বাজি বানিয়ে বাজিমাত

শব্দবাজি হয়তো এক দিন ইতিহাস হয়ে যাবে। কিন্তু বুড়িমা থেকে যাবেন ইতিহাসে।শব্দবাজি হয়তো এক দিন ইতিহাস হয়ে যাবে। কিন্তু বুড়িমা থেকে যাবেন ইতিহাসে।

Advertisement

অময় দেব রায়

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৭ ০০:০০
Share:

সৃষ্টি: বুড়িমার শব্দবাজি

ধার করা দশটা একশো টাকার নোট। তাই দিয়ে নানা রকম বাজি কিনে দোকান সাজিয়ে বসলেন। জমল বিক্রিবাটা। তিন দিনের মাথায় পুলিশ এসে হাজির। বাজি বিক্রির লাইসেন্স আছে? বাজি বিক্রি করতে লাইসেন্স লাগে, জানা ছিল না। বললেন, “এ বারের মতো ছেড়ে দিন।” কাজ হল না। বাজি বাজেয়াপ্ত করল পুলিশ, গুঁড়িয়ে দিল দোকান। জেদ চেপে গেল। বাজির ব্যবসাই করবেন তিনি। করলেনও। ধীরে ধীরে বাংলার বাজি ব্যবসায় এক নম্বর জায়গাটি পাকা করে ফেললেন অন্নপূর্ণা দেবী। সবার ‘বুড়িমা’।

Advertisement

১৯৪৮। দেশভাগ, দাঙ্গায় বিধ্বস্ত পূর্ব পাকিস্তান। ডাক্তার রোগ ধরতে পারেনি, বাঁচানো যায়নি স্বামীকে। দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে অন্নপূর্ণা পাড়ি দিলেন গঙ্গারামপুর। ঠাঁই হল ক্যাম্পে। গঙ্গারামপুর বাজারে এক জনের কাছ থেকে শিখে নিলেন বিড়ি বাঁধা। ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বিড়ি বাঁধতে লাগলেন। একটু একটু করে, সব হল। বাড়ি, ছেলের পড়াশোনা, মেয়ের বিয়ে— বরানগরে। বেলুড়ে ন’শো টাকায় একটা দোকান কিনলেন। গঙ্গারামপুরের পাট চুকল।

ছেলেকে দোকানে বসিয়ে চষে ফেলেন উত্তরপাড়া, সালকিয়া, বড়বাজার। কী ব্যবসা করবেন? কিসে লাভ? সরস্বতীপুজোর আগে পিলখানার যোগেন্দ্র পালের কারখানা থেকে ঠেলাভর্তি করে প্রতিমা নিয়ে এলেন। বেলুড়ে কোথাও ঠাকুর তৈরি হত না, ছুটতে হত দূরে। হাতের কাছে প্রতিমা পেয়ে সবাই হামলে পড়ল। দোলের আগে রঙের পসরা নিয়ে বসলেন। সেটাও জমল।

Advertisement

এক দিন দোকানে এক ঝাঁক ছেলেমেয়ে হাজির। “বুড়িমা, লজেন্স দাও!” কী বলল ওরা? দোকানে রাখা আয়নাটা সামনে ধরলেন। চুলে পাক, শরীরে বয়সের ছাপ। আশ্চর্য, বুড়িমা নামটাও কী ভাবে ছড়িয়ে পড়ল। অন্নপূর্ণা দেবী হয়ে গেলেন ‘বুড়িমা’।

কালীপুজো। বুড়িমার ইচ্ছে দোকানে বাজি তুলবেন। হাতে পয়সা নেই। ধারের টাকায় বাজি কিনলেন, তার পরই সেই ঘটনা। দোকান ভাঙল পুলিশ। এর ক’দিন পরেই এক দুপুরে ছেলেকে চমকে দিলেন, “এই দেখ বাজি বিক্রির লাইসেন্স। আর বাজি তৈরির অনুমতিপত্রও!”

লাইসেন্স তো হল। কিন্তু কে শেখাবে বাজি বানানো? বাঁকড়ায় দেখা আকবর আলির সঙ্গে। হাতে ধরে শেখালেন— কাকে বলে সোরা, ব্যাটরা, গন্ধক কী রকম দেখতে। প্রথম মরশুমেই বাজিমাত। সব বিক্রি হয়ে গেল। আকবরের ফর্মুলাতেই তৈরি হল ‘বুড়ীমার চকলেট বোম’।

বাজি-কারখানার জন্য তালবান্দা, ডানকুনি, শিবকালীতে জায়গা কিনলেন। ডানকুনিতে মাটি খুঁড়তে বেরল বিশাল শিবলিঙ্গ। চকলেট বোমের লোগো হল তা। কারখানার জন্য কিনলেও তালবান্দার জমি বিলিয়ে দিলেন গরিবদের। এক সময় যাঁর মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না, তিনিই পঞ্চাশটি পরিবারকে বাড়ি বানিয়ে দিলেন। বলতেন, “ব্যবসাটা তুচ্ছ! এসেছি মানুষকে ভালবাসতে।”

১৬/১ পিয়ারীমোহন মুখার্জি স্ট্রিটের বিরাট বাড়ির সর্বত্র বুড়িমা। তাঁর শেষ দিনটা আজও চোখে ভাসে নাতি সুমন দাসের। লোকে ভর্তি বাড়ি, থমথমে। এরই মধ্যে বাইরে কারা ‘বুড়ীমার চকলেট বোম’ ফাটাচ্ছে। শোকের সময় চ্যাংড়ামো! উত্তর এল, ‘‘চ্যাংড়ামো নয়, জয়ধ্বনি। যে চকলেট বোম বানিয়ে গোটা বাজির বাজার জিতে নিয়েছেন, সেটা ফাটিয়েই বুড়িমাকে শ্রদ্ধা জানালাম!”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement