রামনবমীর উত্থান কিন্তু বারাণসী থেকেই

তার আগে জৌনপুর, অযোধ্যা, মির্জাপুরের আখড়ায় রামলীলা হত। কিন্তু রাজানুগ্রহে সাধুদের সশস্ত্র মিছিল শুরু কাশীতেই। গৌতম চক্রবর্তীতার আগে জৌনপুর, অযোধ্যা, মির্জাপুরের আখড়ায় রামলীলা হত। কিন্তু রাজানুগ্রহে সাধুদের সশস্ত্র মিছিল শুরু কাশীতেই। গৌতম চক্রবর্তী

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০০
Share:

রামভক্ত: কলকাতায় রামনবমী। তর্জন-গর্জন আছে, ইতিহাসজ্ঞান?

নিজেকে বারাণসীর রাজা বলে প্রমাণ করতে সহজ রাস্তাটা বেছে নিলেন উতারিয়া গ্রামের জমিদার বলবন্ত সিংহ।

Advertisement

বারাণসীর আশপাশে রামানন্দী সাধুদের তিনটি বড় কেন্দ্র। একটি চিত্রকূটে, অন্যটি জনকপুরে, আর একটি অযোধ্যায়। অষ্টাদশ শতকে লোকের বিশ্বাস, এই চিত্রকূটই রাম-সীতার বনবাসের পুণ্যস্থান। জনকপুর রামায়ণের মিথিলা, জনক রাজার রাজধানী। আর সরযূর তীরে এই অযোধ্যা রামচন্দ্রের জন্মস্থান। রামানন্দী সাধুরা এ রকমই বলেন।

মুঘল সাম্রাজ্যের ভাঙনকালে, সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকের এই সময়টায় রামানন্দী সাধুরাই সবচেয়ে বড় সন্ন্যাসী সঙ্ঘ। মঠে বিশাল জমিজিরেত, ত্রিশূল, লাঠি, গাদা বন্দুক ও হরেক অস্ত্রশস্ত্র। সুদের ব্যবসা, কাপড়ের ব্যবসা, অনেক কিছুতেই আছেন এঁরা। ধর্মে বৈষ্ণব, চিত্রকূটে গিয়ে সেখানকার ধুলো দিয়ে তিলক কাটেন। সেই ধুলোকে এঁরা ভক্তিভরে ‘রামরজ’ বলেন।

Advertisement

বৈষ্ণব, কিন্তু রামানুজ, মধ্বাচার্য-প্রতিষ্ঠিত সম্প্রদায়ের থেকে আলাদা। লক্ষ্মী এবং বিষ্ণু নন, রাম-সীতাই এঁদের উপাস্য। ‘সীতাপতির যে শ্লোক মহান রামানন্দ আমাদের দিয়ে গিয়েছিলেন, গুরু পরম্পরায় আমাদের যা ঘিরে আছে, সেই শ্লোকের বন্দনা করি’, এই ভাবেই রামায়ণ পাঠ শুরু করেন ওঁরা। রামানুজের শিষ্যরা সীতাপতির বদলে বলেন লক্ষ্মীপতি। আর রামানন্দের বদলে রামানুজ। রামানুজীরা মনে করেন, বিষ্ণু এবং লক্ষ্মীই সৃষ্টির কারণ। রামানন্দীরা ভাবেন, রাম আর সীতা থেকেই বিশ্ব সৃষ্টি। অন্য দেবদেবীরা শুধুই ছায়া।

অষ্টাদশ শতকে বলবন্ত সিংহ এই রামানন্দী সাধুদেরই ব্যবহার করলেন। মনসা রাম নামে বলবন্তের এক পূর্বপুরুষ বারাণসীর নাজিম রুস্তম আলি খানের অধীনে চাকরি নিলেন। রুস্তম খানের হয়েই তিনি খাজনা আদায় করেন, যুদ্ধবিগ্রহে যান। বারাণসী তখন মুঘল শাসনে।

১৭৩৯ সালে মুঘল শাসনের কোমর ভেঙে গেল। পারস্যের নাদির শাহ দিল্লি আক্রমণ করলেন, ময়ূর সিংহাসন ছিনিয়ে চলে গেলেন। মুঘল সম্রাট এখন শুধুই রাবার-স্ট্যাম্প।

এই ভাঙনকালে অযোধ্যার নবাব সাদাত খান ও মুঘল সম্রাট মহম্মদ শাহ, দুজনেই বলবন্তকে রাজা উপাধিতে ভূষিত করলেন। বারাণসী, জৌনপুর, গাজিপুর, চুনারের বিস্তীর্ণ এলাকা এখন বলবন্তের অধীনে। এই সব এলাকা থেকে খাজনা সংগ্রহ করে তিনি অওধে পাঠিয়ে দেবেন।

কিন্তু বলবন্তের অভিপ্রায় অন্য। ওপরওয়ালা, অওধের নবাবকে কয়েক বার খাজনা দিলেন তিনি। তার পরই বেঁকে বসলেন। নবাব সেনাদল পাঠালেন, তাদের মারধর করে তাড়িয়ে দিলেন বলবন্ত। আরও বড় সেনাদল পাঠানো হল, বলবন্ত মির্জাপুরের জঙ্গলে লুকিয়ে থাকলেন। সুযোগ পেলেই গেরিলা স্টাইলে নবাবের সেনাদের আক্রমণ করেন। বারাণসীর ও পারে রামনগরের রাজবাড়ি দেখে তাই মোহিত হবেন না। আধুনিক ইতিহাসবিদরা এক বাক্যে বলেন, অষ্টাদশ শতকের ‘কাশীনরেশ’রা নাম-কা-ওয়াস্তে রাজা, আসলে তাঁরা নবাবের খাজনা আদায়ের মধ্যস্বত্ব ভোগী মাত্র।

বলবন্ত জানেন, ভাড়াটে সৈন্য হিসাবে রামানন্দী সাধুরা অতুলনীয়। অওধের নবাব আসফউদদৌলা পর্যন্ত সেনাদলে এঁদের স্থান দেন। বস্তুত, নবাবের সঙ্গে বলবন্তের ঝামেলাও স্রেফ খাজনার টাকা হাতানোর জন্য। হিন্দু-মুসলমান তফাত মাথাতেই ছিল না। ১৭৬৩ সালে, বক্সারের যুদ্ধে কাশীনরেশ মুঘল সম্রাট শাহ আলম ও অওধের সুজাউদদৌল্লার হয়েই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিলেন।

বলবন্তের আমল থেকেই অওধ, বারাণসীর বিস্তীর্ণ এলাকায় রামনবমীর সশস্ত্র মিছিলের রমরমা। রামানন্দী সাধু ও রাজার ক্ষাত্রধর্ম মিলেমিশেই এই মিছিল বা জুলুস। কিন্তু এই ইতিহাস আজকাল ধর্মের ধ্বজাধারীরাও মনে রাখেন না।

অওধের নবাবেরা চুনার, মির্জাপুরের জঙ্গলে আর কত দিন বলবন্তের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন? অন্য জমিদারেরাও বারাণসীর দেখাদেখি খাজনা নিয়ে সমান বেয়াদবি করছে, বেশি দিন সৈন্য সাজিয়ে বসে থাকলে আম ও ছালা দুটোই যাবে। বলবন্তকে তাই বেশি দিন গেরিলা যুদ্ধ চালাতে হল না। রাজনীতির খাতিরেই অওধের নবাব তাঁর রাজ-সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখলেন।

কিন্তু নতুন রাজাকে শুধু খাজনা আদায় আর যুদ্ধ করলেই হয় না। প্রজাদের কাছেও তিনিই বৈধ, আইনানুগ নরপতি, এমন সঙ্কেত পাঠাতে হয়। বলবন্ত এখানেই রামানন্দীদের ব্যবহার করলেন। এই সশস্ত্র বৈষ্ণব সাধুদের অন্যতম বড় উৎসব শ্রীরামচন্দ্রের জন্মতিথি বা রামনবমী। এত দিন এটি আখড়ায় হত, এ বার রামকথা শোনাতে তাঁরা নতুন রাজধানী বারাণসীতে এলেন। আজও বারাণসীর নানা জায়গায় তাই রামায়ণ পাঠ আর রামলীলার ছড়াছড়ি।

বলবন্তের নাতি উদিতনারায়ণ এক বার চিত্রকূটে রামলীলা দেখতে গিয়েছিলেন, ঝড়বৃষ্টিতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। তত ক্ষণে রামলীলা শুরু হয়ে গিয়েছে। রামানন্দী সাধুর আখড়া এতই প্রবল যে, দেরির জন্য রাজাকেও রেয়াত করে না। উদিত সাধুদের জানালেন, অস্ত্রশস্ত্র, পতাকায় সজ্জিত হয়ে ঘোড়ার পিঠে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছে। সাধুরা যদি অনুগ্রহ করে এ বার থেকে রাজপ্রাসাদে রামলীলার অনুমতি দেন! রামনগরের প্রাসাদে তাই আজও নিয়ম, রাজা না এলে রামলীলা শুরু হবে না!

রামনবমীর উত্থানের পিছনে ক্ষত্রিয়নরেশ, রামানন্দী সাধু ছাড়া আরও একটি কারণ আছে। তুলসীদাসের ‘রামচরিতমানস’। হিন্দু ভাষার ওই কাব্যে বালকাণ্ডই বৃহত্তম। বাল্মীকি, কৃত্তিবাসে যা নেই, সেই সবও জুড়ে দিয়েছিলেন ভক্ত তুলসী। কৌশল্যা রামকে দোলনায় শুইয়ে বাইরে গিয়েছেন, এসে দেখেন, সেখানে শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী এক বিশাল পুরুষ। মা প্রার্থনা করলেন, হে পুরুষোত্তম, তুমি আবার শিশু হিসেবে আমাকে দেখা দাও। মায়ের মনোবাঞ্ছা পূরণে রামচন্দ্র আবার শিশুতে পরিণত হলেন।

তুলসীদাসে আর একটি চমৎকার জায়গা আছে। হরধনু ভাঙার আগে, সকালবেলায় বাগানে বেরিয়ে কিশোরী সীতা কিশোর রাম ও লক্ষ্মণকে দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন। বাল্মীকিতে এ সব নেই। ঠিকঠাক তুলসীদাস পড়লে আজ আর প্রেমের বিরুদ্ধে জিহাদ হত না, অস্ত্র হাতে রামানন্দী সাধুদের আদলে মিছিল বের করে রাজনীতিও হত না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন