একটা ভয় কষ্ট [লজ্জা]

পরিবেশটা ভারী। আমাদের এক জন প্রিয় মানুষ, আমার রাশভারী, দাপুটে জ্যাঠা দিনকয়েক আগে চলে গিয়েছেন। শোক বইছে আনাচ-কানাচ ছুঁয়ে, কাপড়-মেলা তারের শূন্যতা কুড়িয়ে, শেষ প্রেসক্রিপশনের ডুকরে ওঠা বুকের ভেতর বসিয়ে, এমন আরও কত কী। বহু অচেনা লোকেরও আসা-যাওয়া চলছে... উনি কত ভাল মানুষ ছিলেন... আমি আসছি গড়িয়ার আশ্রম থেকে, উনি সাহায্য করেছিলেন, খবর পেলাম... ঘি আর ক’টা লাগবে... ফল আছে, কাল হবে তো... বাজার যাচ্ছিস যখন... আমরা নামগান করি, খবর পেলাম, ওঁর মতো আত্মা... না, না, আমরা ও সব চাই না— ব্যথিত-ক্ষুণ্ণ গলায় টুকটাক নানা শব্দ দেওয়া-নেওয়া চলছে।

Advertisement

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০১৪ ০০:৩১
Share:

পরিবেশটা ভারী। আমাদের এক জন প্রিয় মানুষ, আমার রাশভারী, দাপুটে জ্যাঠা দিনকয়েক আগে চলে গিয়েছেন। শোক বইছে আনাচ-কানাচ ছুঁয়ে, কাপড়-মেলা তারের শূন্যতা কুড়িয়ে, শেষ প্রেসক্রিপশনের ডুকরে ওঠা বুকের ভেতর বসিয়ে, এমন আরও কত কী। বহু অচেনা লোকেরও আসা-যাওয়া চলছে... উনি কত ভাল মানুষ ছিলেন... আমি আসছি গড়িয়ার আশ্রম থেকে, উনি সাহায্য করেছিলেন, খবর পেলাম... ঘি আর ক’টা লাগবে... ফল আছে, কাল হবে তো... বাজার যাচ্ছিস যখন... আমরা নামগান করি, খবর পেলাম, ওঁর মতো আত্মা... না, না, আমরা ও সব চাই না— ব্যথিত-ক্ষুণ্ণ গলায় টুকটাক নানা শব্দ দেওয়া-নেওয়া চলছে।

Advertisement

এমন সময় এক জন মানুষ এলেন দেখা করতে আমার বাবার সঙ্গে। পরনে খদ্দরের মোটা পাঞ্জাবি, হাঁটু অবধি ঝুল। মিলের সাদা ধুতি। কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ। ‘উনি আছেন? একটু দরকার ছিল।’ ‘না, বাবা বাড়ি নেই। আর আমরা তো বলেছি, কীর্তন, নামগান— এ সব ঘটাপটা আমরা চাই না। এটা কোনও উৎসব নয়। আপনি আসতে পারেন।’ দিদি বলল। আমি বিরক্ত, পাশে দাঁড়িয়ে।

কিছু পরে বাবা এলেন বাজার থেকে। সঙ্গে সেই ভদ্রলোক। আমি দৌড়ে গিয়ে বললাম, ‘তুমি এঁকে কেন নিয়ে এসেছ আবার। জেঠিমা বলল না, কীর্তন করাবে না?’ বাবা একটু অবাক হয়ে বলল, ‘ওঁর সঙ্গে কীর্তনের কী সম্পর্ক? উনি তো আমার কোলিগ।’ প্রথমটা হতবাক, তার পর গলাটা শুকিয়ে গেল। ছুট্টে ওখান থেকে চলে গেলাম। যাওয়ার সময় ভদ্রলোকের সঙ্গে এক বার চোখাচোখি হওয়ার সময় দেখলাম ওঁর মুখে মৃদু একটা হাসি।

Advertisement

বাবা বললেন, ‘এক গ্লাস জল দিয়ে যাও।’ আমি জল এনে, মেঝের দিকে তাকিয়ে, জলের গ্লাসটা বাড়িয়ে দিলাম। খুব নিচু স্বরে উনি বললেন, ‘আমি কিছু বলিনি মা, আমি জানি তো।’ আমার অস্বস্তি দ্বিগুণ বাড়ল।

উনি চলে যাওয়ার পর বাবার কাছে দোষ স্বীকার করতে এলাম। বাব সব শুনল। বকল না, কিন্তু বেশ বুঝিয়ে দিল, এই ধরনের ছেলেমানুষি বা মূর্খামি বাবার মেয়েদের কাছ থেকে বাবা কোনও দিন আশা করে না। আমি আর দিদি গুটিসুটি।

কী করে বোঝাব বাবাকে যে, বাবার অফিসে কেউ যে ওই পোশাক পরে চাকরি করতে পারেন, তা আমরা আন্দাজও করতে পারিনি। এমনিতে আমি কখনও কাউকে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে অফিস করতে দেখিইনি। খদ্দরের পাঞ্জাবি আর মিলের ধুতি পরে যে কেউ অফিস করতে পারে, কীর্তন নয়, সেটা আমি ভাবতেই পারতাম না। দিদিও। আরও একটা ব্যাপার ছিল, বোধহয় উঠতি বয়স শোকে একটা সক্রিয় যোগদান চাইছিল। একটা বড়দের মতো পোস্ট। ‘কেমন ভাগিয়ে দিলাম কীর্তনওয়ালাকে!’— এ রকম কিছু। কিংবা ‘এটা উৎসব নয়’ বলার মতো একটা স্টেটমেন্ট, শোকটাকে যথার্থ মর্যাদা দিচ্ছি— এই ভাবটা।

তার বদলে, উনি একটুও নালিশ না করে আর দরদি হাসি হেসে, আমাদের ভেতরে অসংখ্য ছোট ছোট কামড় বসিয়ে দিলেন। এর চেয়ে ঢের ভাল হত যদি উনি বলতেন, ‘আপনার মেয়েরা তো ভারী অভব্য, জামা-কাপড় দিয়ে মানুষকে বিচার করতে শিখেছে!’

কিছু না বলে এই হঠাৎ ফ্যাকাশে বা লাল হয়ে ওঠাটা জন্মের মতো আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।

amisanchari@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন