নিজের মিউজিয়াম তৈরি করে গিয়েছেন কবি

দেশ ছেড়ে আমেরিকা চলে গিয়েছিলেন আড়াই দশক আগে। সেখানেই মারা গেলেন গত ১ এপ্রিল। তবু এভগেনি এভতুশিয়েনকো আজও রুশ কবিতার উজ্জ্বল উদ্ধার। অরুণ সোমদেশ ছেড়ে আমেরিকা চলে গিয়েছিলেন আড়াই দশক আগে। সেখানেই মারা গেলেন গত ১ এপ্রিল। তবু এভগেনি এভতুশিয়েনকো আজও রুশ কবিতার উজ্জ্বল উদ্ধার। অরুণ সোম

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৭ ০০:০৮
Share:

সময়টা ঠিক মনে নেই। বোধহয় ১৯৬৭-’৬৮ সাল। মস্কোর সাহিত্যভবনে শুনেছিলাম এভগিয়েনি এভতুশিয়েনকোর কণ্ঠে, তাঁর ‘বাবি ইয়ার’ কবিতা: ‘বাবি ইয়ারের মাথায়/ স্মৃতিস্তম্ভ নেই কোনও/ খাড়া পাড় সোজা/ নেমে গেছে নীচে/... দেখে ভয় হয়, মনে হয় বুঝি/ ইহুদি জাতির মতো আমিও নিজেই/ বুড়ো হয়ে গেছি।’ প্রতিটি শব্দে ফুটে উঠছিল ট্রাজেডির দৃশ্য।

Advertisement

বাবি ইয়ার ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের একটি গভীর খাত। ১৯৪১-এর ২৯-৩০ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে অভিযানে নাত্‌সিরা এই অঞ্চলে স্থানীয় অধিবাসী ও পুলিশের সহায়তায় ৩৩,৭৭১ জন ইহুদিকে হত্যা করে ওই খাতে ফেলে দেয়। এত অল্প সময়ে, এক দফায় এত বেশি সংখ্যক ইহুদি নিধনের ঘটনা আর কোথাও ঘটেনি। ঘটনাটি স্পর্শকাতর, স্থানীয় অধিবাসীরা এতে জড়িত ছিল। ফলে সোভিয়েত আমলে এর উল্লেখও ট্যাবু ছিল।

১৯৬১ সালে এভতুশিয়েনকোর এই কবিতা প্রকাশের পরই ঝড়। ইহুদি-বিদ্বেষকে প্রশ্রয় দেওয়ায় কবি সোভিয়েত কর্তৃপক্ষের শুধু নিন্দাই করেননি। আরও বলেছেন, এই গোপনীয়তার অর্থ নিজেদের স্বার্থে ইতিহাসের বিকৃতি। ক্রুশ্চেভের আমলে সোভিয়েত প্রতিক্রিয়া? পার্টি নেতৃত্ব জানাল, রাজনৈতিক অপরিপক্বতা। রাজনৈতিক বোধের অভাবেই নাকি কবি দুনিয়ার অন্য নাত্‌সি শিকারের কথা বলেননি, বিচ্ছিন্ন ভাবে ‘বাবি ইয়ার’-এর কথা বলেই ছেড়ে দিয়েছেন।

Advertisement

এই কবিতাই তাঁকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি দিল। এর ভিত্তিতেই সিম্ফনি রচনা করলেন সুরকার দ্‌মিত্রি সাস্তাকোভিচ। বিশ্বের ৭২টি ভাষায় অনূদিত হল ‘বাবি ইয়ার’। কবিতার কয়েকটি লাইন খোদাই করে রাখা হল আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি-র হলোকস্ট মিউজিয়াম-এর দেওয়ালেও। প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরই এভতুশিয়েনকোকে করে তুলল রুশ কবিতার ‘অ্যাংগ্রি ইয়াং ম্যান।’

কিন্তু শাসকের রাজনীতি অন্য রকম। দেশে উদারনীতির হাওয়া বইতে শুরু করেছে, দেখানোর জন্য ক্রুশ্চেভের আমলে বারবার এই ‘রাগী ছোকরা’কে বিদেশ সফরে উৎসাহ দেওয়া হয়। ঘন ঘন বিদেশে যাতায়াতে কবি তখন সরকারের প্রায় প্রতিনিধিস্বরূপ। এখানেই পূর্বসূরি মায়াকোভ্‌স্কির সঙ্গে তাঁর তফাত। মায়াকোভ্‌স্কির পক্ষে ‘রাগী ছোকরা’র ভূমিকা এবং একই সঙ্গে ‘রুশ প্রলেতারীয় লেখক সমিতি’-র নেকনজরে থাকা সম্ভব ছিল না, সোভিয়েত সাহিত্যের উপদলীয় কোন্দলে পড়ে শেষে আত্মবলি দিতে হয় তাঁকে। এভতুশিয়েনকো পরের প্রজন্মের, মেজাজ-মর্জি অন্য রকম।

ফের দুঃসাহসের পরিচয়। ১৯৬৩-র ফেব্রুয়ারিতে বেরল তাঁর আত্মজীবনী। বিদেশ সফরে গিয়ে কবি যে সব সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, তারই ভিত্তিতে স্মৃতিকথা। একে সোভিয়েত সরকারের বিনা অনুমতিতে সাক্ষাৎকার, উপরন্তু কমিউনিস্ট যুবসংঘ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য। ফের সরকারি সমালোচনার ঝড়। এভতুশিয়েনকো পাকা রাজনীতিবিদের মতো সেই সব লেখার দায়িত্ব অস্বীকার করলেন। পরে ‘ব্রাত্‌স্ক জলবিদ্যুৎকেন্দ্র’ ‘স্ট্যাচু অব লিবার্টির অন্তরালে’-র মতো রাজনৈতিক প্রচারধর্মী কবিতা রচনা করে সরকারের ক্ষতি পূরণ করলেন। কবিদের বুঝতে পারা সত্যিই মুশকিল!

নইলে এত সম্মান পেয়েও কেন শেষ অবধি ইয়েল্‌তসিনের আমলে সপরিবার দেশ ছেড়ে পাড়ি জমালেন আমেরিকায়? অভিমান? হয়তো না। সোভিয়েত আমল থেকে গরবাচেভ, ইয়েল্‌তসিনের সময়েও তিনি হরেক রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার আগেও, ১৯৮৭ থেকে ’৯১ অবধি সোভিয়েত পার্লামেন্টের সদস্য। প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থেকেই সুযোগ বুঝে কখনও প্রতিবাদী, কখনও নীরব।

ভাঙনকালে সবই অনিশ্চিত। নব্বইয়ের দশকে তাই বিদেশে আশ্রয় নেওয়াটাই বেছে নিলেন। ভুল করেননি। এভতুশিয়েনকো দেশ ছাড়লেন, কয়েক বছর পর স্বদেশে ফিরে এলেন সলঝেনিতসিন। কিন্তু কয়েক বছর পর মস্কোয় বসে তাঁকে আক্ষেপ করতে হল, ‘আজ আর কথা বলতে কোনও বাধা নেই, কিন্তু কথা শোনার লোকের বড় অভাব।’ এভতুশিয়েনকো নন, সলঝেনিতসিন-ই সে দিন দেশে ফিরে ভুল করেছিলেন।

এভতুশিয়েনকো বিদেশে থাকেন, কিন্তু প্রায়ই দেশে আসেন, কাগজে সাক্ষাৎকার দেন। তাঁর ধারণা, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে নতুন সমাজব্যবস্থা চালু হওয়ার পর রুশ কাব্যজগতে ঘোর সঙ্কট। ‘রাশিয়ায় এক জন কবি কবির চেয়েও বড়: রুশ কাব্যের দশ শতাব্দী’ নামে হাজার বছরের রুশ কবিতার এক সুবিশাল সংকলনও তিনি বিদেশে বসেই সম্পাদনা করেছেন।

২০১০ সালে মস্কোর কাছে তাঁর নিজের মিউজিয়াম উদ্বোধন করে গিয়েছেন কবি। সেখানেই সংরক্ষিত তাঁর পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্র। আমেরিকা থেকে তাঁর মরদেহ সেখানে এনে সমাহিত করা হবে। গত পয়লা এপ্রিল আমেরিকায় মৃত্যু, তার আগে এ ভাবেই নিজের ব্যবস্থা করে গিয়েছেন। তিনি তো আর আত্মঘাতী মায়াকোভস্কি নন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন