খেলার সংজ্ঞা তিনি পালটে দেন বারবার

কেরিয়ার শুরুর দশ বছরের মধ্যে সাফল্যের শৃঙ্গে। চোট-আঘাত, অফ ফর্ম, সব পেরিয়েও ফিরে আসেন কোর্টে। রজার ফেডেরার মানে প্রতিভা আর পরিশ্রমের যুগলবন্দি।কেরিয়ার শুরুর দশ বছরের মধ্যে সাফল্যের শৃঙ্গে। চোট-আঘাত, অফ ফর্ম, সব পেরিয়েও ফিরে আসেন কোর্টে। রজার ফেডেরার মানে প্রতিভা আর পরিশ্রমের যুগলবন্দি।

Advertisement

অনীক চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
Share:

ফেব্রুয়ারি মাসের এক, ২০০৯। ঠিক ন’বছর আগের এক সন্ধ্যা। সাড়ে চার ঘণ্টার একটা ম্যারাথন টেনিস ম্যাচ, দু’জন মহীরুহ এবং ম্যাচ-পরবর্তী আবেগবাষ্প সেই সন্ধেয় যে অ্যাড্রেনালিন, বিস্ময় আর অনুভবের জন্ম দিয়েছিল তা আজও স্মৃতিতে উজ্জ্বল। একটা টেনিস ম্যাচ শিখিয়েছিল, একটা খেলাকে অবলম্বন করে দু’জন মানুষ শারীরিক ও মানসিক লড়াইয়ের কোন সীমায় নিজেদের নিয়ে যেতে পারে, সারা কোর্ট জুড়ে ফোটাতে পারে ভলি, টপস্পিন আর ড্রপশটের অসংখ্য ফুল। একটা ট্রফি বিতরণ অনুষ্ঠান দেখিয়েছিল, একটা খেলাকে কোন গভীরতায় নিজের বাঁচার সঙ্গে জড়িয়ে নিলে, একটা মানুষ রানার্স আপ ট্রফি হাতে কান্নায় বাকরুদ্ধ হয়ে যেতে পারে। দেখিয়েছিল— প্রায় উলটো স্বভাবের, কোর্টে অসম্ভব আক্রমণাত্মক, আবেগী, সদ্য জিতে-ওঠা দ্বিতীয় মানুষটি প্রতিপক্ষের প্রতি কী অসম্ভব শ্রদ্ধাশীল হয়ে, ট্রফি হাতে এক পৃথিবী লোকের সামনে বলতে পারে “আজকের জন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু তুমি জানো তুমি কত বড় চ্যাম্পিয়ন...”

Advertisement

ন’বছর পর, সেই প্রথম জন যখন রড লেভার এরিনায় জীবনের কুড়িতম গ্র্যান্ড স্ল্যাম ট্রফি তুলছেন, তখন মানুষটির বয়স ছত্রিশ পেরিয়েছে। উপস্থিত পনেরো হাজার মানুষের চিৎকার আর করতালি জানান দিচ্ছিল, এই গ্রহের যে কোনও টেনিস-প্রেমী মানুষের কাছে মানুষটি কোন উচ্চতায় জেগে থাকেন। ট্রফি হাতে বক্তব্য রাখার পরে সেই মানুষটি যখন দাঁতে ঠোঁট চেপে কেঁদে উঠছেন আর ক্যামেরায় ধরা পড়া সেই ভেসে যাওয়া চোখ-মুখ, কান্না ইথার বেয়ে ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের স্ক্রিনে স্ক্রিনে, তখন মুহূর্ত জানান দিচ্ছিল— শুধু টেনিস নয়, এ পৃথিবীতে যত দিন খেলা বলে কিছু থাকবে, তত দিন যে কোনও খেলোয়াড়ের প্রতিভা, উৎকর্ষ আর শ্রেষ্ঠতা পরিমাপের একটা স্কেলের নাম হয়ে থাকবে রজার ফেডেরার।

আমাদের অনেকেরই টেনিস দেখা, বোঝা আর মজে যাওয়ার শুরু ফেডেরার আর নাদালের র‌্যাকেট জড়িয়েই। এমার্সন-বর্গ-লেন্ডেল-ম্যাকেনরো দূরের কথা, আমাদের টেনিস বোঝার ঠিক আগে চলে গিয়েছেন সাম্প্রাস-আগাসিও। ফলে একক ভাবে খেলা হয় এমন খেলাদের মধ্যে তর্কযোগ্যভাবে কঠিনতম ও সুন্দরতম খেলাটির ব্যাকরণ শেখা থেকে শুরু করে তার সাহিত্য হয়ে ওঠার পথটির রস আস্বাদনের জন্য আমাদের প্রজন্মের প্রাথমিক ভরকেন্দ্র এই দু’জনই।

Advertisement

২০০৪-’০৯, এই সময়টায় পুরুষ টেনিসজগৎ আবর্তিত হয়েছে ফেডেরার-নাদালকে ঘিরেই। পরে জকোভিচ, মারে এসেছেন। এই ‘বিগ ফোর’ এর বাইরেও নিজের নিজের ঔজ্জ্বল্য নিয়ে এসেছেন বা এখনও আছেন ওয়ারিঙ্কা, ফেরার, নালবান্দিয়ান, রডিক, ভারদেস্কো, সঙ্গা, দাভেদাঙ্কো, চিলিচ। এই সময়টায় আমরা পয়েন্ট-গেম-সেটের ব্যাকরণ থেকে শুরু করে জকোভিচ-মারের বেসলাইন থেকে দুরন্ত ফোরহ্যান্ড উইনার, ফেডেরার-ওয়ারিঙ্কার নিখুঁত সিঙ্গল-হ্যান্ডেড ব্যাকহ্যান্ড, নাদালের বিষাক্ত টপস্পিন, সঙ্গার ট্রেডমার্ক ‘সার্ভ অ্যান্ড ভলি’ দেখেছি, মুগ্ধ হয়েছি। কখনও আবেগে ভেসে গিয়েছি চল্লিশ র‌্যালির একটা পয়েন্ট দেখে। কখনও আবার দু’শো কুড়ির কোনও নিখুঁত ‘এস’ দেখে অস্ফুটে বলেছি, অবিশ্বাস্য!

তবু এই সব ছোট ছোট মুহূর্ত পেরিয়ে মানুষ এমন একটা কিছুর খোঁজে থাকে, যার কাছে নিশ্চিন্তে রাখা থাকবে তাদের স্মৃতি, অস্তিত্ব। এক-একটা বছরকে মানুষ চিহ্নিত করে রাখতে চায় তার খুব গভীর কিছু অনুভব-ছবি দিয়ে। তাদের কিছু আমার আঁকা, বাকিগুলি অন্য কারও। ছবিদের অবলম্বন করে স্মৃতিতে গুছিয়ে রাখি নিজের সময়কে, যেখানে আমি কিছুটা হলেও নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলাম। তাই ২০০৮ বললে কারও মনে পড়ে যায় ১২ জুন জয়েন্টের রেজাল্ট, বা ১ আগস্ট মেডিকেল কলেজের ডিসেকশন হল, তেমনই পাশাপাশি জেগে থাকে ৬ জুলাইয়ের মহাকাব্যিক উইম্বলডন ফাইনালও। বাকি সমস্তটাই দৈনন্দিনতায় ধূসর, জীবনের নিয়মেই বিস্মৃতির উৎসব।

রজার ফেডেরার এইখানেই গত ষোলো বছর ধরে নিরন্তর আমাদের স্মৃতির অবলম্বন, বছরদের গুছিয়ে তুলে রাখার ক্যানভাস। শুধুমাত্র টেনিস নামক একটা খেলায় তার এভারেস্টসম সাফল্য, আধিপত্য আর স্ট্যাটিসটিক্স নিয়ে আমাদের কাছে এসে দাঁড়ান বলে তিনি রজার ফেডেরার নন। বেসলাইনের ও পাশ থেকে টেনিস নামক একটা খেলার সংজ্ঞা বারবার আমাদের দিকে ছুড়ে দেন বলে তিনি রজার ফেডেরার।

আমরা দেখি তাঁর র‌্যাকেটে নাইলনের তার নয়, একটা আয়না লাগানো। তাতে তাকালে নিজেদের দৈন্য আর লজ্জা দেখা যায়। যে আমাদের ছোটবেলা থেকে শেখা যে বাড়ি-গাড়ি করার পরে পাড়ার পুজো কমিটির সেক্রেটারি হলে বা কাগজে দু’বার ছাপার অক্ষরে নাম বেরোলেই জীবনের উদ্দেশ্য পূর্ণ, দেখা যায় তাদের অবয়ব। যে আমরা একটু প্রতিপত্তি হলেই কলার তুলে সেলেবপনা প্র্যাকটিস করি, তাদের দু’চোখ। যে আমরা নিজেদের সুখের নিক্তি মাপি ফেসবুকের কুড়ি কিলোবাইট স্ট্যাটাস আর তাতে আড়াইশোটা লাইক দিয়ে ঝুঁকে থাকা মাথাগুলো দিয়ে, তাদের ধড়মুড়ো স্পষ্ট ফুটে ওঠে সেই আয়নার কাচে।

কোর্টে যা যা করা যায়, একটা মানুষ সব করে দেখাচ্ছে অবলীলায়। পেশাদার টেনিসে যে উচ্চতায় পৌঁছনো যায় তার প্রতিটি শৃঙ্গে পৌঁছে যাচ্ছে কেরিয়ারের দশ বছরের মধ্যে। তাকে ‘গ্রেটেস্ট অব অল টাইম’ বা মজা করে সংক্ষেপে ‘গোট’ বলে ডাকছে সাধারণ দর্শক থেকে শুরু করে কিংবদন্তিরাও। তার পরে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই চোট-আঘাত আসছে, ফর্ম পড়ে যাচ্ছে, বা নিতান্ত শারীরিক সক্ষমতায় পিছনে ফেলে দিচ্ছে নতুনেরা। পৃথিবীর সবাই তাকে শ্রদ্ধার জায়গায় বসিয়েই উপদেশ দিচ্ছে, এ বার বসে যাও। তার পরেই সেই মানুষটা নিজের তূণীরে যোগ করছে নতুন শট, গরমে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন খেলার জন্য মাসের পর মাস স্বেচ্ছা-ঘাম ঝরাচ্ছে দুবাইতে, আর ফিরে এসে তুলে নিচ্ছে তিনখানা গ্র্যান্ড স্ল্যাম! যেই বুঝতে পারলাম আমি একটা কাজ একটু ভাল ভাবে পারি, সেই প্রতিভার ধারণা ডাস্টবিনে ছুড়ে নিজেকে প্রত্যেকটা দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর শুধু ঘাম দিতে থাকলাম; পৃথিবীজোড়া অর্থ-খ্যাতি-সম্ভ্রমের সব আলোটুকু মঞ্চে পাওয়ার পরেও র‌্যাকেট হাতে এসে বসলাম বারবার; পৃথিবীর সবাই যখন যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে জানে আমি ফুরিয়ে গিয়েছি, তখন নিজের বুক হাতড়ে বের করে আনলাম অনন্ত সাহস আর বিশ্বাস— এই দর্শন কী এই পৃথিবীর!

রজার আমাদের নতুন করে কর্মযোগের সংজ্ঞা শেখান। শেখান, ছন্দ, শব্দ আর অনুভবের সবটা বোঝার পরেও আমাদের প্রতি পঁচিশটা কবিতার মধ্যে হয়তো একখানা মানুষ মনে রাখবে, অনেকটা সময় আর শ্রম দিয়ে দেড় হাজার লাইন লিখলে হয়তো বেরিয়ে আসবে দু’খানা অমোঘ লাইন— তাও শুধু লিখে যেতে হবে। শেখান, প্রতি পাঁচটা সিনেমায় হয়তো একখানা হিট করবে, মানুষ মনে রাখবে মিনিট কয়েকের একখানা অভিনয়দৃশ্য— তাও রোজ সেট-এ যেতে হবে ‘আজ জীবনের সেরা অভিনয়টা করব’ বলে। যখন সবাই বলছে, ‘পাগলামি না করে বিসিএসটা দে’ তখন তিনিই বলেন, উঁহু, জীবনে যদি কিছু করতে হয় তো গানটাই করো, আর এক বার দাওই না, অডিশনটা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন