সাংঘাতিক সাইকেলবাজ

খুদ কুঁড়ো

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়আজ কে জানে কেন সুকুমারের কথা মনে পড়ছে। সে ছিল কোচবিহার নৃপেন্দ্রনারায়ণ স্কুলে আমার সহপাঠী। ক্লাস টেন, সেকশন বি। সকলের সঙ্গেই সকলের বেশ ভাবসাব ছিল। তবে ওই স্কুলে আমি ছিলাম নবাগত। কেউ আমার পুরনো বন্ধু নয়। তা হলেও ওই বয়সে মিলেমিশে যেতে তেমন দেরি হত না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৫ ০১:০০
Share:

আজ কে জানে কেন সুকুমারের কথা মনে পড়ছে। সে ছিল কোচবিহার নৃপেন্দ্রনারায়ণ স্কুলে আমার সহপাঠী। ক্লাস টেন, সেকশন বি। সকলের সঙ্গেই সকলের বেশ ভাবসাব ছিল। তবে ওই স্কুলে আমি ছিলাম নবাগত। কেউ আমার পুরনো বন্ধু নয়। তা হলেও ওই বয়সে মিলেমিশে যেতে তেমন দেরি হত না।

Advertisement

আমি বাল্যকালে ভীষণ দুষ্টু ছিলাম বটে, কিন্তু বয়ঃসন্ধির সময়টাতেই বোধহয় আমার দুষ্টুমির পোকাগুলো ঘুমোতে গেল। যখন কোচবিহারে হোস্টেলে থেকে পড়ছি, তখন আমি অনেকটাই শান্ত স্বভাবের মানুষ। আমার ঠিক পিছনেই বসত সুকুমার। তার বেশ হাড়েমাসে চেহারা ছিল এবং মারকুট্টাও। কী কারণে জানি না, আমার সঙ্গে সুকুমারের এক-আধ বার ঝামেলা হয়েছে। প্রায় মারপিট লাগার মতো অবস্থা। কিন্তু আমি ঠিক আগের মতো মারমুখো ছিলাম না। ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট এড়িয়ে চলি। মারপিট না হলেও মৃদু একটু শত্রুতা তৈরি হয়েছিল তার সঙ্গে আমার।

কিন্তু সুকুমারের যে আশ্চর্য গুণটা ছিল তা সবাইকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। তার, যত দূর অনুমান, একটা মজবুত র‌্যালে সাইকেল ছিল। আর তাতে চড়ে সে এমন সব কাণ্ড করতে পারত যা সার্কাসের খেলুড়েরা দেখায়। সে অনায়াসে মাঠ থেকে সাইকেল চালিয়ে স্কুলের বারান্দায় তিন-চার ধাপ সিঁড়ি টপকে সাইকেল সমেত বারান্দায় উঠে পড়তে পারত। এ সব কাণ্ডের জন্য আলাদা মজবুত সাইকেল কিনতে পাওয়া যায় আজকাল। কিন্তু সুকুমারের সাইকেল ছিল নিতান্তই সাদামাটা। হয়তো একটু দামি, কিন্তু বিশেষত্ব কিছু নেই।

Advertisement

শুধু তা-ই নয়, সে সামনের চাকাটা একটু বাঁকিয়ে সাইকেলের সিটে বসা অবস্থাতেই সাইকেলকে একদম নিশ্চল করে রাখতে পারত। পাঁচ-সাত-দশ মিনিট বা ইচ্ছে করলে তারও বেশি। তখন দেখতাম তার মুখে চোখে একটা তীব্র টেনশন, অখণ্ড মনোযোগ।

আমি নিজে বিস্তর সাইকেল চালিয়েছি। লামডিং-এ টিলার ওপর আমাদের বাংলো ছিল। অনায়াসে সাইকেলে ওঠানামা করেছি। কিন্তু সাইকেলে এ রকম খেল কী করে দেখানো যায় তা আমার মাথায় আসত না।

আমি তখন ফুটবল ক্রিকেট খেলি। স্কুলে এই দুই খেলাতেই আমার কিছু সুনাম হয়েছিল। সকালে উঠে রীতিমত দৌড়তাম। দমও ছিল ভালই। সুকুমারের অন্য সব খেলাধুলোর প্রতি আগ্রহ ছিল না। শুধু সাইকেল আর সাইকেল।

দীর্ঘ দিন আড়াআড়ির পর এক দিন ওই সাইকেলের কারণেই আমি তার সঙ্গে ভাব করে ফেললাম। বললাম, তুই কী করে ওটা করিস রে?

দূর, ও কিছু নয়। প্র‌্যাকটিস করলেই হয়।

আমাকে শিখিয়ে দিবি?

ও একটু ভেবেচিন্তে বলল, ব্যাপারটা কী জানিস! আমি কয়েক জনকে শিখিয়েছি, কিন্তু তারা পেরে ওঠেনি। সবাই বলে, এ আমাদের দ্বারা হবে না, তোর মধ্যে অন্য ব্যাপার আছে।

তখন হোস্টেলে থাকি। আমার তো সেখানে সাইকেল ছিল না। সুকুমারই তার সাইকেলটা আমাকে এক দিন ধার দিল। স্কুলের মাঝখানে চমত্‌কার ঢালাও মাঠে আমি নানা ভাবে সাইকেল দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। দু-চার সেকেন্ডের বেশি হল না। সুকুমার হাসছিল। তার কাছে যা জলভাত, আমার কাছে তা-ই হিমালয়ে ওঠা। তার ওপর তার সাইকেলে সিঁড়ি ভাঙা তো অনেক দূরস্থান। সে এমন সুন্দর ধাপে ধাপে ঝাঁকুনি দিয়ে দিয়ে সাইকেলটাকে বারান্দায় তুলত, বহু বছর পরে বিদেশে ও-রকম করতে দেখেছি টিভিতে। তবে তা সাধারণ সাইকেল নয়, বিশেষ ভাবে তৈরি সাইকেল, যা সুকুমার চোখেও দেখেনি।

আমি হাল ছাড়লাম। ‘মন্ত্রশক্তি’ গল্পটা আমার পড়া ছিল। জানি, কিছু কিছু মানুষ কিছু কিছু জিনিস পারে, সবাই পারে না।

সাগর দীঘির পাড়ে সে বার একটা সাইকেল রেস হল। জেলাওয়াড়ি প্রতিযোগিতা। বিস্তর সাইকেলবাজ তাতে যোগ দিতে এল। জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি থেকেও এসেছিল শুনেছি। আর তাদের মধ্যে ছিল সুকুমারও। রেস শুরু হওয়ার পর পঞ্চাশ-ষাটটা সাইকেলের ভিড়ে সুকুমারকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিল না। ঠিক মনে নেই, দীঘির চারপাশে বোধহয় কুড়ি-পঁচিশটা বা পঞ্চাশটা রাউন্ড দিতে হবে। রাস্তা তেমন চওড়া নয় বলে সাইকেলে সাইকেলে বিস্তর ঠোকাঠুকিও হচ্ছিল। তবে লম্বা রেস, শেষ পর্যন্ত টেকা বেশ কঠিন।

আট-দশ রাউন্ডের পর দুটো-চারটে করে সাইকেলবাজ রেস থেকে সরে যাচ্ছিল। কারও চেন পড়ে গেছে, কারও চাকা পাংচার বা হ্যান্ডেল বেঁকে গেছে। বোধহয় কুড়ি রাউন্ডের পর জনা পনেরো টিকে ছিল এবং সবার শেষে সুকুমার। আমরা বেশ হতাশ হলাম। সুকুমার কি হেরে যাচ্ছে? আমরা চেঁচিয়ে তাকে নানা রকম উত্‌সাহ দিতে লাগলাম। সে অবশ্য ভ্রুক্ষেপ করল না। মাথাটা নিচু করে একমনে সাইকেল চালাতে লাগল।

শেষ পনেরো-ষোলো জনের মধ্যে যথেষ্ট ক্লান্তি দেখা যাচ্ছিল। সবাই ঘামছে, হাঁফাচ্ছে। রেস শেষ হওয়ার বোধহয় দুই কি তিন রাউন্ড যখন বাকি, তখন দেখলাম, সুকুমার খুব অনায়াসে এক জন এক জন করে অগ্রবর্তীকে পাশ কাটিয়ে এগোচ্ছে। কিন্তু তবু এক বা দুই নম্বর তখনও অনেক এগিয়ে। অতটা দূরত্ব পেরনো সম্ভব?

যখন সাইকেলগুলোই ক্লান্ত হয়ে পড়ছে বলে মনে হচ্ছে ঠিক তখনই সুকুমারের সাইকেলে একটা উন্মাদ গতি যেন ভর করল। হঠাত্‌ গতির ধাক্কায় ডাইনে-বাঁয়ে বিপজ্জনক টাল খেয়ে সুকুমার যেন সবাইকে প্রায় দাঁড় করিয়ে রেখে এগিয়ে গেল সীমানার দিকে। এতগুলো রাউন্ডের পর ওই গতি কারও বিশ্বাস হচ্ছিল না। সে দিন সুকুমারকে দেখে আমার মনে হয়েছিল, মন্ত্রশক্তি গল্পটা মোটেই আজগুবি নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন