ছবি: সুমন চৌধুরী
আমার প্রথম ছবি ‘দূরত্ব’। প্রথম আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভাল বার্লিন। সময়টা ১৯৭৮-এর হাড়হিম করা ফেব্রুয়ারি। ঠান্ডা শূন্যের অনেক নীচে। জার্মানরা কথা কম কাজ বেশি টাইপের মানুষ। হাসতে হাসতে ফরাসিদের টেবিলের তলায় গড়াগড়ি খেতে দেখেছি, আধ বোতল সাকি খাওয়ার পরে জাপানিরা সব বলে দেয় এমনকী কবে কোন মেয়েকে চুমু খেয়েছিল তা-ও, ইতালিয়ানরা হঠাৎ-রাগে বাঙালিদের চেয়ে কোথাও পিছিয়ে থাকে না আর স্প্যানিশরা তো... এক নামকরা স্প্যানিশ ফিল্ম ক্রিটিক বন্ধু আর আমি সবে তিন পেগ শেষ করেছি এই সময় এক নারী ‘কেমন আছ? ভাল তো?’ গোছের হাত নেড়ে চলে গেলেন, সঙ্গে মিষ্টি হাসি। বন্ধুটি দেখি না রাম না গঙ্গা। আমি একটু অবাক, কী হল তুমি গ্রিট করলে না? বন্ধুটি বললেন, বুঝতে পারি না। আমি বললাম, কী বুঝতে পারো না? বন্ধু বললেন, না মানে কার সঙ্গে যে শুয়েছি আর কার সঙ্গে যে শুইনি মনে করতে পারি না, বুঝলে না? শুয়ে থাকলে এক রকম আর না শুলে আর এক রকম উত্তর।
সে বছর বার্লিনে এ দেশ থেকে আরও কয়েক জন ছিলেন তাঁদের ছবি নিয়ে— মৃণাল সেন, শ্যাম বেনেগাল, আদুর গোপালকৃষ্ণণ। মৃণাল সেন, মৃণালদা, সাড়ে আটশোটা চুটকি জানেন এবং আমরা যারা ঘনিষ্ঠ ছিলাম, জানতাম কোনটার পর কোনটা আসবে। একটা ছিল গোপাল ভাঁড়ের। মহারাজ বৃদ্ধ হয়েছেন, আশি ছুঁই-ছুঁই বয়স, এ দিকে রানিমা আবার গর্ভবতী হয়েছেন। ভরা রাজসভায় এই ব্যাপারে গোপালের অকর্মণ্যতা নিয়ে বিদ্রুপ করায়, গোপালের সেই উক্তি— ‘আপনার কত লোকবল’ সব বাঙালিই জানেন। কিন্তু জার্মানরা? ভীষণ কফিতেষ্টা পেয়েছে, কফির অর্ডার দিয়েছি, হঠাৎ রেস্তরাঁর এক কোণ থেকে হো হো করে প্রবল হাসির শব্দ। দেখি, বেশ কয়েক জন জার্মান একসঙ্গে মুখ খুলে হাসছে আর মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন মৃণালদা! বেরিয়ে যাওয়ার আগে মৃণালদাকে জিজ্ঞেস করলাম, কোনটা ছাড়লেন? গোপালেরটা? মৃণালদা হেসে মাথা নাড়লেন। গোপালভাঁড় শুনিয়ে জার্মানদের হাসানোর মতো বিস্ময়কর ঘটনা একমাত্র মৃণালদাই ঘটাতে পারেন। শ্যাম এবং আদুর তাদের দ্বিতীয় ছবি নিয়ে এসেছে, আর আমাদের তিন জনেরই প্রথম বিদেশের ফিল্ম ফেস্টিভালে আসা। সারা দিন বাইরে বরফ পড়ছে আর তা মাথায় নিয়েই আদুর চষে বেড়াচ্ছে বার্লিনের রাস্তা, কোথায় ইডলি সম্বর আর দোসা পাওয়া যায়। শ্যাম খুঁজে বেড়াচ্ছে মকাই কা রোটি আর মাংস। ধীরাজ বলে কে এক জন লুকিয়ে লুকিয়ে মৃণালদার জন্য বাড়ির তৈরি মাছের ঝোল, ভাত নিয়ে আসত। দেশের বাইরে গিয়ে আলুপোস্তর জন্য আমি কখনওই ঘ্যানঘ্যান করি না আর সেই প্রথম পর্ক সসেজ পাঁউরুটিতে মুড়ে হুইস্কিতে ডুবিয়ে রাতের খাবার শেষ করতে শিখলাম। দেশ থেকে আমাদের সঙ্গে এসেছিলেন এক সরকারি আমলা, তিনি আবার ঘোর নিরামিষাশী। দুটো ছোট ছোট সুটকেস ছিল তাঁর সঙ্গে। একটাতে জামাকাপড় টুথপেস্ট ইত্যাদি, অন্যটা ভর্তি চিঁড়ে। প্লেনেও ভদ্রলোক চিঁড়ে ছাড়া আর কিছুই মুখে দেননি। বার্লিন থেকেই ‘দূরত্ব’র আমন্ত্রণ এল লোকার্নো থেকে। একমাত্র ভারতীয় ছবি। পুরস্কারও পেল। সব শেষে রাত্তির বারোটার সময় প্রেস মিট চলছে, এমন সময় কোলে কুকুর নিয়ে হাজি়র এক চিত্রসমালোচক। আমার দিকে তাকিয়ে, শাসানোর ভঙ্গিতে হাত নেড়ে এক প্রস্থ বলে গেলেন তিনি, তার পর তাঁর কুকুরটি শুরু করল। ভদ্রলোক আবার বললেন, কুকুরও আবার বলল, তার পর আবার, তার পর আবার। সুইৎজারল্যান্ডে তিনটি ভাষার চল আছে, আমার সুবিধে আমি কোনওটাই জানি না। আমার দোভাষী বললেন, উনি জানাচ্ছেন আপনার ছবি ওঁর এবং ওঁর কুকুরের বিতিকিচ্ছিরি লেগেছে। উনি তো লিখবেনই, ওঁর কুকুরও লিখতে পারলে তা-ই লিখত। অনেক ক্ষণ গালমন্দ শোনার পর আমি বললাম, ঠিক আছে, পরের বার এমন ছবি নিয়ে আসব যেটা আপনার আর আপনার কুকুর দুজনেরই ভাল লাগবে।
জাপানের টোকিয়োতে একটি ফেস্টিভালে ‘নিম অন্নপূর্ণা’ দেখানো হচ্ছে। ছবি শেষ হতে আমি বাইরে এসে দাঁড়িয়েছি, চারপাশ থেকে ছেঁকে ধরল অসংখ্য লোক: ডিনার... ডিনার? ইন্ডিয়ান ফুড। কাম কাম। ছবির শেষে হাততালির রেওয়াজ আছে জানি, কিন্তু ডিনার খাওয়ানোর রেওয়াজও যে এ দেশে আছে, দেখে আমি অভিভূত। ফেস্টিভালের হত্তাকত্তাদের এক জনের অনুরোধ ঠেকানো গেল না, যেতেই হল তাঁর সঙ্গে ডিনারে। পর দিন সকাল থেকে হোটেল রুমে ফোন আসতে থাকল। একই কথা, ডিনার... ডিনার। কোনও রকমে এড়িয়ে দু’দিন পর প্লেনে চেপেছি দেশে ফিরব বলে, কিন্তু মাথার মধ্যে, কানের মধ্যে একটাই শব্দ ঘুরঘুর করছে, ডিনার... কমলকুমার মজুমদারের ‘নিম অন্নপূর্ণা’ গল্পে প্রতিবেশী ভিখিরিকে খুন করে তার চাল চুরি করে সন্তান আর স্বামীকে ভাত রান্না করে খাওয়ায় প্রীতিলতা। ছবিতে সেই নারী শেষ পর্যন্ত নিজে না খেয়ে বমি করে ভাসিয়ে দেয় সিনেমার পরদা। এত ক্ষণে বুঝলাম, এতেই যত গোল পাকিয়েছে।
১৯৮২ সালের ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভাল। সত্যজিৎ রায় জুরি। ‘গৃহযুদ্ধ’ আছে প্রতিযোগিতায়, অরবিন্দনের ‘কুমাটি’ অন্য একটি বিভাগে। সন্ধে হলে অরবিন্দনকে আটকানো যেত না। মদ ও অনুষঙ্গ নিয়ে পরিপাটি করে বসত, তার পর গ্লাসে আঙুল চুবিয়ে চারদিকে মদ ছিটিয়ে আচমন করে প্রথম চুমুক দিত। এক চুমুকে গ্লাস শেষ। তার পর উঠে দাঁড়াত অরবিন্দন। সর্বসাকুল্যে তিনটি রবীন্দ্রসংগীত ও জানত, শুরু করত তারই একটা দিয়ে আর তার সঙ্গে নাচ। রবীন্দ্রসংগীত থেকে সাঁ করে ঢুকে পড়ত রহস্যময় মালয়ালি গানে, যার মর্ম ও-ই বুঝত। আমি দেখতাম ওর নাচ। একদম শিশুর মতো ছিল অরবিন্দন। কথা প্রায় বলতই না। ওর বিখ্যাত ইন্টারভিউয়ের কথা তো সবাই জানেন, যেখানে ইন্টারভিউয়ার প্রায় এক প্যারাগ্রাফের প্রশ্ন করছেন আর অরবিন্দন উত্তর দিচ্ছে হ্যাঁ, না, হয়তো। মালয়ালম ভাষায় করা ওর ছবিগুলো এখনও পর্যন্ত শুধু সে ভাষারই শ্রেষ্ঠ ছবি নয়, ভারতবর্ষের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সেগুলো চিরকাল মণিমাণিক্য হয়েই বেঁচে থাকবে। ওর সমকক্ষ চিত্রপরিচালকের জন্য মালয়ালম সিনেমাকে বহু কাল অপেক্ষা করে থাকতে হবে। আমরা সবাই একই হোটেলে থাকতাম। মানিকদাকে আগেই বলেছিলাম ওর নাচের কথা। এক দিন আমি আর অরবিন্দন ওঁর ঘরে গেলাম। কিছু ক্ষণ কথাবার্তার পর অরবিন্দন বলল, মানিকদা, জুরিদের সব ফ্রি, তাই না? তাই তো? মানিকদা মাথা নাড়লেন। অরবিন্দন সটান উঠে গিয়ে মানিকদার ফ্রিজ খুলে ছোট ছোট বেশ কয়েকটা হুইস্কির বোতল এনে আমার আর নিজের জন্য দুটো গ্লাসে ঢেলে নিল। আমি তো হতবাক। মানিকদাও কিছু বলতে পারছেন না। অরবিন্দন আবার আচমন করল, তার পর এক ঢোঁকে আধ গ্লাস শেষ করে উঠে দাঁড়াল। গান শুরু করল, সঙ্গে নাচ। এমন দিনে তারে বলা যায়... সে দিন বোধহয় মানিকদার কোনও কারণে মন ভাল ছিল না। জুরি চেয়ারম্যান মারসেল কার্নে নাকি ওঁর নামও শোনেননি, আর আর এক জন জুরি আন্দ্রেই তারকভস্কিও দুর্ভাগ্যবশত সে পর্যন্ত ওঁর কোনও ছবি দেখেননি। মানিকদার পক্ষে আরও মর্মান্তিক ছিল যে, মারসেল কার্নে এসেছিলেন তাঁর পুরুষ সঙ্গী বা প্রেমিককে নিয়ে। নাচ থামিয়ে অরবিন্দন বলল, স্যর, আমি এক জনকে জানি যে রোজ রাত্রিবেলা খেয়েদেয়ে বেরিয়ে যেত। সারা রাত একটা গাছকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে থাকত, গাছটাকেই চুমু খেত, ভোরবেলা ফিরে আসত। তার বাড়ি, গ্রামের লোকজন সব্বাই তাকে মেনে নিয়েছিল! আসলে একটা কিছুর দরকার তো হয়ই, হয় না? সেটা যদি গাছ হয়, ক্ষতি কী?