তখন বিশ শতক মাঝবয়সি। এ দেশের স্বাধীনতা নিতান্ত ছেলেমানুষ। সেই সময়ে, পঞ্জিকা ছিল রাজা। যা নাই পাঁজিতে, তা নাই ভারতে! জ্যোতিষ, পুজোর নির্ঘণ্ট, খনার বচন, ডাকের চলন, ট্রেন-প্লেনের কখন কোথায় গমন, অফিস-রাস্তার বিবরণ, থিয়েটারের হদিশ-তথ্য। ইহজগতের যাবতীয় প্রয়োজন ঠাসা রয়েছে দু’মলাটে।
সঙ্গে, দুষ্প্রাপ্য সব ছবি। হাতওয়ালা জগন্নাথঠাকুর! মা গঙ্গার বাহন মকর মহারাজ! তবে, সে দিনের পঞ্জিকা যদি জ্ঞানবৃদ্ধ নিখিলবিশ্ব হয়, তবে তার বিজ্ঞাপনের পাতা হল রহস্যের মিউজিয়াম। কিন্তু তার দরজা খোলার আগে বিধিসম্মত সতর্কবার্তা দিয়ে রেখেছেন স্বয়ং প্রকাশক, ‘যন্ত্রান্তরে মুদ্রিত পঞ্জিকা মধ্যস্থ কোন বিজ্ঞাপনই অশ্লীলতা দোষে দুষ্ট নয়। আমাদের অননুমোদিত কোনও বিজ্ঞাপনে সে দোষ থাকিলে বিজ্ঞাপনদাতাই দায়ী।’
উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে তখনই নিষিদ্ধপুরীতে প্রবেশ। এ যে আরব্য রজনীর সেই চল্লিশ চোরের গুহা! কী সব মন মাতানো বর্ণনা আর জিয়ন্ত ছবি! রাজপুরুষের পাশাপাশি এক তিলোত্তমা। তাঁদের ঘিরে জ্যোতি ঠিকরে বেরোচ্ছে রত্নখচিত এক মুকুট থেকে। তার মাথায় বিশাল অক্ষরে লেখা— ‘সম্মোহিণী অঙ্গুরী’। বিজ্ঞাপনী ‘ক্যাচলাইন’ও রূপকথার মতো। ‘এই তান্ত্রিক অঙ্গুরী ধারণ করিয়া মনে মনে যে ব্যক্তির নাম লইবেন তিনি সাত সমুদ্র তের নদী পারে থাকলেও সব বাধা-বিঘ্ন উল্লঙ্ঘন করিয়া আপনার কাছে এসে হাজির হইবেন এবং কঠোরতা শত্রুতা ত্যাগ করিয়া আপনার হুকুম মত চলিবেন। চাকুরী ও ভূ-প্রোথিতধনের সন্ধান মিলিবে, লটারী, ফাটকা-জুয়া মোকদ্দমায় জিত হইবে। মূল্য ৩ টাকা। ধারণ মাত্রই বিদ্যুৎসম ক্ষিপ্রতার সহিত কার্য করিবে।’
এই পর্যন্ত পড়া মাত্র, ১৩৬৫ বঙ্গাব্দের গুপ্ত প্রেশ পঞ্জিকার ধোঁয়া-ধূসর পাতা থেকেই আংটিটি বিদ্যুদ্বাণ ছুড়ে আমাকে সত্যি সত্যি বশ করল। কারণ, তার কয়েক পৃষ্ঠা পরেই হিমালয় পর্বত। সেখানে ত্রিশূল হাতে বসে এক জটাজূটধারী। তিনি রুমাল বিলি করছেন। পাশে লেখা, ‘দেবদূতদ্বয়কে বশীভূত করিয়া সম্মোহন বিদ্যার দ্বারা এই রুমাল প্রস্তুত। এই রুমালের অধিকারী যে কোন লোককে হাতের মুঠায় আনিতে, প্রণয়ে বিজয়ী হইতে ও প্রচুর অর্থোপাজ্জর্নের অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা লাভ করিবেন। ইহা নাড়াইয়া আপনি যাহা মনে করেন তাহাই করিতে পারিবেন।’
বিজ্ঞাপন জানাচ্ছে, পঞ্জাবের জলন্ধরে আছে ‘বেঙ্গল মেসমেরিজ্ম হাউস’ নামের সংস্থা। তারাই সম্মোহনী রুমাল, জাদু আয়না ইত্যাদি তৈরি করে।
শুধু সম্মোহনেই শেষ হয়নি তখনকার ‘লাগ ভেলকি।’ পঞ্চাশের দশকেই রয়েছে সর্পরাজ্যের জাদু-পানীয়ের খবর। নাম অনন্ত শক্তি সালসা। প্রোপ্রাইটার: এ কে নাগ! ঠিকানা কলকাতার নির্মল চন্দ্র স্ট্রিট। বিজ্ঞাপনী ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ‘মহাশক্তি সালসা’ খেয়ে জনৈক ষষ্ঠীচরণ হাতিকে কাঁধে তুলে নিয়েছেন, আর এক পায়ে সিংহ দমন করছেন। শিব এসে ভক্তের হাতে ‘মহাশক্তি-বটীকা’-র কৌটো তুলে দিচ্ছেন। এতে দাদ, হাজা, একজিমা, খোস, পাঁচড়া, চুলকানি, গরল, কৃমী, দাঁত কিড়মিড় দূর হয় ও বিকৃত পিত্ত আয়ত্তে থাকে।
পঞ্চাশ থেকে ষাটের বিজ্ঞাপনে অসুখ হইতে সুখে লইয়া যাইবার এমন অজস্র হাতছানি। কারণটা বোধহয় লাগাতার রোগবিমারি, বাঙালির স্বল্প আয় ও অল্প আয়ু, অ্যালোপাথি-র চিরকালীন কড়া দাম। তাই, রাশি রাশি ক্ষতান্তক ঘৃত, শক্তিবিলাস বটী, সারস্বতারিষ্ট, চন্দ্রপ্রভা (ত্বকের ছোপবিনাশক), শিরঃশূলান্তক তৈল, পূযশান্তি (কানের পুঁজের জন্য), কৃমীঘাতিনী, যকৃৎকল্যাণ, চক্ষুরক্ষক পদ্মমধু, প্রমায়ুকল্যাণ বটী, রক্তগজন্তানাশক। আদ্ধেকের গুণপনা নামেই মালুম, অন্যগুলি উচ্চারণমাত্র রোগবাছাধন পাড়াছাড়া! হ্যাঁ, সে চেষ্টায় দাঁত কিঞ্চিৎ নড়ে যেতে পারে। তখন ‘রোজ টুথপাউডার’-এ মঞ্জন করলেই দন্তক্ষয় রোধ হবে। ‘সডাকে ৬টী লইলে টুথব্রাস ফ্রি’।
ষাটের দশকের শেষাশেষি, পাতায় বিরাট বোতল কোনাকুনি শুয়ে। ঢাকা আয়ুর্ব্বেদিকের জগদ্বিখ্যাত ‘মৃতসঞ্জীবনী সুধা’। সঙ্গে দুর্বোধ্য ছবি। কালীয়দমন, শিশুপালবধ, কিংবা দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, যা খুশি ভাবা চলে। ক্যাপশনে বোঝা গেল, ছবির দিব্যপুরুষটি কৃষ্ণ নন, যমরাজ। আশীর্বাদের মধ্য দিয়ে বিজলিতরঙ্গ পাঠাচ্ছেন। তাতে এঁকিয়ে বেঁকিয়ে বেঁটে মোটা অক্ষরে লেখা ‘ইলেকট্রিক সলিউশন’। নীচে যেটাকে ভয়ানক জগঝম্প ভেবেছিলাম, আদতে সেটা রোগীর শোকবিছানা, তাঁকে ঘিরে সকলে বিমর্ষ দাঁড়িয়ে। পাশে থরোথরো হেডিং— মরা মানুষ বাঁচাইবার উপায়। তার নীচে খুদি খুদি অক্ষরে, ‘ইতি গজঃ’ ভঙ্গিতে— ‘যদিও অদ্যাপি প্রকৃত মরা মানুষ বাঁচাইবার কোনও ঔষধ আবিষ্কৃত হয় নাই সত্য। তথাপি যাঁহারা জ্যান্তে মরা হইয়া আছেন, তাঁহাদের জন্য অব্যর্থ...’ বিজ্ঞাপনী কায়দাতেই ইলেকট্রিক শক খেতে হয়!
আর এক রকম সুখের তো এক্কেরে হাট বসেছে হাতে পাঁজি মঙ্গলবারে। সে সব অবশ্য বেশ পুরুষতান্ত্রিক। মিছেই আজকালকার খুল্লমখুল্লা বিজ্ঞাপনের নিন্দামন্দ। পাতায় পাতায় কুহকিনী, হুরপরিদের সন্ধান। বিশেষাঙ্গ পুষ্টিবর্ধক তৈল। শয়নশাস্ত্র (‘বিজ্ঞাপনে পুস্তকের মূল রহস্যের পরিচয় দেওয়া অসম্ভব। মধুর দৃশ্য দেখিতে চাহিলে এক সেট ফোটোকার্ডের জন্য লিখুন’)। বটতলার বই, অ্যাডাল্ট উপন্যাস। ‘অভিশপ্তা ঊর্বশী’। ‘হাসিরাশি দেবীর লেখা নিষ্প্রদীপা। বলিষ্ঠ প্রেমমধুর উপন্যাস আগে কখনও পড়েননি।’
পঞ্জিকা উবাচ, মধুর মানেই শৃঙ্গার। রোমান্স আরও জমাট করবে ঐন্দ্রজালিক সুগন্ধি। ‘যাঁহাকে চান তাঁহার নিকট কয়েক ফোঁটা ফেলিয়া দিলেই আপনাকে ভালবাসিতে শুরু করিবেন।’ তবে সেরার সেরা হল আজব আয়না। তাতে মৃত আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলা যায়। ভবিষ্যৎ জানা যায়। সঙ্গে মেলে ফরাসি রমণীদের ছবি।
ষাট আর সত্তরের পাঁজিতে পদে পদে বিপদ। প্রথমে ‘ইনফেন্ট টাইমপিস’। হায় রে, ইংরেজির চাঁদ ধরার আশা! বিলিতি নাম, না বুঝেই অর্ডার দিয়ে লোকে হাতে পেতেন শিশুর খেলনা। সে বুজরুকি ধরা পড়লে চলল টয় রিস্টওয়াচ, একে একে ডামি ওয়ালক্লক, মিউট রিস্টওয়াচ। অতঃপর ছ’ঘরার পিস্তল। ‘সম্পত্তি ও জীবনরক্ষার জন্য এমন ভাল হাতিয়ার আর পাইবেন না। চোর-ডাকাত ধরা পড়ে। বনের জীবজন্তু সভয়ে পলায়ন করে। এবং, অবিকল আসল পিস্তলের মতো আওয়াজ!’ সাংঘাতিক সেই সময়েই বেরিয়েছিল ‘ছারপোকা মারার যন্ত্র।’ সেই যে, শিবরাম চক্রবর্তী মশাই টাকা পাঠিয়ে বসে রইলেন। সুদৃশ্য মোড়কে বন্দি হয়ে, ঘরে এল দুটি চকচকে চৌকোনো কাঠ। সঙ্গে নির্দেশ, ছারপোকাটি সযত্নে রেখে, উপরের কাঠ দিয়ে নীচের কাঠে চাপ দিন। বিফলে মূল্য ফেরত।
বিফলমনোরথ হতে শুরু করলাম ওই সত্তরেরই শেষে। রত্নগুহা শেষ হয়ে আসছে, অদ্ভুতলোক পিছু হটছে, দেশের দারিদ্র আর দরকারটা বেরিয়ে আসছে বিজ্ঞাপনে। ফসলের বীজ, হাতপাম্প, সেলাই মেশিন, জোরদার টর্চের খবরাখবর।
চমক আছে তখনও। দুর্গাপুজোর নির্ঘণ্ট ছাড়াও মহরমের তাজিয়ার বিবরণী, ফকিরবাবার কবচ আর বড়দিনের বিজ্ঞাপন। ধর্মের সীমানাটাকে মুছতে পেরেছে পোকায় কাটা এই সব পঞ্জিকা!
আবার, এই সময় থেকেই জাতির কাঁধে জাঁকিয়ে বসছে ক্রিকেট আর সিনেমা। বাড়ছে খেলার সরঞ্জামের বিকিকিনি আর চিত্রতারকার মতো রূপলাবণ্যের প্রসাধন। নামগুলোও চমৎকার। পারুল মাতোয়ারা এসেন্স (যার বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে বাজারে নকল বেরিয়েছে), প্যারিস হেয়ার কার্লিং লোশন (তিন দিনেই চুল কোঁকড়াইতে শুরু করে ও প্রত্যহ স্নান করিলেও নষ্ট হয় না। বম্বের তারকারা ব্যবহার করেন)।
আশি আসতেই হাজির চেনা বেনারসির দোকান, গয়নাপট্টি। বিজ্ঞাপনে রং ক্রমে বেড়ে যায়। রিমলেস চশমা এঁটে কেতাদুরস্ত জ্যোতিষসম্রাট হোয়াটস্অ্যাপ আর ফেসবুক পেজের কনট্যাক্ট দেন। কিন্তু কিস্তি মাত করে সেই পুরনো ব্লকপ্রিন্টিংয়ের সাদা-কালো বিজ্ঞাপন। সেখানে অসুখ সারাতে, অশ্বিনীকুমারদ্বয় নিয়ে আসেন জ্বরারিসুধা। ‘ম্যাজিসিয়ান অ্যান্ড ফ্রেন্ডস’-দের চিঠি লিখে শেখা যায় কাটা মুন্ডু জোড়া লাগানোর ভেলকিবিদ্যা।
পুরনো পঞ্জিকার ভাণ্ডারে আছে আরও গুপ্তধন। কোন নার্সারিতে পাওয়া যাবে লাল বর্ষাতি মুলো আর মাখনের মতো নরম ফুলকপি? সব মিলিয়ে, পুরনো, হলদেটে এই সব বিজ্ঞাপন আজও এক জাদু-চশমা। বাঙালির ফেলে-আসা সময় ও সমাজ প্রতিনিয়ত ধরা দেয় সেখানে।