একদিন প্রতিদিন

ভুরু দেখে আঁতকে উঠলেন মৃণাল সেন

আমার প্রথম শুটিং ‘পরশুরাম’। কিন্তু প্রথম মুক্তি-পাওয়া ছবি ‘একদিন প্রতিদিন’। দুটোই মৃণাল সেনের ছবি। পরশুরাম-এর জন্য তখন মৃণাল সেন নতুন মুখ খুঁজছেন। গীতা সেন-এর ওপর ভার দিয়েছিলেন একটা নতুন মেয়ে খুঁজতে। তত দিনে আমি রেডিয়োতে মাইক্রোফোনের সামনে কাজ করায় বেশ অভ্যস্ত। বিজ্ঞাপনের কাজ করেছি, শিশুশিল্পী হিসেবে ছড়া বলেছি। এগুলো করতে করতেই আমি যোগ দিয়েছিলাম গ্রুপ থিয়েটারে।

Advertisement

শ্রীলা মজুমদার

শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:০৩
Share:

আমার প্রথম শুটিং ‘পরশুরাম’। কিন্তু প্রথম মুক্তি-পাওয়া ছবি ‘একদিন প্রতিদিন’। দুটোই মৃণাল সেনের ছবি। পরশুরাম-এর জন্য তখন মৃণাল সেন নতুন মুখ খুঁজছেন। গীতা সেন-এর ওপর ভার দিয়েছিলেন একটা নতুন মেয়ে খুঁজতে। তত দিনে আমি রেডিয়োতে মাইক্রোফোনের সামনে কাজ করায় বেশ অভ্যস্ত। বিজ্ঞাপনের কাজ করেছি, শিশুশিল্পী হিসেবে ছড়া বলেছি। এগুলো করতে করতেই আমি যোগ দিয়েছিলাম গ্রুপ থিয়েটারে। ওই সময়ই রেডিয়োতে ‘আত্মজা’ নামে একটি নাটক করেছিলাম। আধুনিক নাটক। আমার তখন অল্প বয়স। চরিত্রটাও আমার বয়সেরই উপযোগী। তার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। মেয়েটা বাবার কাছেই থাকত। এক বার দিন সাতেকের জন্য বাবা তাকে তার মায়ের কাছে রেখে কোথাও একটা যান। আর সে এই সাত দিনে মায়ের সঙ্গে তুমুল অসভ্যতা করে। মা একেবারে অস্থির হয়ে পড়েন। আসলে মায়ের ওপর একটা প্রচণ্ড রাগ থেকেই সে এমন করত। এক দিন তিতিবিরক্ত হয়ে মা তাকে বলেন যে, সে কি জানে বাবা কোথায় গেছে? বাবা তাকে রেখে বিয়ে করতে গেছে। তখন মেয়েটির মধ্যে একটা অদ্ভুত চেঞ্জ আসে।

Advertisement

এই নাটক শুনেই গীতা সেনের আমাকে পছন্দ হয়। জগন্নাথ বসু তখন অল ইন্ডিয়া রেডিয়োর ড্রামা প্রোডিউসার। ‘আত্মজা’ তাঁরই পরিচালনা। মৃণাল সেন সরাসরি তাঁকে ফোন করেন এবং পুরো নাটকটা শোনেন। তার পর নিজের ছবির জন্য আমাকে পছন্দও করে ফেলেন। কিন্তু তার আগে তো আমায় দেখতে হবে। ঠিক হয়, তিনি রিহার্সাল রুমে এসে আমাকে দেখবেন। সে দিন আমি যথারীতি লেট। রিহার্সাল রুমে এসে দেখি কানায় কানায় ভর্তি। আর এক জন রোগা, পাজামা-পাঞ্জাবি পরা মানুষ দরজার দিকে পিঠ করে বসে আছেন। আমি তখন মৃণাল সেনকে চিনি না। সে ভাবে ছবি-টবি দেখি না তো! উনি আমাকে বললেন, আমি একটা ছবি করব, তোমাকে নিতে চাই। হঠাৎ আমার ভুরুর দিকে ওঁর চোখ পড়ল। সেটি যত্ন করে প্লাক করা। উনি আঁতকে উঠলেন। সেই সঙ্গে বাকিরাও। শ্রীলার বোধহয় আর চান্স পাওয়া হল না। মৃণালবাবু বললেন, ‘আমি ইয়াং ম্যান হলে কিছুতেই তোমার প্রেমে পড়তাম না। কারণ তুমি ভুরু প্লাক করেছ। এ সব তো কবেকার রেওয়াজ। এখনকার মেয়ে হয়ে তুমি এই সব করেছ?’ আসলে পরশুরাম-এর চরিত্রটার ছিল নো-মেকআপ লুক। সেখানে ভুরু প্লাক! তবে ছবি শুরু অবধি যতটা সময় পেয়েছিলাম, তাতে আমার ভুরু সুন্দর ভাবে তার নিজের চেহারা ফিরে পেয়েছিল।

আশ্চর্যের ব্যাপার হল, ‘আত্মজা’য় আমার চরিত্রটার সঙ্গে কিন্তু পরশুরাম-এর চরিত্রের কোনও মিল নেই। পরশুরাম-এর মেয়েটা একটা ছিন্নমূল মেয়ে। এক প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগের রাতে আরও অনেক মানুষের সঙ্গে সে-ও একটা কবরখানায় আশ্রয় নেয়। তার পর আবার ও ভাবেই চলে যায়। সে ভাবে দেখলে চরিত্র দুটো সম্পূর্ণ বিপরীত। জামাকাপড়, হাবভাব, কথা বলার ভঙ্গি— সমস্ত কিছুই একদম আলাদা। তা-ও মৃণাল সেন ওই ছিন্নমূল মেয়েটার জন্যই আমাকে বেছে নিলেন। কারণ এই চরিত্রের জন্য তাঁর এমন একটা মেয়ের দরকার ছিল যার বয়স খুব কম, সুন্দর দুটো চোখ, রোগা-ছিপছিপে গড়ন আর গায়ের রং কালো। এতগুলো জিনিসের প্রত্যেকটাই তিনি আমার মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন।

Advertisement

পরশুরাম-এর শুটিং খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এইটুকু সময়ের মধ্যেই আমি বেড়ে উঠি শিখতে শিখতে, জানতে জানতে। গ্রুপ থিয়েটারের ছোট্ট পরিসর থেকে চলচ্চিত্রের বিরাট পরিসরে পা রাখা। থিয়েটার আর ফিল্ম যে একেবারে আলাদা জগৎ, সেটা বুঝেছি এই শুটিং করতে করতেই। এর পরই শুরু হয় ‘একদিন প্রতিদিন’-এর শুটিং। উনি আমাকে ডেকে বললেন, ‘তোমাকে তো নেব না। তোমার কোনও চেনা মেয়ে থাকলে বলো।’ তার পর যত বারই দেখা হয়, তত বারই বলেন, ‘আরে তোমাকে একটা মেয়ে দেখতে বলেছিলাম না!’ আর আমিও বলে যাই, ‘না না, ও সব হবে না। ওই রোলটা আমার চাই।’ উনি উত্তরে বলতেন, ‘অসম্ভব, আমার একটা ফরসা মেয়ে দরকার। তোমার মতো কালো নয়।’ যাই হোক, রোলটা পেলাম। আর মজার ব্যাপার হল, ওখানে আমার একটা ডায়ালগ ছিল, যেখানে আমার দিদিকে সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না, পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে, পুলিশ বাড়িতে এসেছে খোঁজখবর করতে, আর আমি পুলিশকে বলছি, ‘আমার দিদি কিন্তু ফরসা। আমার মতো কালো নয়।’

প্রত্যেকটা শট দেওয়ার আগে নিজেদের মধ্যে এক বার রিহার্সাল দিয়ে নেওয়ার একটা রেওয়াজ আমাদের ছিল। তার পর যখন অরিজিনালটা শুট করছি, তখন মাঝেমধ্যেই পরিচালক বলে উঠতেন, ‘আরে ওটা এক বার করো তো! ওই যে, একটু আগে রিহার্সালের সময় যেটা করছিলে।’ বুঝতে পারতাম, আমাদের রিহার্সালের মুহূর্তগুলোও উনি নজর করেছেন। আবার নিজে যখন কিছু দেখাতেন, তখন গোড়াতেই বলে নিতেন, ‘আমি কিন্তু অ্যাক্টর নই। আমি শুধু তোমাদের একটু দেখিয়ে দিচ্ছি।’ কিন্তু কেন জানি না, ওঁর দেখিয়ে দেওয়া অভিনয়টাই আমার চোখে সেরা অভিনয় হয়ে উঠত।

‘একদিন প্রতিদিন’ গল্পের বিষয় ছিল— এক জন চাকরিরতা মেয়ে অনেক রাতেও বাড়ি ফিরছে না। মধ্য কলকাতার একটা ঘিঞ্জি পাঁচ ভাড়াটের বাড়ি। অযথা কৌতূহল, কথা চালাচালি। আমি একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম ‘একদিন প্রতিদিন’ যেন ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র একটা এক্সটেনশন। সেই মেয়েদের লড়াইয়ের গল্প। আজকের দিনেও যে ছবিটা ভীষণ প্রাসঙ্গিক। নারী স্বাধীনতার যুগ। অথচ আজও একটা মেয়েকে রেপ্ড হতে হয়। রাত দুটোর সময় তার একা ফেরার অধিকার নেই। ওই ছবিতেও আমার দিদি বাড়ি ফেরেনি।

ছ’টা ছবি করেছি আমি মৃণাল সেনের সঙ্গে। পরিচালক মৃণাল সেন আর গীতা সেন কখন যেন আমার অভিভাবক হয়ে গিয়েছেন। আজও সম্পর্কটা একই রকম রয়ে গেছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement