একটাভয়কষ্ট[লজ্জা]

মায়ের রোগা-কাঠি মেয়ে এক্সকারশন-এ যাচ্ছে। কলেজ থেকে। নেহাত পড়াশোনার কাজ, না হলে মাতারানি কিছুতেই রাজি হতেন না। অতএব, খুব ভয়ে, উদ্বেগে আকুল হয়েই, আচ্ছা... তথাস্তু।

Advertisement

সঞ্চারী মুখোপাধ‌্যায়

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৫ ০০:০৫
Share:

মায়ের রোগা-কাঠি মেয়ে এক্সকারশন-এ যাচ্ছে। কলেজ থেকে। নেহাত পড়াশোনার কাজ, না হলে মাতারানি কিছুতেই রাজি হতেন না। অতএব, খুব ভয়ে, উদ্বেগে আকুল হয়েই, আচ্ছা... তথাস্তু।

Advertisement

হাওড়া স্টেশন। নয় নয় করে আঠারো জনের দল যাচ্ছে। সঙ্গে দুজন প্রফেসর। কামরার সামনে মেগাহাট বসে গেছে। সবার বাড়ির লোক তুলতে এসেছে। প্রত্যেক মা-ই নিজের মেয়েদের নিজস্ব সাবধানবাণী বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আমার মা তো তাতেই ক্ষান্ত হয়ে থাকার বান্দা নন। তিনি তখন আমাদের মাস্টারমশাইদের খুঁজছেন। যাতে তাঁরা মায়ের মেয়ের দিকে স্পেশাল নজর রাখেন। একে রোগা-পাতলা, তায় হিমোগ্লোবিন কমে গেছে— এমন সাংঘাতিক কম্বিনেশন নিয়েও মেয়ে কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করে ড্যাংডেঙিয়ে এক্সকারশন যাচ্ছে! এ হেন মেয়ে যে নিজের খেয়াল রাখবে না, মা বেশ বুঝতে পেরেছে।

আমার মা মনে করে, পৃথিবীর সব বেঠিক ব্যাপারস্যাপার একচোখোমি করে মায়ের মেয়েদের দিকেই তাক করে আছে। ছোটবেলায় মায়ের মনে হত সব ছেলেধরা আমাদের দিকেই ধাবিত, কিংবা সব ফুচকাওয়ালা ড্রাগ মেশায় তেঁতুলজলে, অতএব বাড়ি ফিরতে আধ ঘণ্টা দেরি হলে মায়ের প্রেশার ২০০-র কাছাকাছি নাচানাচি করত। রান্নাবান্না পড়ে থাকত, মা বারান্দায় ঠায় দাঁড়িয়ে। অনেক সময়, আমার বা দিদির যেখান থেকে ফেরার কথা, সে কলেজ হোক বা টিউশন, সেই দিকে স্ট্রেট রওনা দিত। সেই মা, মেয়েকে ট্রেনে করে দূরান্তে পাঠিয়ে দিচ্ছে। তা হলে, মেয়ের সুরক্ষা যাতে কোনও ভাবে বিঘ্নিত না হয়, সেই ব্যাপারে পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করার হক তার আলবাত আছে।

Advertisement

আমার দুজন শিক্ষকের বিবরণ আগেই জানা ছিল মায়ের। দু’জনের মধ্যে এক জনের বয়স একটু কম ছিল। সেই বর্ণনা অনুযায়ী মা আমার শিক্ষকদের খুঁজতে শুরু করল। ট্রেন ছাড়ব ছাড়ব, এমন সময় দেখি মা, আমার এক বন্ধুর দাদাকে হাত-পা নেড়ে পাগলের মতো কী সব বলছে। মুখে একটা দিশেহারা ভাব। ধাক্কাধাক্কি করে কামরার দরজার কাছে যেতেই প্রমাদ গুনলাম। মা সেই বন্ধুর দাদাকে আমার মাস্টারমশাই ঠাওরে বলে চলেছে, ‘আমার মেয়েটাকে একটু দেখবেন। খুব রোগা তো, আর খাওয়াদাওয়া ঠিক করে করে না একদম। আর হিমোগ্লোবিন সাড়ে আট!’ ট্রেন তখন ধীরে প্ল্যাটফর্ম ছাড়ছে। বন্ধুর দাদাটি মুখ রাঙা করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রথমে কিছুটা অবাক, তার পর কেমন একটা নম্রনত মুখ করে শুনছে।

আমার প্রেস্টিজে তখন, যাকে বলে, গ্যামাক্সিন। আমি চেঁচিয়েমেচিয়ে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু সব চেষ্টা বৃথা করে দিয়ে ট্রেন তখন ছেড়ে গেল। আমার কান গরম। মায়ের এই অহেতুক উদ্বেগ আমায় যে কোথায় দাঁড় করাল, সে মা মোটেও বুঝতে পারবে না। মনে মনে মা’কে তখন যা-তা বলছি। কোনও সিদ্ধিবিদ্ধি জ্ঞান নেই! এক বার তো জিজ্ঞেস করবে, কে আমার টিচার। তা নেইকো, যাকে তাকে পাকড়ে নিজের মেয়ের কথা বলা কি ঠিক?

ও দিকে বিধাতা অলক্ষে এবং আমার বন্ধুরা প্রকাশ্যে প্রকাণ্ড হাসাহাসি, খ্যাপানো শুরু করল। কিছু ক্ষণ অন্তর অন্তর কেবল একটাই কথা, ‘আমার মেয়েটাকে একটু দেখবেন!’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন