টাইম মেশিন

সম্প্রতি কলকাতায় বিশ্ব ‘বাংলায় কথা বলা’ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। বাংলা ভাষার মহাপ্রয়াণের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগী এতে অংশগ্রহণ করেন। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের প্রতিযোগীদের উপস্থিতিও বেশ সাড়া-জাগানো।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৬ ০০:০০
Share:

সম্প্রতি কলকাতায় বিশ্ব ‘বাংলায় কথা বলা’ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। বাংলা ভাষার মহাপ্রয়াণের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগী এতে অংশগ্রহণ করেন। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের প্রতিযোগীদের উপস্থিতিও বেশ সাড়া-জাগানো। পশ্চিমবাংলা তথা কলকাতার কয়েক জন সাহসী বাঙালিও এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বাংলায় কথা বলার শ্রমসাধ্য প্রয়াস করেন। প্রত্যেক প্রতিযোগীকে যে কোনও বিষয়ে কম পক্ষে এক মিনিট বাংলায় কথা বলতে দেওয়া হয়। শর্ত, বক্তব্য-র পুরোটাই নিখাদ বাংলায় বলতে হবে। প্রতিযোগিতাটি দর্শক ও শ্রোতাদের কাছে যথেষ্ট আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে ওখানে থাকা বাঙালিরা বাংলা ভাষা শোনার এক বিরল সুযোগ ও অভিজ্ঞতা লাভ করেন। প্রবীণ বাঙালিরা মাতৃভাষা শুনে অতীত দিনের স্মৃতিতে ভারাক্রান্ত হয়ে কান্নাকাটি করতে থাকেন। প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন তামিলনাড়ুর অজয় রবিচন্দ্রন। তিনি একটানা পাঁচ মিনিট সম্পূর্ণ বাংলায় কথা বলে সকলকে চমৎকৃত করেন। দ্বিতীয় স্থান পান গুজরাতের সুধাকর পটেল। তাঁর বাংলা কথামালায় অনুপ্রাসের ব্যবহার খুব প্রশংসিত হয়। তৃতীয় স্থানে জার্মানির হেইন্‌জ গুটেনবার্গ। সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শী এই জার্মান পরে জানান, তাঁর বাংলা শেখার কারণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।তাঁর রচনা মূল ভাষায় পড়ার তাগিদেই তিনি বাংলা শিখেছেন। তবে, বাংরেজি ও হিংলায় কথা বলতে অভ্যস্ত বাঙালিদের কেউই এই প্রতিযোগিতায় প্রথম একশো জনের মধ্যে নেই। ২১১ জন বাঙালি প্রতিযোগীর মধ্যে মাত্র এক জন ১৮০তম স্থানে রয়েছেন। ইনি সুজয় সেন। তিনি এগারো সেকেন্ড অনর্গল বাংলায় কথা বলতে পেরেছেন। তাঁর কৃতিত্বে বাঙালিরা গর্বিত। ভাবা হচ্ছে, তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। কিন্তু মুশকিল হল, মানপত্রটি বাংলা ভাষায় লিখবেন কে?

Advertisement

সুদীপ কুমার বিশ্বাসƒ উত্তরপাড়া

লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা:

Advertisement

টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

ফুটবল মাঠে চার-দশের টুর্নামেন্ট

ষাটের দশকে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচের দর্শক। গ্রামেগঞ্জে, মফস্‌সলের ফুটবল ম্যাচেও তখন দর্শকের আগ্রহ উত্তেজনা কিছু কম ছিল না।

১৯৬৫। ক্লাস নাইনে পড়ি। তখন বিনোদন বলতে রেডিয়ো, সিনেমা। বাবা-কাকারা সন্ধে সাড়ে সাতটার খবর খুব মন দিয়ে শুনতেন। আর আমরা শুনতাম খেলার কমেন্ট্রি। বিকেলের ফুটবল রিলে ছাড়াও হত ক্রিকেট কমেন্ট্রি। দু’-তিন বছর অন্তর কোনও বিদেশি টিম আসত ভারতে টেস্ট খেলতে। পর পর তিন দিন খেলা, এক দিন রেস্ট, আবার টানা দু’দিন। রোজ কালীমন্দিরে প্রণাম ঠুকতাম, অন্তত একটা টেস্ট যেন ভারত জিততে পারে। বেশির ভাগ টেস্টই ড্র হত। দু’-একটাতে বিদেশিরা জিতে ড্যাং-ড্যাং করে সিরিজ নিয়ে দেশে চলে যেত।

পাড়ায় পাড়ায় খেলাধুলোর চল ছিল। ডিসেম্বরে অ্যানুয়াল পরীক্ষার পর থেকে ফেব্রুয়ারিতে সরস্বতী পুজো পর্যন্ত ক্রিকেট, বছরের বাকিটা শুধু ফুটবল। দমদমে থাকতাম, রাস্তার ও-পারে মিশনারি স্কুলের মাঠে খেলতে যেতাম। আমরা বলতাম সাহেব মাঠ। বিশাল মাঠ, অন্তত দশটা পাড়ার ছেলে সেখানে ফুটবল পিটত। স্কুল থেকে ফিরে, বইপত্র রেখে সোজা মাঠে। আমাদের এক জন কোচও ছিলেন, নাম মণি। আমরা ডাকতাম মণিদা। প্রতি মাসে চাঁদা দিতাম আট আনা। ডিফল্টার হলে অন্য প্লেয়ারদের ঘেমো জার্সি কেচে দিতে হত। আগে এ রকম মণিদা-পাঁচুদাদের দেখতে পাওয়া যেত, যাঁরা প্রতি মাসে আট আনা এক টাকার বিনিময়ে বাচ্চাদের কোচিং করাতেন। ওইটুকু পয়সায় ওঁদের কী করে চলত কে জানে।

প্রতিটা পাড়াতেই ছোট ছোট মাঠ ছিল। সেখানে টুর্নামেন্টও হত। মাঠ ছোট বলে এগারো জনে খেলা হত না। বেশির ভাগ সময়ই সাত জন। টিমের নামও হত সে ভাবে— ‘সেভেন বুলেটস’, ‘সাত ভাই’, ‘সপ্তপদী’। আমরা দমদমের মণিদার টিম— বেলঘরিয়া, আগরপাড়া, খড়দা, বনগাঁ লাইনের নানা জায়গায় খেলতে যেতাম।

এক বার খেলা পড়ল বনগাঁ লাইনের দত্তপুকুরে। তিনটে নাগাদ মণিদা সমেত আমরা এগারো-বারো জন ট্রেনে দত্তপুকুর পৌঁছলাম। বলা ছিল, স্টেশনে নেমে বাঁ দিকে মিনিট পনেরো হাঁটলেই মাঠ। শিবু আমাদের ক্যাপ্টেন। ও দত্তপুকুরে নেমেই মণিদা আর ওর প্রিয় শাগরেদ বাচ্চুকে জার্সি, বুটের ব্যাগ, বল, সব নিয়ে একটা রিকশা ডেকে তড়িঘড়ি মাঠে পাঠিয়ে দিল। রিকশা প্যাঁক প্যাঁক করে বেরিয়ে গেল। আমরা যাব হাঁটতে হাঁটতে।

দত্তপুকুর না-গ্রাম-না-শহর একটা জায়গা। উদ্বাস্তু কলোনির ভিতর দিয়ে সরু সরু রাস্তা। বাঁশের বেড়া দেওয়া বাড়ির সারি। প্রতিটা বাড়িতেই প্রচুর ফুলগাছ। কুল, পেয়ারাগাছও আছে। একটা বাড়িতে দেখি, অগুনতি বড় বড় পাতিলেবু রাস্তার উপরেই ঝুলছে। শিবু পটাপট দু’-তিনটে ছিঁড়ে নিল, দেখাদেখি আমরাও। সবে দুটো ছিঁড়ে তিন নম্বুরির দিকে হাত বাড়িয়েছি, দেখি, একটা বাচ্চা মেয়ে চিৎকার করছে, ‘দাদু, কতগুলো দামড়া ছেলে তোমার গাছের সব লেবু নিয়ে চলে গেল!’ তার পরই দরজা খোলার শব্দ, দাদুর কিছু বাছা বাছা গালাগালি। সবাই লাগালাম ছুট। এক্কেবারে মাঠে। আমাদের খেলা স্থানীয় দলের সঙ্গে। মাঠে ঢোকা মাত্রই দর্শকদের রোল উঠল, ‘মেপে ফ্যাল, মেপে ফ্যাল!’ আসলে এই টুর্নামেন্টগুলো ছিলো ‘চার দশের টুর্নামেন্ট’। চার ফুট দশ ইঞ্চির মধ্যে যাদের উচ্চতা, তারাই খেলতে পারবে। টুর্নামেন্ট কমিটি প্লেয়ারদের উচ্চতা মেপে নিত। একটা চওড়া লাঠির মাঝখানে চার ফুট দশ ইঞ্চি উচ্চতায় আর একটা লাঠি ঢোকানো। যে সেই লাঠির নীচ দিয়ে চলে যেতে পারবে, সে কোয়ালিফাই করবে।

সবাই পেরিয়ে গেল। আমি মাথায় মাথায় আটকে গেলাম। একটু কুঁজো হয়ে ঢুকে যাচ্ছি, অমনি চার দিক থেকে চিৎকার: ‘কুঁজো হচ্ছে, কুঁজো হচ্ছে! ডিসকলি, ডিসকলি!’ ‘ডিসকলি’ মানে ডিসকোয়ালিফাইড। শিবু আর মণিদা আমার হয়ে আপ্রাণ লড়ে যাচ্ছে। এমন সময় এক ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। বোধহয় ক্লাব সেক্রেটারি। ‘কোন ক্লাস?’ বললাম। ‘বয়স?’ সেটাও ভয়ে ভয়ে ঠিকঠাকই বললাম। উনি বললেন, ‘একটু বেশি লম্বু হয়ে গেছ। এ বছরই তোমার শেষ চার দশ। যাও, খেলো গিয়ে।’ হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। জার্সি-বুট পরে মাঠে নামছি, দেখি, সেই ভদ্রলোক হাত নেড়ে ডাকছেন। পাশে আর এক জন বুড়ো লোক। কাছে যেতেই বললেন, ‘তোমরা ওঁর গাছ থেকে লেবু পেড়ে এনেছ? সব লেবু ফেরত দিয়ে দাও। নইলে উনি খেলা শুরু করতে দেবেন না।’ লজ্জার মাথা খেয়ে সব লেবু বার করে দিলাম। দশ জনের পকেট থেকে প্রায় ১৬-১৭টা লেবু বেরোল। তার পর খেলা শুরু হল। ফরওয়ার্ডে তিন জন, তার পরে দুজন, তার পর এক, আর গোলকিপার। পঁচিশ মিনিট করে দুটো হাফ, মাঝে দশ মিনিটের ইন্টারভ্যাল। ফার্স্ট হাফেই শিবু একটা গোল দিয়ে দিল। সারা মাঠ চুপ। মাথার পিছনে টুপটাপ ক’টা ইটও পড়ল। কিন্তু আয়োজকরা আর সেটাকে বাড়তে দিলেন না। ইন্টারভ্যালে একটা প্যাকেট পেলাম হাতে। দু’পিস করে মুচমুচে ভাজা পাঁউরুটি, একটা কলা, ডিমসেদ্ধ। মুহূর্তে পেটে তলিয়ে গেল।

দ্বিতীয়ার্ধে প্রথম থেকেই ওরা চেপে ধরল। দর্শকদের চিৎকারে কানে তালা ধরার জোগাড়। মণিদাও চেঁচাতে লাগলেন: ‘ওরে নেমে আয়, নেমে আয়!’ মানে সবাই মিলে ডিফেন্স কর। দর্শকরাও সঙ্গে সঙ্গে চেঁচাচ্ছে, নেমে আয়, নেমে আয়, উঠে যা, উঠে যা, বসে পড়, বসে পড়, শুয়ে থাক, শুয়ে থাক! প্রবল চিৎকারের মধ্যেও শিবু নেমে-উঠে দারুণ খেলল। এক সময় খেলা শেষের বাঁশি বাজল। আর গোল হয়নি, এক গোলে আমরাই জিতলাম। বেস্ট প্লেয়ার ট্রফি পেল শিবু, ফেয়ার প্লে ট্রফি ওদের এক জন। এ বার ফিরব। হাত-মুখ ধুয়ে তৈরি হচ্ছি, দেখি, সেই লেবু গাছের মালিক বুড়ো। হাতে বিশাল এক অ্যালুমিনিয়ামের ঘটি আর গোটা চারেক বড় বড় কাচের গ্লাস। বললেন, ‘ভাই, তোমাদেরই পাড়া লেবু আমি যত্ন করে রস করে এনেছি। খাও। দত্তপুকুরের লেবু, পেট-মাথা ঠান্ডা থাকবে। সবাই এক গ্লাস করে নাও।’ কী অসম্ভব টক! এমনিতেই লেবু চুরি করেছি, তার ওপর শত্রুর ডেরায় এক গোলে জিতেছি। না বলতে সাহস পেলাম না। প্যাঁচার মতো মুখ করে সেই পাঁচন গিললাম। কেন জানি না, মণিদা আর তার প্রিয় শাগরেদ বাদ। দূরে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে। মণিদা মাঝে মাঝে তাড়াও লাগাচ্ছে: ‘কী রে, হল? আর দেরি হলে তো ট্রেনটা মিস করব!’

পার্থ ঘোষ, বাগুইআটি, কলকাতা

parthaghosh.ir@gmail.com

ষাটের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?

লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 60’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

রবিবারেও প্রেজেন্ট দিলি কেন?

সু উচ্চ পাঁচিল টপকে তখনও স্কুল পালানোর সুনিপুণ কলাকৌশল আয়ত্তে আনতে পারিনি। সদ্য মাধ্যমিক পাশ করে গ্রাম ছেড়ে শহরের স্কুলে গেছি ইলেভেনে পড়তে। সেই স্কুলে আবার ‘পোড় খাওয়া’ কিছু ছাত্র ছিল, যারা ক্লাস ফাইভ থেকেই পাঁচিল টপকানোর মহাবিদ্যায় ‘বঙ্গরত্ন’ পাওয়ার যোগ্য ছিল। সুতরাং, প্রায় রোজই ফিফ্‌থ পিরিয়ডের পর ক্লাসরুম ফাঁকা হয়ে যেত। আমাদের মতো আহাম্মকরা অবশ্য প্রথম প্রথম ভাল ছাত্রটি সেজে পুরো স্কুল করতাম এবং শেষ পিরিয়ডে কার্ত্তিক স্যরের ইংরাজিতে পাণ্ডিত্যের বহর দেখে শেক্সপিয়র আর ওয়র্ডসওয়ার্থের চোদ্দো গুষ্টিকে পর্যন্ত আনলিমিটেড শাপ-শাপান্ত করতাম। কিন্তু বাদ সাধল মানিক-আশিসরা। ফিফ্‌থ পিরিয়ডে স্কুল পালানোর সময় ওরা পরিষ্কার হুমকি দিয়ে বলে যেত, ‘লাস্ট পিরিয়ডে প্রক্সিটা কিন্তু দিয়ে দিবি, না হলে কাল চাঁদা তুলে পেটাব’ (দু’-এক বার এই ধোলাই খেয়েওছি)। সুতরাং, স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ডি. তলাপাত্রর (সিংহ আর শেয়ালের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাঁর মধ্যে সহাবস্থান করত) তীক্ষ্ণ নজর আর প্রকাশ্য হুমকি শুনেও শেষমেশ আমরা মানিক-আশিসদেরই অনুগামী হলাম। অর্থাৎ, না থাকবে ক্লাস, না দিতে হবে প্রক্সি।

এক দিন প্রথম পিরিয়ডে ক্লাসটিচার ইন্দ্রনীলবাবু রোল-কল করছিলেন (যদিও ছাত্ররা তাঁর নাকের ডগাতে বসেই তখন সিনেমার রঙিন ম্যাগাজিন পড়ছিল)। ক্লাসে উপস্থিত ছাত্রের সংখ্যা সাতচল্লিশ জন, অথচ বাষট্টি জনের প্রেজেন্ট হল কী ভাবে, তা নিয়ে তিনি তখন চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ছাত্রদের চারিত্রিক উন্নতির শিক্ষা দিচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময় স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মী উচ্চ রবে হাঁক পাড়লেন, ‘স্যর আপনার ফোন আছে, একটু জলদি আসবেন।’ টেলিফোনে কেউ এক জন অপেক্ষায় আছে শুনেই আমাদের ক্লাস টিচার দৌড়ে চলে গেলেন ফোন ধরতে (মোবাইল তখন দূর গ্রহের বস্তু ছিল)। সুতরাং, এমন সুবর্ণ সুযোগ হাজার বছরে এক বার আসে। টেবিলের উপরেই খোলা রয়েছে স্টুডেন্টস অ্যাটেনডেন্স-এর খাতাটা। মুহূর্ত দেরি না করে ক্লাসের প্রায় সব ছাত্রই মরিয়া ঝাঁপ দিল সেই অ্যাটেনডেন্সের খাতার উপর। তার পর চলল বেপরোয়া প্রেজেন্ট দেওয়ার প্রতিযোগিতা। পিছনে পড়ে থেকে যারা অ্যাটেনডেন্সের খাতাটা দেখতে পাচ্ছিল না, তারাও ফাঁক-ফোকর দিয়ে শুধুমাত্র কলম চালিয়ে (লাল, নীল, কালো— সব কালিই ছিল) ‘প্রেজেন্ট’ দিয়ে আত্মসুখ লাভ করছিল। ঠিক সেই সময় স্কুল টহল দিতে বেরিয়েছিলেন ডি. তলাপাত্র। সুতরাং, আমাদের ক্লাসের ভিতর ওই রকম নৈরাজ্যবাদ চলছে দেখে তিনি সিংহের মতো হুংকার ছেড়ে বললেন, ‘এক্ষুনি সব ক’টা আমার ঘরে আসবি। আজ তোদের জন্মের মতো বেয়াদপি ঘোচাব।’

কাঁপতে-কাঁপতে সারিবদ্ধ ভাবে ক্লাসের সব ছাত্র তখন ডি. তলাপাত্রের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। স্যর একে একে ডেকে নিয়ে বেদম প্রহারে আমাদের ঘাড় থেকে প্রক্সির ভূত নামালেন। এর পর মানিক ঢুকতেই গগনবিদারী নাদে ডি. তলাপাত্র বলে উঠলেন, ‘হতচ্ছাড়া, রবিবারেও তোর প্রেজেন্ট হল কী ভাবে?’ কথাটা বলেই তিনি মানিককে ধরে আগাপাশতলা ধোলাই দিতে শুরু করলেন (মার খেয়ে মানিক তখন ধুনুচি নাচ দিচ্ছে)। আমাদের চোখের সামনেই তখন মৃত্যু পরোয়ানা। তবু মনে মনে হাসছি আর ভাবছি, মানিকের মতো আমাদেরও রবিবারে প্রেজেন্ট হয়ে যায়নি তো?

সঞ্জয় কর্মকার, কেউটিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা

স্কুলের শিক্ষক/শিক্ষিকা কি নিষ্ঠুর বা উদ্ভট ছিলেন? বিবরণ লিখে পাঠান ৪০০ শব্দে এই ঠিকানায়: গাঁট্টা, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১।

জামাই, কানমলা খাবে?

সু ভাষ মুখোপাধ্যায় আমার অন্যতম প্রিয় কবি। তাঁর অনেক কবিতা আমি বহু জায়গায় আবৃত্তি করেছি। আমার মাস্টারমশাই, বহুভাষাবিদ অনুবাদক অরুণ সোম-এর মস্কোর ফ্ল্যাটে সুভাষবাবু বহু বার অতিথিও হয়েছেন। স্যরের মুখে কবি সম্বন্ধে অনেক অন্তরঙ্গ কথা শুনেছি।

বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে শুনলাম, সুভাষ মুখোপাধ্যায় এক সময় এ বাড়িতে খুব আসতেন। আমার স্ত্রী ঋতা বলল, ‘জানো তো, সুভাষ মুখোপাধ্যায় আমার পিসির বিয়েতে কবিতা লিখে দিয়েছিলেন।’ সেই কবিতা অনেক রঙের কাগজে ছেপে বিয়েতে নিমন্ত্রিতদের হাতে হাতে দেওয়া হয়েছিল।

১৯৯৬ সালে ‘বুক ট্রাস্ট’ থেকে একটি ভ্রমণ সংকলন বের হবে। কবির ‘ডাক বাংলার ডায়েরী’র নির্বাচিত অংশ পুনর্মুদ্রণের অনুমতি আনার জন্য সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি যেতে হল।

কবি বললেন, ‘তা তোমরা কত দেবে?’

আমি বললাম, ‘আমাদের খুব ছোট পাবলিশিং হাউস। সামান্য দক্ষিণা দেবে।’

টাকার অংকটা শুনে কবি বললেন, ‘টাকাটা বড্ড কম হয়ে গেল না?’

বললাম, ‘এটা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ছেলের পাবলিকেশন। আপনার ‘নারাণদা’ বললেন, আমার কথা বোলো। সুভাষ পারমিশন দিয়ে দেবে।’

‘কোন নারাণদা?’

‘ন চ গ। নারায়ণ চন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়।’

‘ও, ওই হাজি মহসিন রোডের নারাণদা? উনি বেঁচে আছেন?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘তুমি নারাণদার কে হও?’

‘ওঁর ছোটমেয়ের বর।’

‘তাই বলো। নারাণদা আমাকে লেখালিখির হাতেখড়ি দিয়েছিলেন।’

তার পর হঠাৎ যেন স্মৃতিতে ডুবে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে বললেন, ‘জানো তো, নারাণদার বোন মাধু-র বিয়েতে আমি কবিতা লিখে দিয়েছিলাম। খুব আনন্দ হয়েছিল সে বিয়েতে।’

বলতে বলতে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছিলেন কবি। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, মাধু এখন কোথায় থাকে বলতে পারো? খুব জানতে ইচ্ছে করে ও কেমন আছে।’

বললাম, ‘উনি থাকেন শেক্সপিয়র সরণিতে। ওঁর বড় ছেলে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাটে। ভালই আছেন। দেখা হলে আপনার কথা বলব।’ এর পর পুনর্মুদ্রণের জন্য কবির অনুমতি নিয়ে ফিরে এলাম।

এই ঘটনার পর দিনই কবি হাজি মহসিন রোডের বাড়িতে এসেছিলেন তাঁর নারাণদাকে উৎসর্গ করা দুটি বই নিয়ে। কিছু দিন আগে কবির পা ভেঙেছিল। দোতলায় ওঠা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। এসেছিলেন লাঠিতে ভর দিয়ে। নীচ থেকে কবির ডাকাডাকিতে দুর্বল দেহে অশীতিপর ন চ গ নীচে নেমে এসে কবির আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়েছিলেন। গ্রহণ করেছিলেন কবির উপহার।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সেই ‘মাধু’ হলেন সম্পর্কে আমার পিসশাশুড়ি। কয়েক দিন পর তাঁর সঙ্গে দেখা হতেই কানে কানে বলেছিলাম, ‘পিসি, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় কিন্তু আজও তোমায় ভোলেননি।’

শুনে মাধু কপট রাগে বলেছিলেন, ‘জামাই, তুমি কি আমার হাতে কানমলা খাবে?’

স্বপন রায়ƒ রামমোহন বেরা লেন, কলকাতা

আপনার শ্বশুরবাড়ি ভাল? খারাপ? ভাল-খারাপ মিশিয়ে?

শ্বশুরবাড়ির টকঝালমিষ্টি ঘটনা লিখে পাঠান ৪০০ শব্দে। ঠিকানা: শ্বশুরবাড়ি, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement