রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ৪

একটা ভয় [কষ্ট] লজ্জা

হঠাৎ কলিং বেল। বেল বাজলে আমরা আতঙ্কিত হয়ে উঠতাম। যে বাড়ির দরজা হাট করে খোলা থাকে সারা ক্ষণ, সে বাড়িতে কে বেল বাজাল? গরমের ছুটি চলছে। তখন বেলা দুটো হবে। দাদা জেঠিমার কাছে প্রচণ্ড বকুনি খাচ্ছে কারণ বারান্দার এক ফালি রোদে জেঠিমা এক টুকরো সাদা কাপড়ের ওপর নুন-হলুদ মাখানো কাঁচা আম শুকোতে দিয়েছিলেন আচার করবেন বলে।

Advertisement

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ২২:৩১
Share:

হঠাৎ কলিং বেল। বেল বাজলে আমরা আতঙ্কিত হয়ে উঠতাম। যে বাড়ির দরজা হাট করে খোলা থাকে সারা ক্ষণ, সে বাড়িতে কে বেল বাজাল? গরমের ছুটি চলছে। তখন বেলা দুটো হবে। দাদা জেঠিমার কাছে প্রচণ্ড বকুনি খাচ্ছে কারণ বারান্দার এক ফালি রোদে জেঠিমা এক টুকরো সাদা কাপড়ের ওপর নুন-হলুদ মাখানো কাঁচা আম শুকোতে দিয়েছিলেন আচার করবেন বলে। সেই আম দাদা না দেখে মাড়িয়ে দিয়েছে। সব মিলিয়ে তখন বাড়ি জুড়ে লীলা মজুমদার টাইপ জমজমাট ভাব।
সেই সময় খোলা দরজায় এক বছর সত্তরের বৃদ্ধা। ‘এই যে শুনছেন?’ ক্ষীণ গলায় ডাকতেই জেঠিমা বললেন, ‘শুনুন, আমাদের সাবান, পেস্ট, ডিটারজেন্ট পাউডার সব আছে আর এখন মাসের শেষ, আমরা কিছু নেব না।’ মহিলার মুখটা আহত। বললেন, ‘না না আমি তা বলিনি।’ একটু বিহ্বল চাউনি। ভীত। রান্নাঘরের দরজার সামনে মা’কে দেখে বললেন, ‘এক বার শুনবেন?’ মা এগিয়ে গেলেন, সঙ্গে আমিও। ‘ইয়ে, মানে, আমায় এক গ্লাস জল দেবেন?’ মা জল দিলেন। মহিলা খেলেন। তার পরেও একটু ইতস্তত ভাব। যাঁরা সাবান বিক্রি করতে আসেন, এঁর তাঁদের মতো চেহারা নয়। মা-জেঠিমার মতোই শাড়ি, কেবল একটু মলিন। কিছু যেন বলতে চান। মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি বাথরুম যাবেন?’ ‘হ্যাঁ, গেলে একটু ভালই হত।’ বাথরুমে গেলেন। বেরিয়ে এলেন চোখেমুখে জল দিয়ে। তবু যেন কিছু বলার থেকে গেল। কিছুতেই যেন চলি চলি করেও পা চলে না। ‘আপনার কি বাসভাড়া লাগবে? ব্যাগ হারিয়েছে? আমাদের বাড়িতে অনেকে এ রকম আসেন। আপনার লজ্জার কিছু নেই’, মা বললেন। মুখ নীচু করে কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মুখটা যখন তুললেন তখন দেখলাম দু’চোখে জল। এ বার খুব আস্তে বললেন, ‘আমায় কিছু খেতে দিতে পারেন? আমার না, খুব খিদে পেয়েছে।’ গলায় একটা আর্তি। যেন এখুনি না খেতে দিলে উনি পড়ে যাবেন। মা তক্ষুনি খেতে দিলেন ওঁকে। মহিলা যত ক্ষণ খেলেন মাথাটা নীচু, আর শাড়ির খুঁটে চোখ মুছলেন। মা তরকারি-ডাল কিছু দিতে গেলে কেবল মাথা নেড়ে জবাব দিলেন। খাওয়ার শেষে অনেক কষ্টে বললেন, ‘জানেন, পেটের না বড় দায়। না খেয়ে থাকতে পারি না। কাল দুপুরে খেয়েছিলাম।’ খুব সংযত আরম্ভ করেও প্রায় হাঁউমাউ করে কেঁদে ফেললেন।
‘বিশ্বাস করুন, আমার না, এ অবস্থা হওয়ার কথা নয়। উনি খুব বড় চাকরি করতেন। নাকতলায় বাড়ি আমার। মাস দুই আগে বড় খোকা, ছোট খোকা বলল, বাড়ির এক্সটেনশন করতে হবে, কর্পোরেশনের পারমিশন চাই। তোমার নামে থাকলে হবে না। আমাদের নামে বাড়ি লিখে দাও। অনেক ছোটাছুটি আছে। দিলুম। তখন কি জানতাম মা, আমার কপালে এই নাচছে। এক দিন হঠাৎ বড় বউমা, ছোট বউমা আমায় এক কাপড়ে বার করে দিল। বড় খোকা, ছোট খোকা ভেতরের ঘরে থাকল, এক বার এল না, কিছু বললও না। আমায় কী বলল জানো? বলল, ভিক্ষে করে খাও। আমার বাবা আমায় পঞ্চাশ ভরি সোনা দিয়ে বিয়ে দিয়েছিল। উনি আমায় রানি করে রেখেছিলেন। আমি কি পারি ভিক্ষে করতে? এ আত্মীয় ও আত্মীয় করে মাস দুই থাকলাম। আর কেউ রাখতে রাজি নয়। তুমি মা লক্ষ্মী তাই খেতে দিলে। অন্যরা তো ঝাঁইঝাঁই করে চোর বলে তাড়িয়ে দেয়।’
অনেকগুলো ফোঁপানোর আওয়াজ বাড়িময় অনেক ক্ষণ ছিল সে দিন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন