রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ৩

কেচ্ছা

ভোটের বাজারে টিভি খুললেই এখন রাজনীতির তরজা। অথচ আজও যদি মেপে দেখতে হয়, পৃথিবীতে এ যাবৎ সবচেয়ে বেশি দর্শক টেনেছে কোন পলিটিকাল ইন্টারভিউ, সম্ভবত ফিরে যেতে হবে ৩৭ বছর আগের একটি মার্কিন টেলিভিশন শো-এ।

Advertisement

সুস্নাত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৪ ০০:১২
Share:

ভোটের বাজারে টিভি খুললেই এখন রাজনীতির তরজা। অথচ আজও যদি মেপে দেখতে হয়, পৃথিবীতে এ যাবৎ সবচেয়ে বেশি দর্শক টেনেছে কোন পলিটিকাল ইন্টারভিউ, সম্ভবত ফিরে যেতে হবে ৩৭ বছর আগের একটি মার্কিন টেলিভিশন শো-এ। ৪ মে, ১৯৭৭। সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্বটিই সে দিন চাক্ষুষ করেছিলেন নিদেনপক্ষে সাড়ে চার কোটি মানুষ। প্রশ্নকর্তা ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট। আর প্রশ্নগুলো ছুটে আসছে যে মানুষটির দিকে: রিচার্ড নিক্সন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তখন প্রাক্তন। পদচ্যুত। সে দিনের বিষয়ও ছিল ‘ওয়াটারগেট’, বছর তিনেক আগেই যা টলিয়ে দিয়েছে নিক্সনের সাধের সিংহাসন। দুনিয়ার অন্যতম সাড়াজাগানো কেচ্ছা। আজও আমেরিকার দগদগেতম ক্ষত। সেই ‘ওয়াটারগেট’, যা যাবতীয় কেচ্ছা-কেলেংকারির সমার্থক করে জন্ম দিয়েছে একটি নতুন অনুসর্গের— ‘গেট’।

Advertisement

সাল ১৯৭২। ১৬ জুন, রাত তখন একটা হবে (অবশ্য রাত বারোটার পর নতুন দিন হিসেবে ধরলে ১৭ জুন)। চারিদিক শুনশান। ওয়াশিংটনের ওয়াটারগেট কমপ্লেক্সের এক নিরাপত্তারক্ষী দূর থেকে দেখলেন, বেসমেন্টের একটা ঘরের দরজা যেন ঈষৎ খোলা। কাছে গিয়ে বুঝলেন, দরজার লকটিতে কেউ টেপ জড়িয়ে রেখেছে, যাতে বন্ধ না হয়ে যায়। বিশেষ গুরুত্ব দিলেন না। টেপটি খুলে, দরজা টেনে দিলেন ওই নিরাপত্তারক্ষী। খানিক পরে টহল দিতে গিয়ে আবার দেখেন, সেই দরজায় আলতো ফাঁক। লকটিতে আগের মতোই টেপ জড়ানো। এ বার খটকা লাগে তাঁর, ডাক পাঠালেন পুলিশকে। মোটে তিন জন পুলিশ এসে শুরু করল তল্লাশি। দেখা গেল বাড়িটির সাততলার একটি ঘরেও একই রকম ভাবে টেপ জড়িয়ে রাখা। এ ঘর-সে ঘর খুঁজে অবশেষে সন্ধান মিলল একটি ডেস্কের আড়ালে লুকিয়ে থাকা পাঁচ মক্কেলের। তাদের গ্রেফতার করা হল, কিন্তু এমন অপেশাদার গবেটের মতো ‘ডাকাতি’ করতে আসা, আর হাতেনাতে ধরা পড়ার এই ছেঁদো থ্রিলারের আড়ালে কত বড় স্ক্যান্ডাল থাকতে পারে, তক্ষুনি বোঝেনি আমেরিকা।

কিন্তু দেখা গেল, যে ঘরটিতে অপারেশন চলেছে, সেটি সরকার-বিরোধী ডেমোক্র্যাটদের পরিচালন সমিতি ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কমিটির প্রধান কার্যালয়। ওই পাঁচ জন সেই কার্যালয়ের ফোনে আড়ি পাতার ব্যবস্থা করতেই সেঁধিয়েছিল। সামনেই নির্বাচন, স্বভাবতই আঙুল উঠল তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের প্রশাসনের দিকে। নিক্সনের প্রচার-সচিব তড়িঘড়ি বললেন, এটি একটি তৃতীয় শ্রেণির ডাকাতির কাঁচা চেষ্টামাত্র! সময় কিছু গড়াতে সাংবাদিক বৈঠকে নিক্সনও জোর গলায় বললেন, হোয়াইট হাউসের কেউ, তাঁর প্রশাসনের কেউ, এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নয়। এমনকী তাঁর প্রশাসনের অন্যতম মাথা জন ডিনকে প্রকাশ্যে সাধুবাদ জানালেন, ডিন নাকি ইতিমধ্যেই গোটা বিষয়টির তদন্ত সেরে ফেলেছেন। নিক্সন জানতেন না, পরে গোটা বিশ্বই জানবে, সে দিন তদন্তের কাজে ডিন এক পা-ও এগোননি!

Advertisement

এরই মধ্যে বিপুল ভোটে জিতে প্রেসিডেন্টের চেয়ার দখলে রেখেছেন নিক্সন। কিন্তু তদন্ত তখন যত এগোচ্ছে ততই ফুটে উঠছে নিক্সন-প্রশাসনের আসলিয়ত। কেঁচো খুঁড়তে বেরোচ্ছে কেউটে— নির্বাচনের টাকা নাকি লাগানো হয়েছে এই সব চক্রান্তে। কেউ সরাসরি দোষী সাব্যস্ত হচ্ছে, জেলের ঘানি টানছে, কেউ নিজেই সরে দাঁড়াচ্ছে ইস্তফা দিয়ে। কখনও নিক্সনই বহিষ্কার করে দিচ্ছেন সেই জন ডিনের মতো কাউকে, যে ডিন আবার নিক্সনের বিরুদ্ধেই গোয়েন্দাদের কাছে ফাঁস করে দিচ্ছেন, ওয়াটারগেট চ্যাপ্টার ধামাচাপা দিতে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর অন্তত ৩৫ বার কথা হয়েছে। ক্রমশই প্যাঁচে পড়তে থাকা নিক্সন সরিয়ে দিচ্ছেন স্পেশাল প্রসিকিউটরদেরই। দেশ জুড়ে নিন্দিত হচ্ছেন। শেষমেশ নিক্সনের বিরুদ্ধে বুমেরাং হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাঁর নিজের দফতরেই রেকর্ড হওয়া যাবতীয় কথোপকথনের গোপন টেপ। ১৯৭৪-এর ৯ অগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র পদত্যাগী প্রেসিডেন্টের অপমান মাথায় নিয়ে সরে যেতে বাধ্য হচ্ছেন রিচার্ড মিলহউস নিক্সন।

বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী পুরুষ থেকে ক’দিনেই করুণার পাত্র। ওয়াটারগেটের খবর করে স্পটলাইটে আসা ওয়াশিংটন পোস্টের দুই সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড ও কার্ল বার্নস্টাইন এই চল্লিশ বছর পর সম্প্রতি আবার লিখছেন তাঁদের বর্তমান উপলব্ধির কথা— আরও খারাপ লোক ছিলেন নিক্সন, ওয়াটারগেটও ছিল এক ভয়ংকর বিষয়ের সামান্য আভাসমাত্র!

susnatoc@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন