এই ঘটনার সঙ্গে সরাসরি আমার কোনও যোগ নেই। ঘটনাটা মা’র কাছ থেকে শোনা। মায়েদের গ্রামের বাড়িতে বহু লোকজন কাজ করত। কিছু মানুষ জমিতে আর কিছু মানুষ বাড়ির নানা কাজে লেগেই থাকত সব সময়। মায়ের বাবা জমিদার ছিলেন। সম্পন্ন পরিবার। আর তাই বহু লোক আশ্রিতও থাকত। কেউ চার মাস, কেউ চার বছর, কেউ আবার সারা জীবন। তারা সব মায়েদের জীবনের অঙ্গই হয়ে গিয়েছিল।
আমার দাদু বেশ বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন বলেই শুনেছি। সঙ্গে হোমিয়োপ্যাথি পাশ করা ডাক্তার। তাই গ্রামের ছুটকোছাটকা অসুখ, খানিক হোমিয়োপ্যাথি, খানিক অ্যালোপ্যাথি দিয়ে সারিয়ে তুলতে পারতেন। লোকজন শলাপরামর্শের জন্যও আসত তাঁর কাছে। তিনি যে মোটামুটি যে কোনও অবস্থা থেকে তরিয়ে দিতে পারেন, এ রকমটাই গ্রামের লোকের বিশ্বাস ছিল। কেবল অসুখ নয়, জমিজমা সংক্রান্ত বা পরিবারের সমস্যা নিয়েও লোকজন আসত তাঁর কাছে। আর তাই যারা কাজ করত মায়েদের বাড়িতে, তারা দাদুকে ভগবান জ্ঞান করত বলা চলে।
ঘটনাটা ধান ওঠার সময়ের। মাঠে আর ঘরে প্রচুর কাজ। ধান তোলা, ধান ঝরানো, ধান সেদ্ধ করা, ধান মেলা— অনেক কাজ। আর প্রচুর লোকের দরকার। কে কখন এসে কাজ করছে, তার হিসেব তখন অত থাকত না। যে যেমন পারত তেমন কাজ করে দিত।
এদের মধ্যে একটা মেয়ে ছিল, সে সদ্য মা হয়েছে তখন। মাস চার-পাঁচ হবে। তাকে অনেক বারণ করা সত্ত্বেও সে কাজে আসত। বোধ হয় দারিদ্রের তাড়না খুব বেশি ছিল। কিন্তু আত্মসম্মানজ্ঞানও ছিল টনটনে, এমনি সে কোনও উপকার হাত তুলে নেবে না। তাই কাজ সে করবেই। সে দিনও সকালে সে কাজে এসেছিল। দুপুরে বাড়ি গিয়েছিল খেতে, আর বাচ্চাকে এক বার দেখে আসতে। হঠাৎ দেখা গেল সে ঊর্ধশ্বাসে ছুটে দাদুর কাছে আসছে। কোলে শিশুটি। পাগলের মতো কাঁদছে আর বাচ্চাটাকে নাড়াচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে, ‘কত্তাবাবা, একটু দেখুন না, কিছুতেই উঠছে না। সেই সকালে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছিলাম, এখনও গিয়ে দেখি ঘুমোচ্ছে।’
দাদু নাড়ি দেখলেন এবং বুঝলেন শিশুটি আর নেই। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী খাইয়েছিলিস যে এ রকম হয়ে গেল?’ ‘দুধ ছাড়া তো কিছুই খাওয়াইনি।’ তবু দাদু চেপে ধরেছিলেন, ‘তুই সত্যি করে বল তো, সে দিন কী খাইয়েছিলিস ওকে?’ ফুঁপিয়ে উঠে সেই মেয়েটা বলেছিল, ‘ছোট বাচ্চা তো, বার বার দেখতে হয়, খাওয়াতে হয়। অনেক ঝামেলা। বাড়ির অবস্থা তো জানেনই। শাশুড়িও তেমন মানুষ নয় যে বার বার দেখবেন। বউকে গাল পাড়তেই ব্যস্ত। তাই দুধের সঙ্গে রোজ একটু করে আফিম মিশিয়ে দিতাম। বেলা অবধি ঘুমোত। আমি ফিরে গেলে তুলে ওকে ফের খাওয়াতাম, কোলের কাছটিতে নিয়ে শুতাম। সে দিন কী হল কত্তাবাবা, বুঝতে পারলাম না।’
দাদু বলেছিলেন, এ ঘটনা তো ঘরে ঘরে ঘটে। কত মা যে এ রকম করে বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে কাজে বেরোয়, গরিব গ্রামবাংলায় তার হিসেব নেই। তবে, নিশ্চয়ই সে দিন আফিমের পরিমাণ একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল। দুধের শিশু তো, আর সইতে পারেনি।
আমি কোনও দিন দেখিনি সেই মেয়েটাকে বা তার বাচ্চাকে। কিন্তু ওদের দুজনের মুখ দুটো আমি মাঝে মাঝে স্পষ্ট দেখতে পাই। ভেতরটা মুচড়ে ছটফটায়। যন্ত্রণার বোধ হয় একটা অদৃশ্য সাঁকো আছে।