আমার দশ-এগারোয় অমরনাথ দর্শন করতে যাওয়াটা, যাকে বলে বেশ ঘটনাবহুল। আসলে আমি তার আগে তুষার-তীর্থ অমরনাথ সিনেমাটা দেখিনি, তাই আইডিয়া ছিল না। সেখানে নাকি অমরনাথ পৌঁছতে হেভি কষ্ট হয়েছিল লোকজনের। সিনেমাটাও খুব হিট করেছিল।
আসল ঝামেলা হল ফেরার দিন। প্রচণ্ড বরফ পড়ছে, খুব হাওয়া, রোদের দেখা নেই তো নেইই। হাত-পা জমে যাচ্ছে। মোজার ভেতর আঙুলগুলো জুড়ে অলমোস্ট হাঁসের মতো হয়ে গিয়েছে। সে দিনটা কোনও মতে টেন্ট-এ ফিরে এলাম।
পর দিন সকালে উঠে তো চিত্তির। চার দিক সাদা। শাঁইশাঁই হাওয়া দিচ্ছে, সঙ্গে বরফ। ঝাপসা, কুয়াশা, আরও নিশ্চয়ই অনেক কিছু। অত ছোট বয়সেও বিপদ কিংবা অস্বস্তি বুঝতে দেখেছি কোনও অসুবিধে হয় না। দিদির শরীর ভাল ছিল না, তাই ওকে আর বাবাকে কোনও মতে দুটো ঘোড়ায় চাপিয়ে দেওয়া হল। আরও অনেকের সঙ্গে আমি আর মা হাঁটতে শুরু করলাম। মা’র মুখটা থমথমে। এত জোরে আমার হাতটা চেপে ধরেছে যে অত সোয়েটার, জ্যাকেটের ওপর দিয়েও আমার লাগছে।
বেশ কিছু ক্ষণ হাঁটার পর আবহাওয়া একটু যেন শান্ত হল। অন্ধকার ভাবটা একটু কাটল। বরফের ওপরেই একটা দুটো টেন্ট-এ পাহাড়ি কাশ্মীরিরা উনুন বা স্টোভ জ্বালিয়ে চায়ের ব্যবস্থা করেছে। আমরা একটা টেন্ট-এ ঢুকলাম। আমায় ছোট দেখেই বোধহয় উনুনের কাছে আমাকে আর মা’কে ডেকে বসাল। নিজেদের আমরা একটু সেঁকে নিলাম, তার পর করে ফের হাঁটা। হঠাৎ শুনলাম বিকট দুটো দুম দুম শব্দ, তার পরেই দেখি, পাশের পাহাড়ে কিছুটা বরফ সহ দুটো বিশাল পাথরের চাঁই গড়িয়ে পড়ছে। মিনিট খানেকের মধ্যে শুরু হল প্রবল তুষারঝড়। এ দুটোর মধ্যে কোনও কানেকশন ছিল কি না, পাথর খসে পড়া তুষার ঝড়ের পূর্বাভাস কি না, এখনও জানি না।
কিন্তু অমন ঝড় আমি কখনও দেখিনি। আমি আর মা টলছি, এক দিক থেকে অন্য দিকে চলে যাচ্ছি হাওয়ার তোড়ে। মায়ের গায়ে সম্ভবত যত শক্তি ছিল, তত শক্তি দিয়ে আমার হাত ধরে আছে, আর সমানে বলছে, ‘হাত ছাড়বে না, আমায় ছাড়বে না, যত কষ্টই হোক। আমরা ঠিক পৌঁছে যাব।’ আমিও শক্ত করে মা’কে ধরে আছি।
হঠাৎই আমি গড়গড়িয়ে বেশ কিছুটা সরে গেলাম। কোন দিকে বুঝলাম না। হাল্কা একটা অনুভূতি। কয়েক সেকেন্ড। আর তখনই বুঝলাম আমার হাতটা ছেড়ে গিয়েছে মা’র হাতের মুঠো থেকে। মা আমায় ডাকছে শুনতে পাচ্ছি, আমিও মা’কে ডাকছি, মা-ও শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। আমি কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছি, বুঝতে পারছি না। পাহাড় না খাদ না গড়ান, কিছুই জানি না। কেবল পিছিয়ে যাচ্ছি। মিনিটখানেক হবে। তার পরেই বুঝলাম আমায় জাপটে এসে কেউ ধরল। মা-ই ধরে নিল। আর খুব জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। এক-দু সেকেন্ড পরেই আমি মা’কে দেখতে পেলাম। তার পর প্রায় বুকের কাছে জড়িয়ে আমায় বাকি পথটা নিয়ে এল। শেষনাগের কাছাকাছি এসে ঝড় থামল। আকাশ পরিষ্কার হল।
আমি চুপ করেই ছিলাম অনেক ক্ষণ। তার পর মায়ের পাশেই শুয়েছিলাম। আমি অনেক বড় অবধি মায়ের পাশেই শুয়েছি। কিন্তু তার পর থেকে আমি ঘুমোতে চাইতাম না। আর ঘুমিয়ে পড়লেও ধড়মড়িয়ে মাঝরাতে উঠে মা’কে অনেক ক্ষণ দেখতাম।