অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
মাস দু’য়েকের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গ-সহ পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণা করতে পারে নির্বাচন কমিশন। তার আগে দিল্লি থেকে বিজেপি বিরোধী দলগুলিকে ভোটার তালিকায় মাধ্যমে ভোট চুরি নিয়ে ‘সতর্কবার্তা’ দিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই সঙ্গে জানিয়ে দিলেন, গত দেড় বছরে বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা ভোটে বিজেপি জোটের প্রায় একতরফা জয়ের নেপথ্যে রয়েছে সেই ‘কৌশল’।
পাশাপাশিই তাঁর বক্তব্য, বিরোধী শিবিরের কংগ্রেস, আরজেডি, আম আদমি পার্টি (আপ)-র মতো বিরোধী দলগুলি ভোটার তালিকায় কারচুপি ধরতে পারেনি। কিন্তু তৃণমূল পেরেছে। অভিষেক ‘সমমনস্ক’ দলগুলিকে ‘পরামর্শ’ দিয়েছেন, ভোটার তালিকার ‘চুরি’ ধরতে।
পশ্চিমবঙ্গে ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) পর্বে বিভিন্ন ‘অসঙ্গতি’র অভিযোগ নিয়ে বুধবার নির্বাচন সদনে গিয়েছিল তৃণমূলের প্রতিনিধিদল। অভিষেকের নেতৃত্বে প্রতিনিধিরা মুখ্য নির্বাচন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার-সহ কমিশনের ফুল বেঞ্চের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন। বৈঠকের পরে অভিষেক অভিযোগ করেন, ভোটার তালিকায় কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচনে জালিয়াতি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘‘আসল চুরি হচ্ছে ভোটার তালিকায়। ইভিএমে কোনও কারচুপি হচ্ছে না। সমমনস্ক দলগুলিকে, বিশেষত যারা বিজেপি বিরোধী তাদের বলব, ভোটার তালিকার চুরি ধরতে হবে। তৃণমূলই এক মাত্র দল যারা এটা ধরে ফেলেছে। কংগ্রেস যদি ভোটার তালিকার এই চুরি ধরতে পারত, তা হলে হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, দিল্লি এবং বিহারে বিজেপি জিতত না। কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি, ডিএমকে, সব দলই জানে কারচুপি হচ্ছে। কিন্তু কী ভাবে হচ্ছে সেটা ধরতে পারছে না!’’
কী ভাবে ভোটার তালিকায় মাধ্যমে ‘ভোট চুরি’ হচ্ছে, তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন অভিষেক। তাঁর কথায়, ‘‘এখানে চুরি হচ্ছে সফ্টঅয়্যারের মাধ্যমে, অ্যালগোরিদমের (ধাপে ধাপে সাজানো নিয়মের অনুক্রম) মাধ্যমে। আমরা চ্যালেঞ্জ করেছি, নির্বাচন কমিশনের সাহস থাকলে দেখাক, সফ্টঅয়্যার কী ভাবে ‘রান’ করে। কোন অ্যালগোরিদম চালানো হচ্ছে।’’
আগামী এপ্রিল-মে মাসে পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি অসম, তামিলনাড়ু, কেরল এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল পুদুচেরিতে বিধানসভা ভোট। এর মধ্যে কেরলে মূল লড়াই বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র দুই সহযোগী কংগ্রেস এবং সিপিএমের নেতৃত্বাধীন জোটের। বাকি চারটি বিধানসভাতেই ‘ইন্ডিয়া’র শরিকদের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ-র। এই আবহে গত দেড় বছরে মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, দিল্লি, বিহারের মতো রাজ্যে বিজেপির নিরঙ্কুশ জয়ের উদাহরণ দিয়ে অভিষেকের বার্তা, ‘ভোট চুরি’ রোখার ক্ষেত্রে কংগ্রেস, আম আদমি পার্টি, আরজেডির মতো দলগুলি ‘ব্যর্থ’ হয়েছে।
অভিষেকের দাবি, লোকসভা নির্বাচনের পরে বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা ভোটে বিজেপি এবং তার সহযোগীদের জয়ের নেপথ্যে ভোটার তালিকায় কারচুপিই মূল কারণ। তিনি বলেন, ‘‘জ্ঞানেশ কুমারকে বলেছি, আপনি ভোটার তালিকাকেই অস্ত্র করতে চাইছেন।’’ লোকসভায় তৃণমূলের দলনেতার মতে, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা, বিহার, দিল্লিতে কংগ্রেস, আরজেডি, আম আদমি পার্টি ভুলগুলি ধরতে পারেনি বলেই সব জায়গায় বিজেপি ৮৮ শতাংশের ‘স্ট্রাইক রেটে’ জিতেছে। তাঁর কথায়, ‘‘এটা কোনও কাকতালীয় ঘটনা নয়। এটা হয়েছে কারণ ভোটার তালিকায় চুরি হয়েছে এবং তা করা হয়েছে নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে।’’
গত অগস্টে সংসদের বাদল অধিবেশনের সময়ই কমিশনের বিরুদ্ধে ভোটার তালিকায় কারচুপির মাধ্যমে ভোট চুরিতে সাহায্য করার অভিযোগ তুলেছিলেন তৃণমূল সাংসদেরা। অভিষেকের নেতৃত্বে সংসদ ভবনের সামনে ধর্নায় বসে ‘নির্বাচন কমিশন ছিঃ ছিঃ’ বলে স্লোগান দিয়েছিলেন তৃণমূল সাংসদেরা। তাঁদের হাতে ছিল গেরুয়া রঙের পোস্টার, যাতে বাংলায় লেখা ‘ভোট চুরি’। অভিষেকের হাতে ধরা একটি ব্যানারে বাংলায় লেখা ছিল ‘চুপি চুপি ভোট চুরি’। সঙ্গে ইংরেজিতে লেখা ছিল, ‘সাইলেন্ট ইনভিজ়িব্ল রিগিং’ (গোপন অদৃশ্য কারচুপি)। যে শব্দগুলির ইংরেজি আদ্যক্ষর পাশাপাশি রাখলে ‘এসআইআর’ হয়। ঘটনাচক্রে, সেই সময়েই লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী লোকসভা ভোটপর্বে বেঙ্গালুরু সেন্ট্রাল লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত মহাদেবপুরা বিধানসভায় ভোটার তালিকায় ভুয়ো ভোটারের নাম ঢুকিয়ে ‘ভোট চুরির তথ্যপ্রমাণ’ পেশ করেছিলেন।
গত সেপ্টেম্বরে অরবিন্দ কেজরীওয়ালের আম আদমি পার্টি দিল্লিতে বিধানসভা ভোটের আগে বৈধ ভোটারদের নাম বাদ পড়া নিয়ে সরব হয়েছিল। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কেজরীর দলকে হারিয়ে দিল্লি দখল করে বিজেপি। দিল্লির বিধানসভা ভোটের পরেই তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ভোট চুরি’র অভিযোগ তুলে বলেছিলেন, ‘‘আমরা এই চুরিটা ধরে ফেলেছি।’’ ওই ‘চুরি’তে বিজেপি, নির্বাচন কমিশন ও কেন্দ্রীয় বাহিনীকে একযোগে কাঠগড়ায় তুলে তাঁর হুঁশিয়ারি ছিল, এ রাজ্যে তা হতে দেবেন না তিনি। এর পরে পশ্চিমবঙ্গের পড়শি রাজ্য বিহারে এসআইআর পর্বে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। কিন্তু আরজেডি, কংগ্রেস এবং বাম দলগুলির জোট কোনও ‘কার্যকরী আইনি প্রতিরোধ’ গড়ে তুলতে পারেনি। বস্তুত, রাহুল গান্ধী-তেজস্বী যাদবের ‘ভোটার অধিকার যাত্রা’য় বিপুল ভিড় হলেও সে রাজ্যের ২৪৩টি আসনের মধ্যে বিরোধী জোট মহাগঠবন্ধন জিতেছিল মাত্র ৩৫টিতে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, বিহারের ভোটে বিরোধী জোটকে সমর্থন করলেও তৃণমূলের প্রথম সারির কোনও নেতা সেখানে প্রচারে যাননি। গত ১ সেপ্টেম্বর ‘ভোটার অধিকার যাত্রা’র সমাপ্তি কর্মসূচিতে পাঠানো পটনায় হয়েছিল বহরমপুরের সাংসদ ইউসুফ পাঠান এবং উত্তরপ্রদেশের নেতা ললিতেশ ত্রিপাঠীকে। ভোটার তালিকায় কারচুপি ধরতে রাহুল-তেজস্বীদের ‘গয়ংগচ্ছ’ মনোভাবের ‘পরিণাম’ সম্পর্কে তৃণমূল নেতৃত্ব যে অবহিত ছিলেন, অভিষেকের বুধবারের বক্তব্যে তার ইঙ্গিত পেয়েছেন দলের অনেকে।
উত্তরপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কেরল-সহ সাতটি রাজ্যে আগেই খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের নির্বারিত সময়সীমা ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়িয়েছিল কমিশন (মঙ্গলবার শুধুমাত্র উত্তরপ্রদেশের জন্য সময়সীমা আরও বাড়িয়ে ৬ জানুয়ারি করা হয়েছে)। সংশ্লিষ্ট রাজ্যের বিজেপি বিরোধী দলগুলিকে সফ্টঅয়্যার এবং অ্যালগোরিদমের মাধ্যমে ভোটার তালিকায় কারচুপির বিষয়ে তিনি অবহিত করবেন কি না জানতে চাওয়া হলে অভিষেক বলেন, ‘‘আজ সংবাদমাধ্যমের উপস্থিতিতে বললাম। পরে না হয় সবিস্তারে বলব। আসল চুরি কিন্তু হচ্ছে ভোটার তালিকায়।’’