এ পারের চোখে

যাঁদের গাঁয়ে, স্কুলে আশ্রয় নিচ্ছেন রিফিউজিরা। যাঁরা ‘জয়বাংলা’ বলে খেপাচ্ছেন, আবার ভাত দিচ্ছেন, আবার দেখছেন তাঁদের গণকবর। ১৯৭১। কাতারে কাতারে উদ্বাস্তুতে ধুবুলিয়া ভরে গেল। আমাদের বাড়ির সামনেও শালকাঠের খুঁটি, মুলিবাঁশের বেড়া আর টালির চালার বড় বড় ঘর করে এদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমরা ওদের বলতাম ‘জয়বাংলা’। আমাদের বাড়ির ওপর দিয়ে যুদ্ধবিমান হুশ করে উড়ে যেত আর ও-দেশে বোমা ফেলে ফিরে আসত। আমরা সারা দিন বসে গুনতাম, ক’টা বিমান এল আর গেল। বাড়ির বড়রা সারা দিন বসে রেডিয়োর খবর শুনত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০৩
Share:

১৮ এপ্রিল ১৯৭১-এ কলকাতায় পাক ডেপুটি হাই কমিশনার হোসেন আলি, পাকিস্তানের সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করে বাংলাদেশের হয়ে কাজ করার কথা ঘোষণা করেন। সেই ‘বাংলাদেশ মিশন’-এ ৬১ টাকা সাহায্য করার পর প্রাপ্তিস্বীকারের রসিদ। ২ জুন, ১৯৭১। ছবি সৌজন্য: উৎপল সান্যাল

১৯৭১। কাতারে কাতারে উদ্বাস্তুতে ধুবুলিয়া ভরে গেল। আমাদের বাড়ির সামনেও শালকাঠের খুঁটি, মুলিবাঁশের বেড়া আর টালির চালার বড় বড় ঘর করে এদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমরা ওদের বলতাম ‘জয়বাংলা’। আমাদের বাড়ির ওপর দিয়ে যুদ্ধবিমান হুশ করে উড়ে যেত আর ও-দেশে বোমা ফেলে ফিরে আসত। আমরা সারা দিন বসে গুনতাম, ক’টা বিমান এল আর গেল। বাড়ির বড়রা সারা দিন বসে রেডিয়োর খবর শুনত। পাড়ার অনেকে এসে খবর নিত। এমনকী জয়বাংলারাও আমাদের বাড়িতে জেঠতুতো দাদা বা বাবাকে এসে জিজ্ঞেস করত, ‘ও দাদা, আইজগো যুদ্ধের কী খবর? কেউ কেউ গান গেয়ে ভিক্ষা করত, ‘ইয়াহিয়া খাঁ মারছে ঠেলা/ বসেছে জয়বাংলার মেলা’!
সকালে জয়বাংলাদের গরম গরম গোলা সয়াবিন পাউডার দুধ (আমরা বলতাম আমেরিকান দুধ) আর পাউরুটি দেওয়া হত। আমি তখন ছোট। বাতাসে দুধ জ্বালের গন্ধ পেলেই বাটি হাতে আমি আর আমার ভাই লাইনে দাঁড়িয়ে যেতাম। আমরাও যে ভীষণ গরিব ছিলাম! যারা এ সব দিত তারা কেউ কেউ বলত, ‘তোরা জয়বাংলা না, তোদের দেওয়া যাবে না।’ দুধের প্যাকেটগুলো ছিল কাগজের। চেয়ে এনে বইয়ে মলাট দিতাম, ঘুড়ি বানাতাম। অবশ্য সে ঘুড়ি উড়ত না। আর আনতাম আমেরিকান চাল। তাকে বলতাম হুক চাল। আসলে গম চুর, যাকে বলে ডালিয়া। জলে ভেজালেই সুন্দর ফুলে উঠত। সামান্য নুন, চিনি দিয়ে খেতাম।
সে সময় জয়বাংলার লোকেরা দুটো জিনিস বোধহয় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। এক, চোখের রোগ। দুই, মাছ। তখন থেকেই কনজাংটিভাইটিসের নাম হল জয়বাংলা। তখন আমাদের সবার চোখে জয়বাংলা হল। আর জয়বাংলারা জলে হাত দিলেই যেন মাছ উঠে আসত। ওরা নদী খাল বিল থেকে প্রচুর মাছ ধরে নিয়ে আসত। নিজেরা খেত, আর রাস্তায় যেখানে সেখানে বসে বিক্রি করত। আমরা ওদের ছড়া কেটে বলতাম, ‘জয়বাংলার লোক ঢেলা ঢেলা চোখ/ ভাতের দিকে যেমন তেমন মাছের দিকে ঝোঁক।’ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ক’দিন পরেই জয়বাংলারা চলে গেল। আমাদেরও আমেরিকান দুধ, চাল খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল।

Advertisement

শিবশঙ্কর দাস, ধুবুলিয়া

Advertisement

১৯৭০। আমি তখন ক্লাস ফাইভ। নদিয়ার প্রান্তে কৃষ্ণনগর-করিমপুর পাকা রাস্তার ধারে আমাদের নন্দনপুর স্কুল। রাস্তা দিয়ে সারি সারি মিলিটারি গাড়ি আসে যায়। আমরা ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হাত নাড়তাম ওদের দিকে। হাত নেড়ে সাড়া দিত ওরাও।

স্কুলের এক কিলোমিটারের মধ্যেই বর্ডার। ও দিকে পূর্ব পাকিস্তানের শোলমারি, এ দিকে নন্দনপুরে বিএসএফ ক্যাম্প। এক সকালে স্কুলের শিক্ষকদের সঙ্গে মিছিল করে শোলমারি হয়ে কাথুলি পর্যন্ত গেলাম। রীতিমত স্লোগান দিয়ে— ‘ইয়াহিয়ার কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও!’ কাথুলি স্কুলের সামনে থামতে বলা হল আমাদের, আর এগোনো যাবে না। এখো গুড়ের শরবত আর বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ন করা হল। আবার মিছিল করে ফিরে এলাম।

১৯৭১। যুদ্ধ শুরু হল। নন্দনপুর কাঁঠালিয়ার অনেক আমবাগানে সেনাছাউনি পড়ল। এখান থেকে মর্টারের শেলিং হত। রাতের দিকেই বেশি। বিকট শব্দে টিনের ঘর ঝনঝন করে উঠত। নন্দনপুর বিএসএফ ক্যাম্পের পাশে, বাংলাদেশ বরাবর ট্রেঞ্চ খোঁড়ার জন্য গ্রামের প্রতি পরিবারের এক জনকে যেতে হত। চার দিকে একটা ভয়ের পরিবেশ। মিলিটারি গাড়ির আসা-যাওয়া বেড়ে গেল। পূর্ববঙ্গের মেহেরপুরে তখন ঘোর যুদ্ধ। হাজার হাজার শরণার্থী আসতে শুরু করল। বাস-ট্রেন সব বন্ধ, মাইলের পর মাইল হেঁটে চলেছে মানুষের ঢল, খিদেতেষ্টায় ক্লান্ত। সমস্ত স্কুল-কলেজ, ক্লাবঘর, মন্দির-মসজিদ ভরে গেল শরণার্থীতে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অচিরেই শুরু হল ব্যাপক হারে কলেরা।

নন্দনপুর হাসপাতালের মাঠে প্রতি দিন কয়েকশো অসুস্থ মানুষের ভিড়। অত মানুষকে স্যালাইন বা ওষুধ দেওয়া সম্ভব হত না। পাড়ার দাদারা লেবু-লবণজল খাইয়ে অনেককে সুস্থ করে তুলেছিল। তবুও অনেক মানুষ মারা যেতে থাকল। ধনেখালি বিলের ধারে বড় বড় গর্ত করে পাড়ার যুবকরা কুড়ি-পঁচিশটা করে মৃতদেহ গণকবর দিত। এক দিন রাত আটটার দিকে দশ-বারো জনের একটা দল এসে দুর্গামন্দিরে আশ্রয় নিল। বাড়ি-বাড়ি চালডাল তুলে তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করা হল। বেশি রাতের দিকে তাদের দলের বছর পাঁচেকের একটা ছেলের ভেদবমি শুরু হল। সকালে আমরা গিয়ে দেখি, মৃত বাচ্চাটাকে ফেলে ওর বাবা-মা সবাই চলে গেছে, বাচ্চাটার সৎকারের ব্যবস্থা না করেই, কলেরার ভয়ে।

যুদ্ধ শেষ হল এক দিন। আমাদের স্কুল খুলল। রাস্তার দু’পাশে তখন অসংখ্য মৃত মানুষের মাথার খুলি পড়ে আছে ইতস্তত। উৎকট গন্ধে রাস্তা দিয়ে হাঁটা যেত না। আমরা ছেঁড়া কাপড়ে সেন্ট মাখিয়ে স্কুলে যেতাম। তার পর এল বন্যা। সব ভাসিয়ে দিয়ে গেল। বড়রা বললেন, মানুষগুলোর গতি হল একটা। ভগবান ওদের গঙ্গাপ্রাপ্তির ব্যবস্থা করলেন।

পরিমল বিশ্বাস, গোপালপুর, করিমপুর

বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হল, আমরা ঠিক করলাম মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়াব। ক’দিন ধরে পাড়ায় ঘুরে ঘুরে, শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় থেকে টাকা তুললাম। স্থানীয় স্কুলের শিক্ষকরা ৫০ টাকা চাঁদা তুলে আমাদের দিলেন। আমরা চার বন্ধু বেশ কিছু ব্যাটারি, ব্যান্ডেজ, ওষুধ আর বাদবাকি টাকা নিয়ে দমদম থেকে সকাল সাড়ে ছটার বনগাঁ লোকাল ধরলাম। বনগাঁয় নেমে কিছুটা হেঁটে কিছুটা রিকশায় হরিদাসপুর সীমান্তে পৌঁছলাম। চারপাশে লোক থিকথিক করছে। অস্থায়ী তাঁবুতেও অনেকে। মূল প্রবেশপথের কিছু দূরে একটা খাল পেরিয়ে ও-পার বাংলার মাটিতে পা রাখলাম। এর পর যশোর রোড ধরে সোজা পুব দিকে হাঁটা। জায়গায় জায়গায় আওয়ামি লিগের অফিসে মানুষ জমায়েত হয়ে উত্তেজিত আলোচনা করছেন, চারদিকে বাংলাদেশের স্বাধীন পতাকা উড়ছে। অনেক জায়গায় মুজিবরের পোস্টার। আমাদের সঙ্গের জিনিসপত্র দেখে একটা বড় অফিস থেকে অনুমতিপত্র দেওয়া হল, কম্যান্ডার সই করে দিলেন। হাঁটতে হাঁটতে সাসরা বাজারে এলাম দুপুর একটায়। চারপাশ ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে ভরপুর। একটা পরিত্যক্ত রেলপথ ধরে দলে দলে মানুষ বোঁচকাবুঁচকি নিয়ে ভারত সীমান্তের দিকে আসছেন। যত বাংলাদেশের ভেতর ঢুকছি, পুব দিক থেকে গোলাগুলির আওয়াজ বেড়েই চলেছে। নাভারণে পৌঁছলাম বেলা চারটেয়। দোকানপাট প্রায় বন্ধ। রাস্তার পাশে বড় অফিস মুক্তিযোদ্ধাদের। কয়েক জন সামরিক পোশাক পরে রাইফেল ও মেশিনগান নিয়ে পাহারা দিচ্ছেন। অফিসে সব জিনিসপত্র দিয়ে দিলাম। ওঁরা খুব খুশি। আমাদের ডাবের জল, নাড়ু, বাতাসা খাওয়ালেন। রাস্তায় ব্যারিকেড গড়ার প্রস্তুতি চলছে, বড় বড় গাছ কেটে রাখা। ওঁরা বললেন, এখানে থেকো না, মাত্র ক’মাইল দূরে কপোতাক্ষ নদীর ব্রিজের দু’ধারে খানসেনাদের সঙ্গে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল্‌স আর মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। শুনতেও পেলাম ট্যাট ট্যাট করে মেশিনগান, ফটাফট রাইফেল, মাঝে মাঝে গুমগুম রকেটের শেলের ভারী আওয়াজ। একটা জিপ এল, তাতে রক্তমাখা কয়েকজন হতাহত। ঊর্ধ্বশ্বাসে ভারতের দিকে চলে গেল সেটা। বেলা প্রায় পাঁচটায় কোত্থেকে একটা ট্রেকার এল, ওঁরা তাতে আমাদের ঢুকিয়ে দিলেন। বেনাপোল হয়ে বনগাঁ পৌঁছলাম রাত আটটায়। এর মাত্র ক’দিনের মধ্যেই বোমা ফেলে আর ট্যাংকের গোলা ছুড়ে পাক বাহিনী বেনাপোল অবধি দখল করে নিয়েছিল।

উৎপল সান্যাল, সাউথ সিঁথি

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement