বিরাট একটা অ্যাডভেঞ্চারই বলা যায়, আমার প্রথম কাহিনিচিত্র বানানোর অভিজ্ঞতাটাকে। যে কোনও মানুষ তার প্রথম ফিচার ফিল্ম কল্পনা করে তার নিজের ভাষায়, বা যে ভাষায় সে অন্তত স্বচ্ছন্দ, তাতে। সেখানে আমি প্রথম ছবি বানালাম তেলুগু ভাষায়। ১৯৭৫-’৭৬ এর কথা, আমি তখন বিজ্ঞাপনী ছবি, তথ্যচিত্র বানাচ্ছি। ইচ্ছে ছিল, সমরেশ বসুর ‘শ্রীমতী কাফে’ নামের একটা উপন্যাস থেকে আমার প্রথম ছবি বানাব, নায়কের ভূমিকায় থাকবেন উত্তমকুমার। এ ছাড়াও অনেকগুলো চরিত্র ভেবেছিলাম, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় থেকে রবি ঘোষ, মমতাশংকর, এঁরা ভাবনায় ছিলেন। উত্তমবাবুর সঙ্গে কথাও এগিয়েছিল, উনি উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন, তোমাদের মতো ইয়াং ডিরেক্টরদেরই তো এখন ছবির জগতে আসা উচিত। এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটল। মৃণালদার (সেন) ‘মৃগয়া’ ছবির প্রযোজক জি রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় এলেন। আমার বানানো তথ্যচিত্র ‘হাংরি অটাম’ তখন বেশ সাড়া ফেলেছে। মৃণালদারও ছবিটা খুব প্রিয় ছিল, খুব গর্বভরে ছবিটার কথা বলতেন সবাইকে। তো নিজের প্রযোজককেও মৃণালদা ছবিটা দেখালেন। বললেন, একটা ইয়াং ছেলের বানানো নির্ভীক একটা ছবি, কাউকে ভয় না পেয়ে, সামাজিক পরিস্থিতি যা, তা-ই তুলে ধরেছে, দেখো। উনি ছবিটা দেখে আমাকে বললেন, আপনি হায়দরাবাদে এসে একটা ফিচার ছবি করুন। আমি একটু সময় চেয়ে নিলাম। কারণ প্রথমত, আমি তো বাংলাতেই আমার প্রথম ছবি করার কথা ভাবছিলাম। আর, হায়দরাবাদে গিয়ে ছবি বানালেও আমাকে এমন একটা বিষয় ভাবতে হবে, যার একটা জোরদার প্রাসঙ্গিকতা আছে, একটা আঞ্চলিক ‘যোগ’ আছে।
সেই সময় আমি কিষেণ চন্দরের লেখা একটা ছোট উপন্যাস পড়ছিলাম, ‘জব খেত জাগে’। প্রেক্ষাপট তেলঙ্গানা কৃষক আন্দোলন। যেটা শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলন হিসেবে, পরে সশস্ত্র আন্দোলনে পরিণত হয়। সম্ভবত বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় কৃষক আন্দোলন। পড়ে আমার মনে হল, এই বইটাকে ভিত্তি করে একটা ছবি হতে পারে। কারণ, সত্তর দশকের শেষের তেলঙ্গানাতেও তখন ভয়ংকর সামন্তশাসন, অত্যাচার, আর অসম্ভব দারিদ্র। মনে হল, ছবিটা বানালে কৃষকরা খুব উদ্বুদ্ধ হবেন, তাঁদেরই পূর্বপুরুষরা কী করে নিজামের অত্যাচার-নিপীড়নের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে লড়েছিলেন, পরে ইন্ডিয়ান আর্মিও যখন হায়দরাবাদ অধিকার করতে এল, তাদের বিরুদ্ধেও অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন, সেই ইতিহাস মনে পড়বে ওঁদের। সিদ্ধান্ত নিলাম, ছবিটা করব। রিসার্চ, পড়াশোনা করলাম। আমি আর আমার কবি বন্ধু পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় মিলে চিত্রনাট্যও লিখলাম। ছবির নাম ‘মা ভূমি’, বাংলায় ‘আমার দেশ’।
গেলাম হায়দরাবাদে। প্রযোজকদের বললাম, ছবিটা আমি হিন্দিতে করতে চাই। আমি তো হিন্দিটা তাও জানি। ওঁরা বললেন, হিন্দিতে হলে এই অন্ধ্র ও তেলঙ্গানার অসংখ্য মানুষ ছবিটা বুঝতেই পারবেন না। তেলুগুতেই করুন, একদম আপনার মতো করে করুন, আমাদের দিক থেকে কোনও রকম ব্যবসায়িক চাপ থাকবে না। এঁরা ছিলেন পড়াশোনা, গানবাজনা করা বুঝদার মানুষ, অনেকেই প্রোগ্রেসিভ থিয়েটার আর জননাট্যমণ্ডলীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মানসিকতাটাই অন্য রকম। আমি ছবিটা তেলুগুতে করতে রাজি হলাম। সঙ্গে এ-ও বললাম, স্ক্রিপ্ট আমি একটা লিখে এনেছি বটে, কিন্তু আমার একটু ঘুরে বেড়ানো দরকার। প্রথমে গেলাম সুরিয়াপেট নামের একটা জায়গায়, যেখান থেকে ১৯৪৬ সালে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিল। আন্দোলনের যিনি প্রধান নেতা ছিলেন, তিনি পরবর্তী কালে মূল ধারার রাজনীতিতে যোগ দেন। তাঁর সঙ্গে অনেক ক্ষণ কথা বললাম। কথা বলে বেরিয়ে আসছি, স্থানীয় এক জন লোক আমার দোভাষীকে বললেন, দর্শকালু (তেলুগু ভাষায় এর অর্থ পরিচালক, মানে আমি) তো আসল লোকের সঙ্গে কথা না বলেই চলে যাচ্ছেন। আমায় নিয়ে গেলেন আব্বাস আলি নামে এক জনের কাছে। তিনি নিজে লড়াই করেছিলেন সেই যুগে, গায়ে তিনটে বুলেটের দাগ সাক্ষী। তাঁর কাছ থেকে ওই সময়ের ঘটনা শুনে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। কী স্বপ্ন নিয়ে, লক্ষ্য নিয়ে ওঁরা সেই সময় প্রবল প্রতাপী নিজাম আর তার রাজাকারদের সামনে বুক পেতে দিয়েছিলেন, বুঝতে পারলাম। অনেক জায়গা ঘুরলাম, বহু বিপ্লবী যাঁরা তখনও জীবিত ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে দেখা করলাম, কথা বললাম। এই সব কিছুর পর পার্থ আর আমি ঠিক করলাম, কলকাতা থেকে লিখে আনা স্ক্রিপ্টটা আমাদের এক্ষুনি ছিঁড়ে ফেলা উচিত। আমরা আদতে কিছুই বুঝিনি, কল্পনা আর রোম্যান্টিকতায় সাঁতলানো একটা স্ক্রিপ্ট লিখেছিলাম।
নতুন স্ক্রিপ্ট লেখা হল। আরও জায়গা ঘুরে, আরও মানুষের সঙ্গে কথা বলে, লোকেশন দেখে। আরও দুজন, প্রাণ রাও ও নরসিং রাও, আমাদের স্ক্রিপ্ট লেখায় সহযোগিতা করলেন। এক দিন শেষ হল চিত্রনাট্য। দেখা গেল, ছবিটা এমন বিশাল একটা স্কেল নিয়েছে, যা আমরা ভাবতেও পারিনি। বিরাট পরিসর, অসংখ্য সংঘর্ষ-দৃশ্য, ওয়ার সিন শুট করতে হবে আমাদের। অথচ বাজেট নিতান্ত কম, সাদা-কালোয় করতে হবে ওই পয়সার অভাবেই। তারুণ্য, আবেগ, সংকল্প, সব কিছু নিয়ে আমরাও যেন আগুনে ঝাঁপ দিলাম। প্রযোজকরাও আমারই মতো স্বপ্নবিলাসী ছিলেন, কী হবে না হবে অত কিছু ভাবেননি। শুরু তো করি, শেষ দেখা যাবে পরে।
ঠিক হল, প্রধান চরিত্র ‘রামাইয়া’ করবেন জি নারায়ণ রাও। উনি মৃণাল সেন-এর ‘ওকা উরি কথা’র নায়ক ছিলেন। শুট শুরু হতে মাত্র ক’দিন বাকি, উনি মৃণালদার ছবির জন্য বিদেশে চলে গেলেন। আমার পক্ষে শুটিং শিডিউল পালটানো সম্ভব ছিল না। মরিয়া হয়ে খুঁজতে লাগলাম বিকল্প কাউকে। এতটাই মরিয়া তখন, ভেবেছিলাম, চেহারাটা শুধু মানানসই হোক, অভিনয় না জানলেও চলবে। আমি ঠিক করিয়ে নিতে পারব। খুঁজতে খুঁজতে তেলুগু সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক গোপী চাঁদ-এর ছেলে সাই চাঁদ-কে পেলাম। সে বলল, অভিনয় তো দূরস্থান, আমি জীবনে একটা আবৃত্তি পর্যন্ত করিনি। যা হোক, আমার মনে হয়েছিল সাই পারবে। মুশকিল হল বাকি কাস্টিং নিয়ে। এত চরিত্র কোথায় পাব? জনাকয়েক পেলাম, যাদের তেলুগু থিয়েটারের কিছুটা অভিজ্ঞতা ছিল। আর নেওয়া হল প্রচুর গ্রামবাসীকে। আজ এত বছর পরও অবাক হয়ে ভাবি, এই গ্রামবাসীরা কী করে এমন অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। আসলে অভিনয় সম্পর্কে ওঁদের কোনও পূর্ব-ধারণা ছিল না। ওঁরা যা করেছিলেন, সেটাকে একেবারে ঘটমান বাস্তব হিসেবে করেছিলেন। চরিত্রগুলো তাই খুব বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছিল। ওঁরাও এতটাই ‘ইনভল্ভ্ড’ হয়ে পড়েছিলেন, কতকগুলো সংঘর্ষের দৃশ্যের শুটিংয়ে রক্তারক্তি পর্যন্ত হয়েছিল। লাঠি দিয়ে মারার দৃশ্যে কেউ সত্যি সত্যি লাঠির ঘায়ে মাথা ফাটিয়ে দিচ্ছেন। ইমোশন সামলাতে পারছেন না। এটা অভিনয়, সত্যি না, সেটা বোঝাতে খুব বেগ পেতে হয়েছিল।
আমরা প্রায় থেকেই গেছিলাম ওখানে। মাঝেমধ্যে টাকা আসছে, সেইমতো শুট করছি। প্রথম দুটো শিডিউল শেষে অর্থাভাবে শুট আটকেও গিয়েছিল। দীর্ঘ সংগ্রামের পর ছবি শেষ হল। এমন অবস্থাও হয়েছে, লাঞ্চের পয়সা নেই, গ্রামবাসীরাই রান্না করে আমাদের খাইয়েছেন। কিন্তু পয়সা নেই বলে আমাদের কারও মনোবল ভেঙে যায়নি। বরং এমন একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছিল যে কখনও কখনও মনে হত, আমরা সত্যিকারের তেলঙ্গানা আন্দোলনের মধ্যেই দিন যাপন করছি।
এক বছরেরও ওপর চলল সেই অ্যাডভেঞ্চার। ১৯৮০-র ২৩ মার্চ অন্ধ্রপ্রদেশের ৩০টিরও বেশি হল-এ মুক্তি পেল ‘মা ভূমি’। আমরা কল্পনাও করিনি, যে ছবিতে কোনও স্টার নেই, যার বিষয়বস্তু একেবারেই ভিন্ন, পরিচালকের নামটা পর্যন্ত কেউ জানে না, সেই ছবির ব্যবসায়িক ভবিষ্যৎ কী হবে। রিলিজের দিন আমার সাহসই হয়নি হল-এ যাওয়ার। ছোট্ট একটা ইরানি ক্যাফে ছিল, সেখানে লুকিয়ে ছিলাম, কফি খাচ্ছিলাম। এমন সময় আমার চিফ অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরের ভাই দৌড়ে এসে আমাকে জানাল, তুমি এখানে বসে আছ? ও দিকে হল তো ফেটে পড়ছে, সবাই হাততালি দিচ্ছে! ছবি তো হিট! সত্যিই তাই। দারুণ ব্যবসায়িক সাফল্য পেয়েছিল ‘মা ভূমি’। হায়দরাবাদের হল-এ এক বছর চলেছিল ছবিটা। দুশো, তার পর তিনশো দিনের সেলিব্রেশন হয়েছিল, মনে আছে। সঙ্গে ছিল বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছবিটা নিয়ে লেখালিখি— রিভিউ, ফিচার, এমনকী প্রথম পাতার খবর। আমার প্রথম ছবির বহুল প্রচারে সংবাদমাধ্যমের অবদানও তাই কম নয়। ছবির পরিবেশকের বড় বড় হোর্ডিং করার টাকা ছিল না, সীমিত সাধ্যে যেটুকু সম্ভব, করেছিলেন।
আশির ২৪ জুলাই, তখনও আমি হায়দরাবাদে। ‘মা ভূমি’র সাফল্যে তখন নানা অনুষ্ঠান হচ্ছে। দিনটা আমার জন্মদিনও, তাই মাকে ফোন করেছি কলকাতায়, আশীর্বাদ নিতে। মা জানালেন, উত্তমকুমার মারা গেছেন। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। প্রথম ছবি তো ওঁকে নিয়ে করব ভেবেছিলাম! ‘মা ভূমি’ হল, কিন্তু উত্তমকুমারকে নিয়ে আমার আর ছবি করা হল না।
তবু, ‘মা ভূমি’ বানানোর স্মৃতি, প্রথম প্রেমের মতো। অতখানি আবেগ, পরিশ্রম জড়িয়েছিল, কোনও কিছুই অসম্ভব বলে মনে হয়নি। কোনও পরিস্থিতিতেই পিছিয়ে আসিনি। অনেকে বলেছিলেন, প্রথম ছবিই এত বড় ক্যানভাসে করছ, একটু বেশি দুঃসাহসিক কাজ হয়ে যাচ্ছে। আমার কিন্তু মনে হয়েছিল, আমি পারব। চৌত্রিশ বছর হয়ে গেল, এখনও কিছু মানুষ আছেন যাঁরা ‘মা ভূমি’ রিলিজের দিনটা সেলিব্রেট করেন। এখন তেলঙ্গানা নতুন রাজ্য হয়েছে, আমার প্রথম ছবি এখন অনেক মানুষের সম্পদ। এর থেকে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে!
goutamghose@gmail.com