পরীক্ষক: লর্ড ওয়েলেসলি
এক পরীক্ষার সকাল। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। সময়টা অষ্টাদশ শতকের শেষের দিক। কলেজের হলে ইংরেজ পরীক্ষার্থীদের সামনে পরীক্ষকের আসনে বসে আছেন ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলি! কালচে লাল রঙের ভেলভেটে মোড়া কাঠের চেয়ারে বসে তিনি সরাসরি প্রশ্ন করছেন ছাত্রদের। তাঁকে ঘিরে আছে একাধিক দেহরক্ষী। তাঁদের পরনে লাল কোট, হাতে খোলা তলোয়ার। দুজন পাঙ্খাবরদার মাথার উপর টানছে লাল সিল্কের দুটি টানা পাখা। পাশের চেয়ারগুলিতে বসে আছেন ‘রাজাবলী’র লেখক মৃত্যুঞ্জয় তর্কালঙ্কারের মতো বিশিষ্ট অধ্যাপকেরা।
অধ্যাপকদের ছুড়ে দেওয়া প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে ভবিষ্যতের আমলারা। প্রশ্ন-উত্তর-পালটা প্রশ্ন। উত্তর প্রশ্নের সমরে মুখর কলেজের প্রেক্ষাগৃহ। কখনও সংস্কৃত নিয়ে প্রশ্ন, কখনও হিন্দু আইন নিয়ে। মাঝে-মাঝেই এক-এক জন ছাত্রের উত্তর থেকে উঠে আসছে নতুন সূত্র। ভারতের বিশেষ কোনও অঞ্চল নিয়ে ভবিষ্যতের আমলাদের চিন্তাগুলি মন দিয়ে শুনছেন বড়লাট, পালটা প্রশ্ন করছেন তিনি। উত্তরের মধ্যে দিয়ে ছাত্ররা যত বেশি প্রশ্ন তুলছে, তত বেশি খুশি হচ্ছেন তিনি, আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে তাঁর মুখ। এই দৃশ্য শুধু একটি সকালের নয়। যত দিন তিনি গভর্নর জেনারেল ছিলেন, তত দিন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পরীক্ষকের আসনে তাঁর উপস্থিতি খুঁজে পাওয়া যায় ইতিহাসে। সম্ভবত যে ছবি ইতিহাস আগে দেখেনি, দেখেনি তাঁর সময়কালের পরে!
ইংল্যান্ডের ইটন কলেজ এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলার ছাত্র ওয়েলেসলি। বরাবরই প্রাচ্যের ইতিহাস আর সাহিত্য জানার ইচ্ছে চুম্বকের মতো টেনেছে তাঁকে। তাঁর চাই নতুন একটা জায়গা, যেখানে গোড়া থেকে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিতে পারবেন। বিলেত থেকে অনুমতি আসার আগেই ফোর্ট উইলিয়ামের পাশে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কলেজের সিলেবাসও তৈরি হয় তাঁর উপস্থিতিতে। ভারতীয়দের ছ’টি প্রধান ভাষা (সংস্কৃত, বাংলা, তেলুগু, মরাঠি, তামিল, কন্নড়), হিন্দু, ইসলামিক ও ব্রিটিশ আইন, ভারতেরই ইতিহাস ও সংস্কৃতি, উদ্ভিদবিদ্যা, রসায়ন ছিল এই সিলেবাসের অন্তর্গত। পাশাপাশি শুরু হল দেশীয় সাহিত্য পুনরুত্থানের কাজ।
নিজে ভাল ছাত্র ছিলেন বলেই হয়তো তাঁর চিন্তা ও কাজের মধ্যে এত মৌলিকত্ব। তিনি চাইতেন নিজে এক জন ভাল বুরোক্র্যাট হতে, চেয়েছিলেন এক ঝাঁক উপযুক্ত আমলা তৈরি করতে। তাঁকে সাজিয়ে-গুছিয়ে গড়তে হবে জবরদস্ত উপনিবেশ। এ হেন যোদ্ধা নিজের আগ্রহেই কলেজে গিয়ে বসতেন পরীক্ষকের আসনে। শিক্ষায় হস্তক্ষেপ নয়, শিক্ষার মান উন্নয়নেই ছিল এই বড়লাটের যাবতীয় আগ্রহ।