বিচার

তখনও ক্যামেরার কথা ভাবতাম না, এখনও না

সেটা সত্তরের দশকের মাঝামাঝি। সরকারি চাকরি করি। এর পাশাপাশি রেডিয়োতে চুটিয়ে নাটক। আমাকে বলাই হত রেডিয়োর ঘরজামাই। সে সময় অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর স্টেশন ডিরেক্টর ছিলেন সূর্যবাবু। পুরো নাম খুব সম্ভবত সূর্য সরকার। এক দিন আমি আর অজিতদা, মানে অজিত গঙ্গোপাধ্যায়, রেডিয়োতে একটা নাটক শুনছি অজিতদারই ঘরে বসে।

Advertisement

পরান বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০৩
Share:

‘চেনা অচেনা’ ছবির দৃশ্য। প্রথম ছবি নয়, কিন্তু এটা দিয়েই ‘কেরিয়ার’ শুরু।

সেটা সত্তরের দশকের মাঝামাঝি। সরকারি চাকরি করি। এর পাশাপাশি রেডিয়োতে চুটিয়ে নাটক। আমাকে বলাই হত রেডিয়োর ঘরজামাই। সে সময় অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর স্টেশন ডিরেক্টর ছিলেন সূর্যবাবু। পুরো নাম খুব সম্ভবত সূর্য সরকার।

Advertisement

এক দিন আমি আর অজিতদা, মানে অজিত গঙ্গোপাধ্যায়, রেডিয়োতে একটা নাটক শুনছি অজিতদারই ঘরে বসে। গ্রামবাংলার পটভূমিতে নাটক। নাটকটা সূর্যদার লেখা। সূর্যদা তখন গ্রামবাংলা নিয়ে ভাল নাটক লিখতেন, সেগুলো রেডিয়োতেও হত। অন্য দিকে, অজিতদাও গ্রামবাংলাকে খুব ভালবাসতেন। লোক-আঙ্গিকের প্রতি তাঁর একটা বিরাট আকর্ষণ ছিল। তা, এ নাটকটা শুনে অজিতদার বেশ ভাল লাগল। আমাকে বললেন, পরান, শোনো, কাল সূর্যবাবুকে গিয়ে অবশ্যই বলবে, এই নাটকটা থেকে আমি ছবি করব। উনি যেন এ নাটকের স্বত্ব অন্য কাউকে না দিয়ে দেন।

পরের দিন কিছু কাজ পড়ে যাওয়ায়, আমি এক দিন পর সূর্যবাবুকে অজিতদার কথা বললাম। সূর্যবাবু রাজি হলেন। তার পর অজিতদা এসে সূর্যবাবুর সঙ্গে কথা বলেন। সূর্যবাবু এ বার বললেন, আমি স্বত্বটা তোমায় দিতে পারি। কিন্তু একটা শর্ত আছে। পরানকে এ ছবিতে নিতে হবে। ভারী লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলাম তখন। শুনলাম অজিতদা বলছেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, ওকে তো নেবই। ও তো খুব ভাল অভিনেতা।

Advertisement

এই আমার প্রথম ছবির জগতে আসা। সিনেমায় নামার সে রকম কোনও স্বপ্ন বা ইচ্ছে ছিল না। বলতে গেলে এই শর্ত পূরণ করতে এক রকম কোনও মানসিক প্রস্তুতি ছাড়াই হঠাৎ করেই ছবিতে নেমে পড়লাম। সে ছবির নাম ‘বিচার’। পরিচালক, অজিত গঙ্গোপাধ্যায়। সন্তুর (মুখোপাধ্যায়) তখন খুব কম বয়স। সে-ই ছবির হিরো। মনুদাও (মুখোপাধ্যায়) ছিলেন ছবিতে।

আমি এক জন সুদখোরের রোল করেছিলাম। খুব মজার চরিত্র। যাকে টাকা ধার দিচ্ছি, সে সময়মত সুদটা দিতে পারছে না, ফের টাকা ধার করতে এসেছে। তাকে বাজে পরামর্শ দেওয়া, সন্তুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র— এই সবই ছিল আমার কাজ। চরিত্রটা আমার বেশ পছন্দের ছিল।

আমি তো থিয়েটারের মানুষ। রেডিয়োতে অভিনয় করে অভ্যস্ত। সুতরাং, ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানোর আগে নিজেকে বেশ করে একটা কথা বুঝিয়েছিলাম, অ্যাক্টিং ছাড়া আমি আর অন্য কিছু নিয়েই মাথা ঘামাব না। বাকিটা যাঁরা ক্যামেরায় আছেন, আলোয় আছেন, তাঁদের চিন্তা। আমি ফ্রেমের বাইরে চলে গেলাম, কি ভেতরে রইলাম, আলো কম নিলাম, না বেশি নিলাম— এই সব জিনিস নিয়ে ওঁরা ভাববেন। ওটা আমার ভাবনা নয়। আমার যা কাজ, সেটা আমি মনপ্রাণ ঢেলে করব।

আমি কিন্তু এখনও অভিনয় করার সময় এটা মেনে চলি। শুধুমাত্র নিজের অভিনয়েই মন দিই। বাকিটার জন্য তো পরিচালক আছেন। তিনিই করিয়ে নেবেন। মনে আছে, ছবিটা তোলার সময় যে ক’টা দৃশ্যে শট টেকিং হয়েছে, তার একটাও ‘এন জি’ হয়নি। আশ্চর্যজনক ভাবে, ওঁদেরও সে সময় কোনও টেকনিকাল ফল্ট হয়নি। সেটা হলেও তো একটা ‘এন জি’ হত, মানে, যন্ত্রের ‘এন জি’। কিন্তু সে সবও হয়নি। ফলে সব ক’টা সিনই ফার্স্ট টেক ওকে। অজিতদা তো ভীষণ খুশি। এসে আমার পিঠ চাপড়ে দিলেন। বললেন, ‘আমি ভাবতে পারিনি পরান, তুমি এ ভাবে উতরে দেবে।’ আমি আর কী বলব, বললাম, সবই আপনাদের আশীর্বাদ, ভালবাসা এই আর কী! অজিতদার এর পরের ছবি ‘হংসরাজ’, অরিন্দমকে নিয়ে। অরিন্দম তখন ছোট্ট ছেলে। চমৎকার গানের গলা। এই ছবিতে আমি অবশ্য অভিনয় করিনি। তবে ছবির প্রচারের কাজে অজিতদার সঙ্গে ছিলাম পুরোদমে।

‘বিচার’, মানে যে ছবিটার কথা বলছিলাম, তার পটভূমি গ্রাম। তাই শুটিংয়ের জন্য খুব সম্ভবত বারুইপুরের কাছাকাছি কোনও একটা জায়গা বেছে নেওয়া হয়েছিল। তখন ও দিকটায় বেশ জঙ্গলটঙ্গল ছিল। জায়গাটার নাম অবশ্য এখন আর মনে নেই। মেঠো জায়গা, গ্রামের বাড়ি, সামনে মাঠ, তার পর জঙ্গল। সেখানে একটা দৌড়ের দৃশ্য তোলা হবে। আমিও সেই দৌড়নোর দলে ছিলাম। আর ছিলেন এক ভদ্রলোক, তাঁকে তাড়া করা হবে। তাঁর বোধহয় হার্টের কোনও সমস্যা ছিল। তার ওপর বেশ ভারী চেহারা। তিনি খালি পিছিয়ে পড়েন। একটু বকুনিও খেলেন সে জন্য। এ বার তিনি তাড়াতাড়ি করে যেতে গিয়ে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। দেখে আমরা ক’জন একটু-আধটু কষ্ট পেলেও বাকিরা কিন্তু হেসে কুটোপাটি। তবে, এই বয়সে এসে ঘটনাটার কথা মনে পড়লে একটুও মজা হয় না, বরং কষ্টই হয়।

ছবির গল্পটা নেহাতই মামুলি। কোনও চমক নেই। গ্রামবাংলার গড়পড়তা গল্পে যেমন হয়— এক দল শোষিত, আর এক দল অত্যাচারী, গরিব মানুষদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের শোষণ করে। তারই মধ্যে এক জন সুন্দর, সুস্থ, সবল, শিক্ষিত যুবক, মানুষের জন্য যার দরদ আছে, সে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়, তার পর সেই যুবকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়। শেষে সমস্ত গ্রামের মানুষ একত্রিত হয়ে সেই অত্যাচারীদের তাড়া করে। তবে, চরিত্রগুলোর মধ্যে মজা ছিল। গল্পের মধ্যে গ্রামের মানুষের খুশি হওয়ার রসদও ছিল প্রচুর। কারণ এটা তাদের জীবন থেকে তুলে আনা ছবি। ফলে গল্পের সঙ্গে তারা অনেক বেশি একাত্ম হতে পেরেছিল। তখন সবে টেলিভিশন আসছে। ছবিকে কেন্দ্র করে মিডিয়ায় প্রচার করার এমন রমরমা ব্যবস্থাও তখন কোথায়! স্পনসরের ব্যাপারগুলোও তখন এমন দানা বাঁধেনি। সুতরাং, প্রায় কোনও প্রচার ছাড়াই ছবিটা গ্রামের দিকে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।

এর পরের ছবি করতে আমার বেশ কিছু দিন সময় লেগেছিল। আমার দ্বিতীয় ছবির নাম ‘চেনা অচেনা’। ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের মতো অভিনেতারা সেখানে অভিনয় করেছিলেন। আর আমি ছিলাম এক জন ঘুষখোর পুলিশ অফিসারের ভূমিকায়। এই সুদখোর আর ঘুষখোর চরিত্রদের হাত ধরেই আমার পুরোদস্তুর অভিনয়-জীবনে পা রাখার শুরু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন