মিকা বসে আছে অনেক ক্ষণ। একটু অপ্রস্তুত, আড়ষ্ট, ওর স্বাভাবিক আত্মবিশ্বাসটা যেন ওকে ছেড়ে গেছে, যদিও শিরায় শিরায় অ্যালকোহলের চনচন। এই বসে থাকাটা একদম বোকা বোকা, ভেবে হঠাৎ করে বেশ একটু জোরেই গলা খাঁকারি দিয়ে মিকা জিজ্ঞাসা করল, ‘কী নাম তোমার?’
‘তুমানিনির মা।’ চোখ না তুলে, তার বাচ্চাটাকে মেঝেতে মাদুরের উপর ঘুম পাড়াতে পাড়াতেই মেয়েটি উত্তর দিল। বাচ্চাটা আচমকা কাশতে শুরু করল। ভয়ানক কাশি, কাশির দমকে ছোট্ট শরীরটা ঠেলে ঠেলে উঠছিল।
সামনে ঝুঁকে মিকা বাচ্চাটাকে ছুঁল। বেশ জ্বর। ‘ডাক্তার দেখিয়েছ?’ এত ক্ষণে অন্য কিছু একটা কথা বলতে পেরে ওর নিজেকে একটু হালকা লাগছিল।
‘ডাক্তারখানায় একটা অ্যাসপিরিনও মেলে না।’
মায়ের চেষ্টায় তুমানিনি একটু শান্ত হল। আস্তে আস্তে ঘুমিয়েও পড়ল, যদিও শ্বাসপ্রশ্বাসের ঘড়ঘড় আওয়াজটা তখনও চলছে। তুমানিনির মা গায়ে হালকা একটা খাঙ্গা জড়াল, তার পর মশার ধূপ জ্বালল একটা। ধূপের ধোঁয়া পাকিয়ে পাকিয়ে উঠতে লাগল মাদুরের দিকে। বাচ্চাটা নড়ে উঠল, হাঁচতে লাগল। হাঁটু মুড়ে বসে, বাচ্চাটার পিঠে হালকা চাপড় মেরে মা ফের ওকে ঘুম পাড়াল। সঙ্গে বিড়বিড় করে বলছিল, ‘ভগবান, আমার সোনাকে সুস্থ করে দাও। মা’র ছোট্ট সৈনিককে শক্তি দাও, স্বাস্থ্য দাও।’
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী
‘সৈনিকরা যেমন কক্ষনও না খেয়ে থাকে না, অসুস্থ হয় না, ঠিক সেই রকম’, এমন সরল, সহজ ভাবে ও বলে যাচ্ছিল, যেন একটা শিশু কথা বলছে।
‘ঠিক। সৈন্যরা না খেয়ে থাকে না’, মিকা বলল, ‘কিন্তু ওরা মারা পড়ে।’
মেয়েটা সপাটে বলল, ‘এত কষ্ট সহ্য করার চাইতে মরে যাওয়াই ভাল। অসুখ আর খিদেয় জ্বলেপুড়ে তিলে তিলে মরার চেয়ে স্রেফ মাথায় একটা গুড়ুম— ঢের কাজের।’
মিকা একটু জোর গলায় বলল, ‘সৈনিকদেরও খালি পেটে থাকতে হয়, যখন খাবারদাবার কিছুই থাকে না।’
মেয়েটা তখন কী ভাবছে গভীর ভাবে, মনে হল যেন ওর কথা শোনেইনি। তার পর যেন ঘরে আর কেউ নেই, নিজেই নিজেকে বলছে এমন ভাবে আস্তে আস্তে বলল, ‘তুমানিনির বাবাও ছিল সৈনিক।’
‘ছিল মানে...?’
‘হ্যাঁ, ষাঁড়ের মতো একটা মদ্দা, ওর জুড়ি কেউ ছিল না। জীবনটা তখন অনেক সহজ ছিল। আমার কাছে, আমার মায়ের কাছে, আমাদের সবার কাছেই ও ছিল বাবার মতো। আর আজ, বেঁচে থাকাটাই মস্ত কঠিন। একটা ছোট জিনিসের জন্যও লড়াই করে মরো। প্রত্যেকটা জিনিসের দাম চোকাতে হবে রক্ত দিয়ে, অবশ্য যদি পাও। তুমানিনির বাবা এখন থাকলে...’ ওকে দেখে মনে হচ্ছিল এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে, কিন্তু ও কাঁদল না।
‘উনি কি মরে গেছেন?’ মিকা চেঁচিয়ে বলল। ওর স্রেফ জানার কৌতূহল হচ্ছিল, মেয়েটার একঘেয়ে কষ্ট ওকে স্পর্শ করছিল না।
‘আমি কথা বলতে চাই না। আমায় কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না।’ মেয়েটা ককিয়ে উঠল, তার পর কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘ও যুদ্ধে গেছে, উগান্ডায়। হয়তো বেঁচে আছে, কী জানি, হয়তো না...।’
মিকা কিছু বলল না। তুমানিনিও একদম চুপ, ওর পিঠে ওর মায়ের আনমনা হাত তখনও চাপড় মেরে যাচ্ছিল। একটু পর তুমানিনির মা উঠল। ঘরের ছোট্ট আলোটা নিভিয়ে দিল। অন্ধকারের মধ্যেই, নীরব আজ্ঞাবহর মতো নিজেকে সঁপে দিল মিকার কাছে। যেন কর্তব্য করছে পাক্কা পেশাদারের মতো। পরে, মেয়েটার শরীরের ওপর থেকে নেমে যাওয়ার পরও মিকার মনে হল না যে ও জিতে গেছে। মেয়েটাকে পুরো পাওয়ার পরও ও কেমন গুমরে শুয়ে থাকল। মাদুর থেকে ভেসে আসা, কষ্টকর শ্বাসপ্রশ্বাসের আওয়াজ ওকে আরও চুপসে দিচ্ছিল।
কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, ও জানেই না। জেগে উঠল একটা আতঙ্ক নিয়ে: ও কোথায় আছে, বুঝতে পারছিল না। তার পর যখন তুমানিনির মা’র শরীরটা ওর পাশে আবিষ্কার করল, তখন মনে পড়ল।
বিছানা থেকে উঠে একটা সিগারেট ধরাল। মশার ধূপটা শেষ হয়ে গেছে, মশাগুলোর রাগী পিনপিন চার দিকে। অন্ধকারে ভুরু কুঁচকে বসে রইল ও, একটা অস্বস্তি তাড়া করে বেড়াচ্ছে, কিন্তু বুঝতে পারছে না সেটা ঠিক কী। ঘরের নীরবতাটা হঠাৎ করে কেমন চেপে ধরল।
গলা শুকিয়ে গেছে। মাথা দপ দপ। সিগারেট নিভিয়ে বিছানা ছেড়ে মিকা মাদুরের কাছে গেল। বাচ্চাটা নিশ্চুপ, অন্ধকারের মধ্যে শুধু একটা নিঃশব্দ হালকা কুয়াশা। ও সাহস করে আলো জ্বালতে পারল না। বাচ্চাটার দিকে হাত বাড়াল। চোখটা এখন সয়ে এসেছে। ছোট্ট শরীরটা, প্রাণহীন, ঠান্ডা। ও ঠায় তাকিয়ে রইল। ভোরের প্রথম আলোয় শরীরটা আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
তুমানিনির মা নড়ে উঠল, খানিক বিড়বিড়িয়ে ফের তলিয়ে গেল ঘুমে। মিকা অপেক্ষা করল কিছু ক্ষণ, ওর শ্বাসপ্রশ্বাস ঘন হয়ে এলে, বিছানায় বসে হালকা চালে আবার একটা সিগারেট ধরাল।
তার পর, আস্তে আস্তে উঠে ওর জামাকাপড়গুলো কুড়িয়ে নিল, মদের ঘোরে উপুড়ঝুপুড় ফেলে ছড়িয়ে রেখেছিল যেগুলো। পরবার পর থমকাল একটু। না চাইতেই চোখ চলে যাচ্ছে বাচ্চাটার দিকে। নাঃ, এক্ষুনি চলে যেতে হবে, ও নিজেকেই তাড়া দিল। সকাল হয়ে গেলে আবার বাচ্চাটার সৎকার-টৎকার, সে মহা ঝক্কি। খামকা দেরি, কোনও মানেই হয় না। আর, বাচ্চাটার বা তার মা’র কী হল না হল তাতে ওর কী? যন্ত্রের মতো ও পার্স থেকে অনেকগুলো নোট বের করল আর গোনার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে টাকাটা বিছানার পাশে একটা টুলের ওপর রাখল। কুপিটা দিয়ে চাপা দিল টাকাটা।
হুড়কোটা খুলতে গিয়ে দরজাটা ক্যাঁচকোঁচ করে উঠল। ও থামল একটু, বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ি পিটছে, কান দুটো খাড়া, বিছানার দিকে।
তুমানিনির মা নড়ে উঠল। ‘এখনই চলে যাচ্ছেন?’ ‘হ্যাঁ’, ও বলল। ‘এত তাড়াতাড়ি?’ ‘এখানে গাড়ি পাওয়া মুশকিল, আর আজ বাইরে যাওয়া আছে।’
যে করেই হোক, আজ রাতের মধ্যে ওকে দার-এস-সালাম’এ পৌঁছতেই হবে। গত দু’দিন ধরে এই ছোট রুক্ষ শহরটায় আটকা পড়ে আছে। পেট্রোলের অভাবে সব গাড়ি থমকে, তাই আটকে-পড়া লক্ষ যাত্রীর ভিড়ে শহরটা ঠাসা। গাড়ির জন্য হদ্দ হয়ে ঘুরে বেড়ানো এই ঘেমো পিলপিল লোকের হাত থেকে বাঁচতেই ও আগের দিন একটু ফুর্তির খোঁজে বেরিয়েছিল। মদই ছিল এই হতাশার সাচ্চা ওষুধ। বিয়ার ওর দারুণ পছন্দের, কিন্তু কোত্থাও পাওয়া যাচ্ছিল না। কোনও দোকানেই বিয়ার নেই। প্রথম যে বার-এ ঢুকল, সেখানেই শুনল, শহরে ঢোকার মুখে ব্রিজটায় বিয়ারের ট্রাকটা অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। গাড়িটা এখন রদ্দি লোহা শুধু, ওখানেই পড়ে আছে। মিকা গোড়ায় বিশ্বাস করেনি, যদিও এটাই হয়তো সত্যি। এক বোতল বিয়ারের জন্য ও যা খুশি তা-ই করতে পারে। ও সারা শহর ঘুরল। বেশি সময় লাগল না, কয়েকটা বাস স্টপ ছাড়া এই শহরে আর আছেই বা কী!
শহরটার মধ্যিখান দিয়ে ধুলো-ভরা, সরু, বাজে-দেখতে কতকগুলো গলি। তার ও-পারে সব বস্তি। হন্যে হয়ে খুঁজেও বিয়ার পাওয়া গেল না, সব জায়গায় মিলছে শুধু পম্বে। লোকাল মদ খেতে ওর মোটেও ইচ্ছে ছিল না, তবু খেল, খুব ঘেন্না নিয়ে, একটু একটু করে। নেশাটা ধরতে একটু সময় নিলে ও দেখল যে হতাশাটা একটু কেটেছে। এমনকী খুশ হয়ে কাছের টেবিলে এক দল মদাড়ুর সঙ্গে ভিড়েও গেল। কিন্তু সন্ধে নামতেই হঠাৎ দেখল ও একা, সঙ্গীরা অন্য কোনও ঠেক বা ঘরের দিকে রওনা দিয়েছে। সেও উঠে পড়ল, রাতভর ঘুরতে লাগল। কিছুতেই মনে করতে পারছে না যে কী ভাবে ও তুমানিনির মা’র ঘরে এসে পড়ল, বা কেন হঠাৎ ভাবল, হোটেলের ঘরে সারা রাত কিছুতেই একা থাকতে পারবে না। এক জায়গায় ঘর ভাড়া নিয়ে আর এক জায়গায় রাত কাটিয়ে দেওয়া, বেশ হাস্যকর ব্যাপার। বাজে খরচা, আর কী!
তুমানিনির মা বলে যাচ্ছিল, ‘আর একটু কি বসা যায় না, একটু চা করে দিতাম?’ মিকা তা একেবারেই চাইছিল না, মেয়েটা উঠতে গেলেই তো মরা শরীরটা দেখে ফেলবে। এক্ষুনি বেরিয়ে পড়া দরকার। সে তাড়াতাড়ি বলল, ‘না না। হোটেলে আমার জিনিসপত্র আছে। তৈরি হতে হবে। কোথাও ঠিক খেয়ে নেব।’
মেয়েটা পাশ ফিরে বলল, ‘যা ভাল বোঝেন!’ তার পর, প্রায় শোনা যায় না এমন মৃদু স্বরে ওকে শুভ যাত্রা জানাল। অপরাধীর মতো মুখে, তোতলাতে তোতলাতে মিকা বলল, ‘তোমার টাকাটা... আমি... টুলটার ওপর রেখেছি।’ কিন্তু মেয়েটা সাড়া দিল না। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে, বা ভাবছে, আর কথা বাড়িয়ে দরকার নেই, যথেষ্ট হয়েছে।
দরজা খুলে, দ্রুত, ত্রস্ত পায়ে মিকা বাইরে বেরিয়ে এল। বাড়িগুলোর মাথায় সকালের আলো এসে পড়ছে তখন। উনুনের ধোঁয়া ঢেকে দিচ্ছে বস্তিগুলোকে। আর একটা দিনের শুরু।
ssindrani71@gmail.com