তালের গুড়ে বঙ্গবিপ্লব

কোনও সেলসম্যান নেই, নেই চটকদার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। স্বাধীনতার আগে থেকে আজও রমরম করে চলছে বঙ্গসন্তানের তালমিছরি। কোনও সেলসম্যান নেই, নেই চটকদার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। স্বাধীনতার আগে থেকে আজও রমরম করে চলছে বঙ্গসন্তানের তালমিছরি।

Advertisement

দীপঙ্কর ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৭ ০৮:৩০
Share:

দুলালচন্দ্র ভড়।

তি নি চলেছেন বাঙালির সঙ্গে ৮০ বছর ধরে। সর্দি-কাশি-পেটগু়ড়গুড়সর্বস্ব বাঙালির সহজাত ব্যাধিমণ্ডলে তিনিই স্বস্তির জ্যোতিষ্ক। দীর্ঘ চোখ, বিস্তৃত টাক, ক্লিন শেভ্ড হাস্যমুখ। সেই মুখচ্ছবির নীচে আড়াআড়ি স্বাক্ষর। ওই ছবি আর সই, কিংবা কখনও শুধু ছবিই আট দশক জুড়ে বাঙালির শরীর-মনে শুশ্রূষার বাতাস দিয়ে চলেছে। তিনি দুলালচন্দ্র ভড়।

Advertisement

তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। যুদ্ধের বাজারে ভড়দের বস্ত্র-ব্যবসাও ফুলে ফেঁপে উঠেছে। হাওড়া হাটে তখন তাঁদের একাধিক দোকান। এই সময়ই পারিবারিক কাপড়ের ব্যবসা ছেড়ে বছর উনিশের দুলালচন্দ্র ঝুঁকি নিয়ে নেমে পড়লেন মিছরির ব্যবসায়। ঠাকুরদা জওহরলাল ভড় সাহস জোগালেন। কলকাতায় তখন মিছরির খুব চাহিদা। ঘরে ঘরে সকাল-বিকেল মিছরি ব্যবহার হত শরবত থেকে রান্না, সবেতেই। সাদা সেই মিছরির বিরাট বাজার ছিল পূর্ববঙ্গেও। ব্যবসা মন্দ চলছিল না। কিন্তু সাদা মিছরির প্রতি দুলালচন্দ্রের প্রীতি বেশি দিন টিকল না। নতুন কিছু করতে হবে। এই চিন্তাকে কার্যকর করতে তিনি তালমিছরির দিকে ঝুঁকলেন। দু’-এক জন ছোট ব্যবসায়ী তালমিছরির ব্যবসা সবে শুরু করেছেন তখন। দুলালচন্দ্র তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিতে নামলেন কোমর বেঁধে। উৎপাদন এবং বিপণন এমন জায়গায় নিয়ে গেলেন যে মুখ থুবড়ে পড়লেন ওই ছোট ব্যবসায়ীরা। কাপড়ের ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতিটা কাজে লাগল এখানে। রাজবলহাটের তন্তুবায় পরিবারের বছর বিশের ছেলেটি দ্রুত তালমিছরির জগতে কায়েম করলেন একচ্ছত্র অধিকার। ব্যবসায় তখন ব্র্যান্ড বা ট্রেডমার্কের চল তেমন ছিল না। অথচ তাঁর ব্যবসা একান্ত ভাবে তাঁরই হবে না? চেষ্টা শুরু করলেন। সাহেবদের আস্থা অর্জন করে ১৯৪৪-এ বের করলেন রেজিস্ট্রেশন নম্বর। আজও সেই ‘৩৯৬৫ রেজি. নম্বর’ যুক্ত থাকে দুলালচন্দ্র ভড়ের তালমিছরির লেবেলে।

ছেলে ধনঞ্জয় ভড় শোনাচ্ছিলেন শুরুর দিকের সে সব গল্প। এখন আর ওই রেজিস্ট্রেশন নম্বরটির দরকার পড়ে না, তবু তা তাঁরা রেখেছেন বাবার ওই উদ্যোগকে কুর্নিশ জানাতে। সে কালে মিছরি প্যাকেজিং হত বস্তায়। নানান মাপের চটের বস্তায় বন্দি হয়ে তালমিছরি পাড়ি দিত বাংলার নানা প্রান্তে। শুধু কি বাংলা? দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ল বিহার থেকে অসম, আমদাবাদ, ওডিশায়। আজও সমানে তালে সেই রফতানি চলছে। এই ব্যবসার ধরনটাই অন্য রকম। কোনও সেলসম্যান নেই, নেই চটকদার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। রাজ্যের বাইরে কোথাও আউটলেট বা সেলস কাউন্টারও নেই। ঘণ্টাখানেক ধনঞ্জয়বাবুর সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে তাঁর গোটা পাঁচেক মোবাইলে অন্তত একশো ফোন এল দেশের নানা প্রান্ত থেকে। তাঁর কথায়, ‘‘ব্যবসাটা এ ভাবেই চলে। ক্রেতারা অর্ডার দিয়ে অ্যাডভান্স টাকা মিটিয়ে দেন। তার পর মাল যায় ট্রান্সপোর্টে। কেউ কেউ বড়বাজারে আমাদের অফিস থেকেই সরাসরি মাল বুক করেন। বাবাকে কোনও দিন ঘুষ দিয়ে ডাক্তার ধরতে হয়নি। প্রোডাক্ট প্রেসক্রাইব করার জন্য গিফট ছাড়তে হয়নি। সর্দিকাশি আর পেটের ব্যামোয় আজও মানুষ বেছে নেন আমাদের তালমিছরি!’’

Advertisement

কী এমন আছে তালমিছরিতে, যা বছরের পর বছর নিজেই নিজের সফল বিজ্ঞাপন হয়ে উঠতে পারে? ‘‘আসলে দ্রব্যগুণ! তালের খাঁটি রস আর সামান্য চিনি ছাড়া তো তেমন কিছু থাকে না!’’ ধনঞ্জয়বাবুর প্রত্যয়ী স্বর। প্রস্তুত-প্রণালী? পুরো সিক্রেট ফাঁস না করলেও কিছুটা জানা গেল, তালগুড় জ্বাল দিতে দিতে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় নিয়ে যেতে হয়। গুড়ের এই পাক পর্বটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার পর ফুটন্ত গুড় ঢালা হয় বড় বড় ট্রে বা পাত্রে। এক ধরনের বিশেষ চট দিয়ে এ বার ঢেকে দেওয়া হয় পাত্রগুলি। তার পর বন্ধ ঘরে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখতে হয় সাত-আট দিন। পাক ও মিশ্রণ ঠিকঠাক হলে দিন সাতেকের মধ্যে পাত্রের উপরে এবং নীচের অংশে জমাট বাঁধে পুরু মিছরি। মাঝখানে থাকে মিশ্রণের জলীয় অংশ। জলীয় অংশ বিশেষ পদ্ধতিতে বের করে নিয়ে জমাট বাঁধা অংশ কাটিং করা হয়। তার পর প্যাকিং। চৈত্র মাসের মাঝামাঝি থেকে শ্রাবণ মাসের প্রথম পর্ব, এই চার-সাড়ে চার মাস হল মিছরি তৈরির সিজন। কারণ তালও মেলে ওই সময়েই। ‘‘তমলুকের খাঁটি তালগুড় ছাড়া আমরা মিছরি বানাই না। আর কারিগররাও বংশানুক্রমে যুক্ত আমাদের প্রতিষ্ঠানে। মানটা ধরে রাখতে পেরেছি বলেই আট দশক নানা ঝড়ঝাপটাতেও টলেনি আমাদের ব্যবসা,’’ জানান ধনঞ্জয়।

মামলা-মকদ্দমায় বারবার জেরবার হয়েছে তাঁদের ব্যবসা। দুলালচন্দ্রের জীবদ্দশাতেই ভাই সনাতনের সঙ্গে বিবাদ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। ১৯৮০-তে কলকাতা হাইকোর্টে সেই মামলায় দুলালচন্দ্রের পক্ষে লড়েন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতো দুঁদে আইনজীবী। মামলার বিষয় ছিল তাঁদের সংস্থার নাম কী হবে: ‘দুলালের তালমিছরি’ না ‘দুলালচন্দ্র ভড়ের তালমিছরি’ ওই মামলায় বিচারপতি মঞ্জুলা বসুর অবজারভেশন ছিল, আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে নেওয়া হোক দ্বন্দ্ব, যাতে ব্যবসার ক্ষতি না হয়। ১৭ বছর আগে ২০০০-এর ২৭ জুন দুলালচন্দ্রের মৃত্যুর পর আইনি লড়াই শুরু ধনঞ্জয় এবং তার ভাই অমিত ভড়ের। ব্র্যান্ডনেমের অধিকার কার থাকবে তা নিয়ে সেই লড়াই আজও আদালতে বিচারাধীন। এ সবের মধ্যে কখনও ‘দুলালচন্দ্রের ছবি ও সই দেখে’ কখনও শুধু ছবি দেখে’, কখনও ‘দুলালের তালমিছরি’ ইত্যাদি নানা বিজ্ঞাপন জড়ো হয়েছে চার পাশে। কিন্তু সব কিছুর কেন্দ্রে দুলালচন্দ্রের নামই। জীবৎকালে তো ছিলেনই, মৃত্যুর পরও দুলালচন্দ্র ভড় বেঁচে আছেন বাঙালির মনে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন