কেচ্ছা

সে এক ওয়াইল্ড ব্যাপার

স্ক্যান্ডাল ও গসিপের মধ্যে পার্থক্য কী? অস্কার ওয়াইল্ড লেখেন, ‘স্ক্যান্ডাল ইজ গসিপ মেড টিডিয়াস বাই মরালিটি।’ এর তিন বছর পর, ১৮৯৫-পরবর্তী সময়ে কতকটা সে ফাঁদেই পড়তে হল তাঁকে। সমাজের নীতিবোধের আগুনে পুড়ে তাঁর কীর্তিকলাপ ও তা নিয়ে রসচর্চা ঘোর কেচ্ছা হয়ে ছড়িয়ে পড়ল খুব দ্রুত।

Advertisement

সুস্নাত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০২
Share:

স্ক্যান্ডাল ও গসিপের মধ্যে পার্থক্য কী? অস্কার ওয়াইল্ড লেখেন, ‘স্ক্যান্ডাল ইজ গসিপ মেড টিডিয়াস বাই মরালিটি।’ এর তিন বছর পর, ১৮৯৫-পরবর্তী সময়ে কতকটা সে ফাঁদেই পড়তে হল তাঁকে। সমাজের নীতিবোধের আগুনে পুড়ে তাঁর কীর্তিকলাপ ও তা নিয়ে রসচর্চা ঘোর কেচ্ছা হয়ে ছড়িয়ে পড়ল খুব দ্রুত। বিখ্যাত নাট্যকার-সাহিত্যিকের ক্রমশ ক্ষয়ে যাওয়া ও শেষমেশ ধসে পড়া স্তম্ভিত করে দিয়েছিল সে সময়ের ইংল্যান্ডকে।

Advertisement

উনিশ শতক। শুদ্ধতার বাই তোলা সেই ভিক্টোরীয় যুগে সমকামী হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছিল অস্কার ওয়াইল্ডের বদনাম। সমকাম তখন মহাপাপ। পায়ুকাম নরক‌যাত্রার শামিল। ভিক্টোরীয় অবদমনের সেই নীতি-চাদরের নীচে শরীর-মনের তাড়নায় একাধিক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন অস্কার। ক্লিভল্যান্ড স্ট্রিটে পুরুষ সমকামীদের কুখ্যাত নিষিদ্ধপল্লীটির সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক থাকার কথা রটে যায়। শেষমেশ ‘অশ্লীলতা’-র দায়ে জেল। দু’বছরের সশ্রম কারাদণ্ড।

রোবি রোজ কিংবা অ্যালফ্রেড ডগলাস। ওয়াইল্ডের পুরুষ সঙ্গীরা ছিলেন অল্পবয়সি। কাজেই, কচিমাথা চিবোনোর একটা ধারণাও তাঁর ক্ষেত্রে জুড়ে যায়। তার ওপর সেই ছেলেপিলেরা সকলেই বেশ কেউকেটা পরিবারের, সুতরাং ঘরের ছেলের ‘বখে যাওয়া’ ঠেকাতে শামিল হলেন প্রভাবশালী অভিভাবকেরা। সেখানেই বিপত্তির শুরু। খুঁচিয়ে ঘা করলেন ওয়াইল্ড-ই। তাঁকে ‘পায়ুকামী’ বলায়, অ্যালফ্রেডের বাবা জন ডগলাস, নবম মার্কুইস অব কুইন্সবেরি-র বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন ওয়াইল্ড। বাবার বিরুদ্ধে আদালতে যেতে তাঁকে ইন্ধন জুগিয়েছিলেন অ্যালফ্রেডও। ওয়াইল্ডের পিছনে টিকটিকি লাগিয়ে, গোপন তথ্য জোগাড় করে কুইন্সবেরি-র আইনজীবীরা পরদা ফাঁস করে দেন। বারো জন যুবককে যৌন সংসর্গে বাধ্য করার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। আদালত তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে কড়া শাস্তি দেয়।

Advertisement

ওয়াইল্ডের ‘ওয়াইল্ড’ কেচ্ছা এত দূর প্রভাব ফেলেছিল যে, দীর্ঘ দিন পর্যন্ত লোকে তা নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করতেও দ্বিধা বোধ করত। স‌ংবাদপত্রের ভাষায় ‘অস্কার ওয়াইল্ড’ শব্দবন্ধটি হয়ে গিয়েছিল দুই পুরুষের মধ্যে শারীরিক সম্পর্কের সমার্থক। সে কালের বিভিন্ন প্রতিবেদনে পুরুষ সমকামী বোঝাতে তাঁর নাম প্রবচনের মতো ব্যবহৃত হতে থাকে। স্ত্রী কনস্ট্যান্স লয়েডের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমশই আলগা হচ্ছিল। এ ঘটনায় তা আরও আহত হয়। আইনি বিচ্ছেদ হয়নি, ওয়াইল্ডের সঙ্গে জেলেও দেখা করেছেন লয়েড, কিন্তু মোক্ষম ধাক্কাটা দেন দুই পুত্রের নাম থেকেই বাবার পদবিটি মুছে দিয়ে।

জেলে থাকতেই শারীরিক ভাবে ভেঙে পড়েন ওয়াইল্ড। ছাড়া পাওয়ার পর অবস্থার আরও অবনতি। ডগলাসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা যাবে না, এই শর্ত দিয়ে টাকা পাঠানোও বন্ধ করে দেন তাঁর স্ত্রী। জেল থেকে বেরনোর বছর তিনেকের মাথায় মারা যান তিনি। মৃত্যুর কারণ সেরেব্রাল মেনিনজাইটিস হলেও, অনেকে মনে করেন, সিফিলিসে আক্রান্ত হওয়ার প্রভাবও তাঁর ওপর পড়েছিল।

এ সবের ঢের আগেই তাঁর একমাত্র উপন্যাস ‘দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে’-তে তিনি সমকামিতার আভাস এনেছেন। সে কালে তা সমালোচিতও হয়েছে। কিন্তু নিজের জীবনে সেই অভ্যাসকে বহন করতে গিয়ে সমাজের হাত থেকে রক্ষা পাননি। আজকের প্রেক্ষিত থেকে দেখলে হয়তো তাঁর এই ভালবাসা, তাঁর নয়, ছিল সেই সমাজেরই কেচ্ছা। আত্মরক্ষার বৃথা চেষ্টায় সম্ভবত সেই আকুতিই প্রকাশ করেছিলেন ওয়াইল্ড— ‘ইট ইজ দ্যাট ডিপ, স্পিরিচুয়াল অ্যাফেকশন দ্যাট ইজ অ্যাজ পিওর অ্যাজ ইট ইজ পারফেক্ট’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন