একটা ভয় কষ্ট [লজ্জা]

প্লেনে ওড়ার তেমন উত্তেজনা নেই, প্রথম বার যেমনটা ভেবেছিলাম। কেবল বোর হও, সিট বেল্ট খোলা-বন্ধ করো, ছোট ইকনমি সিটে বসার দরুন পাশের লোকের সঙ্গে ক্রমাগত কনুই ঠেলাঠেলি খেলো, বোতাম টিপে এয়ারহোস্টেস ডেকে জল চাও, আর ফের বোর হও। এমনই এক প্লেন যাত্রা, যা আবার কিনা স্বদেশি আকাশে নয়, বিদেশি আকাশ, এবং সাহেবসুবো মানুষদের সঙ্গে উড়তে চলেছি।

Advertisement

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০৩
Share:

প্লেনে ওড়ার তেমন উত্তেজনা নেই, প্রথম বার যেমনটা ভেবেছিলাম। কেবল বোর হও, সিট বেল্ট খোলা-বন্ধ করো, ছোট ইকনমি সিটে বসার দরুন পাশের লোকের সঙ্গে ক্রমাগত কনুই ঠেলাঠেলি খেলো, বোতাম টিপে এয়ারহোস্টেস ডেকে জল চাও, আর ফের বোর হও।

Advertisement

এমনই এক প্লেন যাত্রা, যা আবার কিনা স্বদেশি আকাশে নয়, বিদেশি আকাশ, এবং সাহেবসুবো মানুষদের সঙ্গে উড়তে চলেছি। ঠাঁইঠাঁই ইংরেজিতে সিট বেল্ট বাঁধার আদেশ দেওযার আগেই আমি সিট বেল্ট বেঁধে নিয়েছি। খানিকটা নেই কাজ তো খই ভাজ গোছের অবস্থা। কিছু করার নেই তো সিট বেল্টটাই বেঁধে নিই। বসে আছি চুপচাপ। মেজাজ গরম, কারণ তিনটে সিটের মধ্যে আমার আবার পড়েছে মাঝখানের সিট। দুটো আখাম্বা সাহেবের মাঝখানে সরলরেখার মতো বসে রয়েছি। ডান দিকে তাকিয়ে দেখলাম ইইয়া চেহারার এক জন মাঝবয়সি সাহেব। আর বাঁ দিকে ধোপদুরস্ত সুট পরা লম্বা-চওড়া সাহেব। ডান দিকের মাঝবয়সি সাহেব বোধ হয় খুব জ্ঞানীগুণী লোক। প্লেনে ওঠা মাত্র পড়াশোনা করতে শুরু করেছেন। হাতে আবার একটা পেনসিল। দাগ দিচ্ছেন।

সিট বেল্ট বাঁধার নির্দেশ এল। ডান দিকের পড়ুয়া সাহেব এ বার ব্যস্ত হয়ে তাঁর সিট বেল্ট খুঁজতে লাগলেন। এ দিক খোঁজেন, ও দিক খোঁজেন। কিছুতেই একটা সামান্য সিটবেল্ট আর খুঁজে পান না। মনে মনে ভাবছি, এই তো আমেরিকান সাহেবদের স্মার্টনেস, তাতেই এদের এত ফটর ফটর। সাহেব ভদ্রলোক এ বার উদ্বিগ্ন। কিছুতেই বুঝতে পারছেন না, তাঁর এক দিকের সিট বেল্ট কোথায় গায়েব হল। আমি ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি নিয়ে দেখছি ওঁকে। আমার বাঁ পাশের ধোপদুরস্ত সাহেবও এক বার দেখে নিলেন। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার অফারও দিলেন। কিন্তু কাকে সাহায্য করবেন, সিট বেল্টই তো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

Advertisement

প্লেন একটু একটু এগোচ্ছে। এয়ার হোস্টেস এসে এক বার শাসিয়ে গেল। মাঝবয়সি পড়ুয়া সাহেব বেচারা এ বার বিপন্ন। কোথাও খুঁজে পাচ্ছেন না বেল্টটা। আমার একটু মায়াই হল। সাহায্য করব কি না ভাবতে গিয়ে দেখি, আমার সিট বেল্ট-এ টান পড়ছে। হাঁহাঁ করে বলতে গেছি, ‘মশায় আপনি আমার সিট বেল্ট নিয়ে টানাটানি করছেন কেন?’, তখনই জগৎসংসার আলো করে তিনি প্রতীয়মান হলেন, মানে আমার বোধ। বুঝলাম, আমিই ওঁর সিটবেল্ট আমার সিট বেল্টের সঙ্গে বেঁধেছি। এবং আমার জন্য বরাদ্দ সিট বেল্টের একটির ওপর অম্লানবদনে বসে আছি। একে আপনভোলা, তায় পাশে মহিলা, তিনি তো আর আমার বেল্টটি টেনে দেখতে পারেন না, আমি ভুল করেছি কিনা! আমি বুঝতে পেরে তো চিত্তির!

সরি’র বন্যা বইয়ে দিলাম। তিনিও বললেন, ‘ইট’স ওকে।’ কিন্তু এ বার আমার তাচ্ছিল্যের হাসি ট্রান্সফার হয়ে গেল দুই সাহেবের মুখে আর সাহেবের বিপন্নতা আমার লজ্জায় বাসা বাঁধল। সমানে নিজেকে দুষতে লাগলাম, ‘ছি ছি, তুই এই কাজ করলি! তুই কী ক্যাবলা রে! তোর তো প্লেনে চড়াই উচিত নয়!’ কিন্তু তূণীর থেকে তো তির বেরিয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করে থাকলাম সারা ক্ষণ। কান গরম, বুক ধড়ফড় আর সাহেবের স্মিত হাসি আমায় লজ্জায় কুচি কুচি করে দিল। ধরণীও কাছাকাছি নেই যে বলব দ্বিধা হও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement