে কারও মুখে আমাদের যাওয়া নিয়ে কোনও কথা শুনলাম না। থাকতে না পেরে আমিই বললাম, ‘মা আজ আমাদের ও বাড়ি যাওয়া হবে না?’ স্বামী উত্তর দিল, ‘আমার শরীর খারাপ। যেতে পারব না।’ শাশুড়িমা বললেন, ‘সেজোকে বলে দিচ্ছি, ও তোমাকে ও বাড়ি থেকে ঘুরিয়ে আনবে।’ বললাম, ‘মা এটা তো জোড়ে যাওয়া নিয়ম। একসঙ্গে গিয়ে প্রণাম করতে হয়।’ কেউ কোনও কথা শুনল না। বাবা-মা চিন্তা করবেন। তখন আমাদের ল্যান্ডফোনও ছিল না। এক রকম বাধ্য হয়েই সেজো দেওরের সঙ্গে অষ্টমঙ্গলায় বাপের বাড়ি গেলাম।
ফিরে এসে দেখি স্বামী ঘরে নেই। বড়জা হাসতে হাসতে বলল, ‘আরে তোর বর আমার বাপের বাড়ি গিয়েছে।’ ভাবলাম, ইয়ার্কি করছে। কিন্তু শাশুড়িও বললেন, ‘তুমি চলে গেলে। আমার ছেলের কষ্ট হয়নি বুঝি? তাই তো ওকে বড় বউমার বাপের বাড়ি পাঠালাম।’ কিন্তু এই যে বলল, শরীর খারাপ? সেজো জা চুপিচুপি বলল, ‘বড়দির বোনের সঙ্গে দেখা করতে পাঠিয়েছে। মায়ের মনে হয়েছে, তোমাদের বিয়ে হয়েছে বলে তার মনটা খারাপ। দেখা হলে দুজনেরই মনটা একটু ভাল হতে পারে।’
প্রায় ছ’মাস পর সেই বোনটির বিয়েতে নেমন্তন্ন করতে এসে তার বাবা আমার শাশুড়িমাকে শুনিয়ে গেলেন, ‘আমার মেয়ের কালো ছেলে তেমন পছন্দ নয়। তাই এখানে সম্বন্ধটা করিনি।’ আমার শাশুড়ির ফরসা মুখটা সে দিন কালো রাতের মতো হয়ে গিয়েছিল।
কেয়া দিন্দা, দুর্গাপুর
আপনার শ্বশুরবাড়ি ভাল? খারাপ? ভাল-খারাপ মিশিয়ে? শ্বশুরবাড়ির টকঝালমিষ্টি ঘটনা লিখে পাঠান ৪০০ শব্দে।
ঠিকানা: শ্বশুরবাড়ি, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১।
মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষ ‘সিনিয়র সিটিজেন’ কার্ড ইস্যু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বার কেবলমাত্র এই কার্ড গলায় ঝুলিয়ে, সবার সামনে নিজের বয়স-যোগ্যতা ঘোষণা করে, উপযুক্ত ব্যক্তিরা ‘বরিষ্ঠ নাগরিক’দের আসনে বসতে পারবেন। আগে এই সিটের জন্য প্রচণ্ড প্রতিযোগিতা হত। মূলত প্রৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্যের সীমারেখায় থাকা মানুষজন, স্টেশনে দরজা খোলা মাত্র রে-রে করে ছুটে গিয়ে ‘সি-সি’ আসন দখল করে নিতেন। সত্তর পেরনো বুড়ো মানুষরা সামনে দাঁড়িয়ে তাঁদের মোবাইল ঘাঁটাঘাঁটি আর ঝিমুনি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন। দু’-এক বার এই নিয়ে বচসা, হাতাহাতি পর্যন্ত হয়।
.সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, স্টেশনে ঢোকার আগে কেউ কেউ চুপি চুপি দুধসাদা পরচুল গলিয়ে স্মার্টলি প্রবীণ নাগরিকের আসনে গিয়ে বসছেন। অনেকে নাকি শুধুমাত্র এই সুবিধা পেতে কলপ করা ছেড়ে দিচ্ছেন। এতে বহুজাতিক ডাই কোম্পানির বিক্রি সামান্য হলেও মার খেয়েছে— মার্কেট সার্ভেতে ধরা পড়েছে। অন্য দিকে মার্কেটে ছেয়ে গেছে সাদা পরচুলা। বয়স ধরার নির্দিষ্ট কোনও উপায় না থাকায়, ওই পরচুল পরে, প্রবীণ নাগরিকদের আসন যাঁরা হাতিয়ে নিচ্ছেন, আসনে বসে তাঁরা পরীক্ষার পড়া পড়ছেন বা ক্রিকেটের কিট গোছাচ্ছেন। শেষে গ্রাম থেকে কালীঘাটে পুজো দিতে আসা একটি পরিবার আসনের লোভে আট থেকে দশ বছরের তিনটি শিশুর মাথায় সাদা চুল পরিয়ে প্ল্যাটফর্মে বসে আছে দেখে কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে। তার পরই কার্ডের ব্যবস্থা। কার্ড-ঝোলা দুই ব্যক্তির মধ্যে আসন-সংকট হলে, কার্ডে লেখা জন্মের সাল তারিখ মিনিট হিসেব করে দেখতে হবে কে বেশি বয়স্ক, তিনিই আসন পাবেন। রেল কর্তৃপক্ষের এই কার্ড চালুর সিদ্ধান্ত জানাজানি হতেই দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করেছেন সিনিয়র সিটিজেনরা। কিন্তু, একই সঙ্গে জানা গিয়েছে, উকিলদের কাছে ভুয়ো বার্থ সার্টিফিকেট বানিয়ে দেওয়ার চাহিদা হঠাৎ প্রচণ্ড বেড়ে গেছে।
সরিৎশেখর দাস, চন্দনপুকুর, ব্যারাকপুর
লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা:
টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in