প্যারিসের ডাক আসতেই হইহই

ডাক এসেছিল নব্বই দশক আসার একটু আগেই। বেকবাগানের মডার্ন হাই স্কুলে আমি ক্লাস ফাইভ থেকে টেন পর্যন্ত পড়েছি। তার পরই আমরা কলকাতা ছেড়ে চলে যাই মুম্বই। ওখানে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়তাম। ১৯৮৮ সালে, আমি ফার্স্ট ইয়ার, তখন আমাকে দেখেন জিনি নওরোজি’র সহকারী।

Advertisement

নয়নিকা চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:৩৮
Share:

১৯৯৪। সুস্মিতা সেন হলেন ‘মিস ইউনিভার্স’। এর পরেই ঐশ্বর্যা ‘মিস ওয়র্ল্ড’ হওয়ায়, পৃথিবী হঠাৎ নতুন করে ভারতীয় মডেলদের রূপমুগ্ধ হয়ে পড়ল।

ডাক এসেছিল নব্বই দশক আসার একটু আগেই। বেকবাগানের মডার্ন হাই স্কুলে আমি ক্লাস ফাইভ থেকে টেন পর্যন্ত পড়েছি। তার পরই আমরা কলকাতা ছেড়ে চলে যাই মুম্বই। ওখানে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়তাম। ১৯৮৮ সালে, আমি ফার্স্ট ইয়ার, তখন আমাকে দেখেন জিনি নওরোজি’র সহকারী। জিনি তখনই কোরিয়োগ্রাফি দুনিয়ায় কিংবদন্তি। ওঁর পরিচালনায় একটা শো করতেই, পর পর শোয়ের অফার আসা শুরু।

Advertisement

মডেলিং পেশা তখন গোটা ভারতে বিস্ময় আর বিভীষিকা। প্রায় কেউই জানে না ব্যাপারটা ঠিক কী, তবু তাদের সবার ধারণা ওই জগতে যাওয়া মানেই মেয়েটা খারাপ হয়ে গেল। তবে আমাদের বাড়ির আবহাওয়া অন্য রকম, অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আমার কাকা হন। তাই বিনোদন দুনিয়ার সঙ্গে দিব্যি যোগাযোগ ছিল। বড়রা শুধু একটা কথাই বলেছিলেন, মডেলিং করতেই পারো, তবে পড়াশোনাটা কিন্তু ভাল ভাবে শেষ করতেই হবে।

মডেলিং করে বেশ মোটা হাতখরচ পাওয়া যাচ্ছিল। সবার পকেট মানি তখন খুব বেশি হলে ১৫০ টাকা। এ দিকে প্রথম শো’তেই হাতে পেয়েছি কড়কড়ে ৫০০! প্রথমেই সাধ মিটিয়ে অনেকগুলো জুতো কিনে ফেললাম। কলেজ ক্যান্টিনে আমাকে দেখলেই ছেঁকে ধরছে বন্ধুরা। কাউকে আইসক্রিম খাওয়াচ্ছি, কাউকে ধার দিচ্ছি, ফেরত নিতে ইচ্ছেই করছে না।

Advertisement

কিন্তু অন্য রকম ভেবেছিল নব্বইয়ের দশক। তার সঙ্গে সঙ্গেই দেশে এল উদারতান্ত্রিক অর্থনীতি। অনেক বন্ধ দরজা খুলে গেল। হঠাৎ করে সংবাদমাধ্যমগুলো পালটে গেল। সিনেমা, বিনোদন, ফ্যাশন দুনিয়া নিয়ে অনেক বেশি সচেতন তারা। তখন ওয়াইএসএল, পিয়ের কার্দঁা ব্র্যান্ডগুলোও ভারতে এল। পিয়ের আমাকে ফ্রান্সে ডেকেও পাঠালেন। ঘটনাচক্রে সেই কাজটা আমার করা হয়নি, কিন্তু আমি যে প্যারিস থেকে ডাক পেয়েছি— সেই খবরটা এ দেশে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। মনোযোগের সব স্পটলাইট এসে পড়ল আমার ওপর। আমাকে বলা হতে লাগল ভারতের নেওমি ক্যাম্পবেল।

আমি তখন আমদাবাদে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ডিজাইন-এ পড়ছি। আমদাবাদ আর মুম্বইয়ের দূরত্ব খুব খুব বেশি না। রাতের ট্রেন ধরে মুম্বই এসে শো করে আবার ফিরে যেতাম। বাড়ি থেকে ফিরতেই সকলে ম্যাগাজিন হাতে ঘিরে ধরত, এই দেখো তোমার ছবি বেরিয়েছে।

ইন্ডাস্ট্রিতে দ্বিতীয় ‘বুম’টা এল ১৯৯৪ সালের শেষে। সুস্মিতা আর ঐশ্বর্যা পরপর ‘মিস ইউনিভার্স’ ও ‘মিস ওয়র্ল্ড’ খেতাব পেলেন। আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি হঠাৎ নতুন করে ভারতীয় মেয়েদের রূপমুগ্ধ হয়ে পড়ল। আমাদের নিয়ে ওদের কাজ করার উৎসাহও গেল বেড়ে। দেশেও কাজ হতে লাগল প্রচুর। তবে সব থেকে বড় কথা, মডেলিং মানে ছোট জামা আর সুইম-সুট— এই সব বিকৃত ভাবনাচিন্তাও অনেকখানি শুধরোল। সুশ-অ্যাশ-বিপ্‌সকে দেখে জিম-অ্যারোবিক্স সেন্টারে দলে দলে নাম লেখাতে লাগল টিন-এজাররা।

কত যে মজা করেছি! জেমস ফেরেরা’র শো মানেই হুল্লোড়। ও তো গোয়া-র ছেলে, সি-ফুড রান্নার হাত ছিল দারুণ। সবাই হুমকি দিত, পেট পুরে না খাওয়ালে শো-ই করবে না। খুব দুষ্টু ছিল অর্জুন রামপাল আর মিলিন্দ সোমন। কোনও আউটডোর শুটে ওরা থাকলে তুফান উঠত। আমি আর অর্জুন এক বার একটা হোটেলের ফ্ল্যাগ নামিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। তার পর দুজনেই শুকনো মুখে ঘুরছি, এই বুঝি হোটেল থেকে তাড়িয়ে দিল। যখন সেটা হল না, আমি মোমবাতি জ্বালিয়ে মাথায় কাপড় চাপিয়ে ঘুরতে শুরু করলাম। অর্জুন মুখে টুথপেস্ট মেখে ড্রাকুলা সাজল। রিতু কুমারের আবার স্বভাব ছিল একদম নতুন নতুন জায়গায় নিয়ে গিয়ে ক্যাটালগ শুট করানোর। গুজরাতের কত ভেতরের প্রত্যন্ত গ্রামে নিয়ে গেলেন এক বার। তবে আমরা ট্যাঁ-ফোঁ করতে পারতাম না আশা কোচ্চর-এর সামনে। এমনিতে হাসিখুশি, কিন্তু শো শুরু হলেই একেবারে বাঘিনি!

তার পর সুখের আকাশে মেঘ দেখা দিল একটু একটু করে। প্রত্যেকেই বুঝতে শুরু করল, মডেলিং পেশাটা দু’দিনের। আজ আছে, কাল নেই। অনেকেই বড় পরদায় চলে গেল। কিছু দিন পরেই শুরু হল ইন্ডি পপের যুগ। মিউজিক ভিডিয়োয় সুযোগ পেয়ে গেল অনেকে। আমি এ সবে গেলাম না। কারণ জানতাম, আমার চেহারা বলিউড ব্যবহার করতে জানে না। ওদের শুধু ফরসা মিষ্টি গোলগাল চেহারার মেয়ে পছন্দ। আমি একটা অন্য রকম অফার পেলাম। ‘ফেমিনা’ বলল, মিস ইন্ডিয়ার প্রতিযোগীদের গ্রুম করতে হবে আমাকে। নতুন নতুন মেয়েদের হাঁটা-চলা-তাকানো শেখানো, ব্যক্তিত্ব ঝালাই করে দেওয়া। এত ভাল লাগল, নিজেই গ্রুমিং স্কুল খুলে ফেললাম।

নব্বইয়ের মাঝামাঝি, ভারতে এল ‘শো-স্টপার’এর কনসেপ্ট। হঠাৎ শুনলাম, সেরা ড্রেসটা পরবে এক জন মডেল। সেই শো’টা শেষ করবে। গ্র্যান্ড ফিনালে’তে ডিজাইনারের পাশাপাশি ঢুকবে। এক জনকে এতটা গুরুত্ব দিয়ে দিলে বাকিদের মনে কষ্ট তো হবেই। শো-স্টপারের জন্য গোড়ায় আমাকে, বিপাশাকে বা মধু সাপ্রেকে ডাকা হতে লাগল। তার পর এক দিন শুধুই ফিল্মস্টারদের ডাকা হতে লাগল। মডেলরা বেশ হতাশ হল। কারণ বলিউডের ফ্যাশন সেন্স বলে কিচ্ছু ছিল না সে সময়। ওরা তো আমাদেরই অনুকরণ করত।

একটা ব্যাপারে অবাক তখনও লাগত, এখনও লাগে, এই ইন্ডাস্ট্রি একদম সম্মান দেয় না ছেলেদের। কোনও কোনও নামী ছেলে-মডেল সিনেমা-সিরিয়ালে ঢুকে বা রক ব্যান্ড বানিয়ে লাইমলাইটে টিকে যায়। কখনও কখনও রিয়েলিটি শো’য় দেখি কাউকে কাউকে। কষ্ট লাগে। ইন্ডাস্ট্রি আরও ভাল হবে, যদি ছেলেদের একটু সম্মান করতে শেখে!

নইয়ের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 90’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন