খালি হাতে বাঘ মেরেছিলেন

বী রদের কথা পুঁথিপত্রে পড়েছি বটে, কিন্তু বাস্তবে বড় একটা দেখিনি। এখন বীরদের জায়গা নিয়েছে গুন্ডা-মস্তানরা, দেখে বড়ই হতাশ হতে হয়। তবু ভাগ্য ভাল যে, জীবনে অন্তত এক জন বীরোচিত মানুষকে দেখেছিলাম। তখন আমার বয়স নয় বা দশ হবে। বাবা দোমোহানিতে বদলি হয়ে এসেছেন। সে একটা ভারী পরিচ্ছন্ন রেল শহর। রেলের বড় বড় অফিসারদের বাস। অন্য ধারে একটা গঞ্জ শহরও আছে বটে।

Advertisement

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৫ ০১:১৭
Share:

বী রদের কথা পুঁথিপত্রে পড়েছি বটে, কিন্তু বাস্তবে বড় একটা দেখিনি। এখন বীরদের জায়গা নিয়েছে গুন্ডা-মস্তানরা, দেখে বড়ই হতাশ হতে হয়। তবু ভাগ্য ভাল যে, জীবনে অন্তত এক জন বীরোচিত মানুষকে দেখেছিলাম।

Advertisement

তখন আমার বয়স নয় বা দশ হবে। বাবা দোমোহানিতে বদলি হয়ে এসেছেন। সে একটা ভারী পরিচ্ছন্ন রেল শহর। রেলের বড় বড় অফিসারদের বাস। অন্য ধারে একটা গঞ্জ শহরও আছে বটে। রেল কলোনির রাস্তাঘাট ভারী ভাল। বিস্তর লিচুগাছ এবং শহরের উপকণ্ঠে বাঘের জঙ্গল। বাঘের উৎপাতও খুব। দোমোহানির কাছেই বীণাগুড়ি চা-বাগানে আমার সেজো মামা চাকরি করতেন। মাঝে মাঝে যেতাম। এক দিন যেতেই মামি বললেন, জানিস কাল কী হয়েছে? রান্নাঘরে রাঁধছিলুম, কুকুরটা দরজার বাইরে বসে ছিল। হঠাৎ ঘ্যাঁক করে একটা শব্দ হল। তাড়াতাড়ি হ্যারিকেন হাতে বেরিয়ে দেখি, ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ে আছে, আর বাঘের পায়ের ছাপ!

ছবি: সুমন চৌধুরী।

Advertisement

রেল কোয়ার্টারে আমাদের প্রায় প্রতিবেশীই ছিলেন শওকত আলী। ছিপছিপে, শ্যামবর্ণ, সুদর্শন। বিয়ে করেননি, একা থাকতেন। সম্ভবত তিনি ছিলেন ডিটিএস অফিসের কেরানি। তাঁর কোয়ার্টারে ঢুকলে গা ছমছম করত। ঘরের দরজা-জানলা বেশির ভাগই বন্ধ, অন্ধকার, আর সেই ঘরে মানুষের করোটি, হাড় এবং নানাবিধ অদ্ভুত সরঞ্জাম ছিল। শুনেছি, তিনি গোপনে কিছু সাধনা-টাধনাও করতেন। ছিলেন অঘোষিত এক জন ম্যাজিশিয়ান। লাঠিখেলা, ছোরাখেলা, জিমন্যাস্টিক্স, এ-সব ছিল তাঁর সহজাত বিদ্যা। আর ওই এলাকায় তাঁর বিপুল খ্যাতি ছিল খালি হাতে বাঘ মারার জন্য। উনি সত্যিই খালি হাতে একটা চিতাবাঘকে গলা টিপে মেরেছিলেন। দোমোহানির আউটার সিগনালের কাছে বাঘের উৎপাত হচ্ছে জেনে রেলের সাহেবসুবো অফিসাররা বন্দুক নিয়ে বাঘ শিকার করতে গিয়েছিলেন, সঙ্গে উনিও। ওঁর বন্দুক ছিল না, গিয়েছিলেন একটা লাঠি নিয়ে। বিটাররা যখন ক্যানেস্তারা পিটিয়ে বাঘকে তাড়িয়ে আনার চেষ্টা করছিল, তখন দুর্ভাগ্যবশত বাঘটা চড়াও হয়েছিল শওকতের ওপরেই। উনি আমাকে বলেছিলেন, ‘জানিস, বাঘটা তেমন বড়সড় ছিল না, বড়জোর একটা ডালকুত্তার সাইজের। আমি ভেবেছিলাম লাঠির ঘায়েই ঘায়েল করতে পারব। কিন্তু বাঘ যে কত ফাস্ট হয়, জানতাম না। আমি লাঠি তোলবার আগেই বিদ্যুতের গতিতে একটা থাবা মেরে লাঠিটা ছিটকে দিল। আমাকে নড়বারও সময় না দিয়ে ঢেউয়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর।’

শওকত আলীর বুকে, পেটে, হাতে বাঘের আঁচড়ের গভীর দাগ দেখেছি। পিঠ তো ফালাফালা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মানুষটার সাহস আর রোখ ছিল অসাধারণ। বাঘের সঙ্গে যুঝে বিপুল রক্তক্ষরণ সত্ত্বেও শেষ অবধি তার গলা টিপে মেরেছিলেন। তাঁর বাঁচার আশা ছিল না। কিন্তু সাহেবসুবোরা এ রকম এক জন সাহসী মানুষকে বাঁচানোর জন্য প্রচণ্ড চেষ্টা করেছিলেন। মিলিটারি হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে, নইলে সেপটিক হয়েই মারা যেতেন। এর পরেও বাঘশিকারীদের সঙ্গী তিনি বহু বার হয়েছেন।

দোমোহানিতে জিম ছিল না। কিন্তু শওকত আলী অনায়াসে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় পিছন দিকে সমারসল্ট খেতে পারতেন। আমাদের লাঠিখেলা, ছোরাখেলা শেখাতেন। বলতেন, ‘বুঝলি, যত ফাস্ট হবি তত অ্যাডভান্টেজ। ফাস্ট, ফাস্টার, ফাস্টেস্ট। দ্রুত গতিই হল আসল শক্তি। বাঘের কাছে আমি ওইটে শিখেছি।’

কোনও বিপদেই ওঁকে কখনও ভয় পেতে দেখিনি। সে বার জলপাইগুড়ি জেল থেকে ভয়ংকর এক খুনি আসামি পালিয়ে এসে দোমোহানি স্টেশনে গা-ঢাকা দিয়ে ছিল। বিশাল চেহারা এবং প্রচণ্ড মারমুখো একটা লোক। নির্জন স্টেশনে তার সন্দেহজনক অবস্থান নিয়ে কয়েক জন কৌতূহল প্রকাশ করেছিল, লোকটা তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে জনা দুয়েককে ছোরার ঘায়ে জখম করে পালাতে থাকে। ছোট্ট জায়গা, খবর রটতে দেরি হয়নি। ভয় পেয়ে গেরস্তরা সব ঘরে গিয়ে দোর দিয়েছিল। খুনিটা রাত করে রেললাইন ধরে হাঁটছিল। যেখানে অ্যাডভেঞ্চার, সেখানেই শওকত আলী। তিনি একা লোকটার পিছু নেন এবং দ্রুত গিয়ে তার সঙ্গ ধরে খুব ভালমানুষের মতো একটা বিড়ি চান। লোকটা তৎক্ষণাৎ ছোরা বের করে ‘বিড়ি লেগা?’ বলে চড়াও হয়। আড়ে বহরে অনেক ছোট শওকত আলী কিন্তু একটুও না ঘাবড়ে সোজা ডাইভ দিয়ে তার কোমর জড়িয়ে ধরে এক ঝটকায় ফেলে দেন। জুডো জিনিসটা কী, তা আমরা তখনও জানিই না। শওকত জানতেন। ওই বিশাল লোকটাকে কাবু করে তিনি তার কবজি ধরে স্টেশনে নিয়ে আসেন। কবজিটা ধরেছিলেন যে কায়দায়, তাকে নাকি বলে জুডো’স থাম্ব লক। সেটা এমন কায়দা যে, হাত ছাড়াতে গেলে নাকি কবজিটা মট করে ভেঙে যাবে।

সে বার এক বিখ্যাত ম্যাজিশিয়ান দোমোহানিতে এসে ম্যাজিক দেখিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। আশ্চর্য সব ম্যাজিক। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হল, পর দিন সেই ম্যাজিশিয়ানের উপস্থিতিতেই শওকত আলী একই স্টেজে সেই সব ম্যাজিক আরও সুন্দর ভাবে দেখালেন। সঙ্গে অনেক নতুন ম্যাজিকও। কিন্তু একটিও পয়সা নিলেন না, বললেন, গুরুর বারণ।

এই আশ্চর্য লোকটির কাছে আমার অনেক কিছু শেখার ছিল। কিন্তু কপাল, বাবা বদলি হয়ে গেলেন। আমরাও চলে গেলাম পূর্ব বঙ্গে। এর কয়েক বছর পর দেশ ভাগ হয়ে গেল। আর দেখা হল না কোনও দিন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন