খুব বৃষ্টি, সবাই পুজো দেখলেন দূরদর্শনে

১৯৭৫-এ টিভি আসায় সে বছরই প্রথম লোকেরা ঘরে বসে পরদায় দুর্গাপুজো দেখার আনন্দ পেলেন। শুরু হল ‘পূজা পরিক্রমা’। প্রথম বছর থেকেই এই অনুষ্ঠানের দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর।

Advertisement

পঙ্কজ সাহা

শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০৩
Share:

কলকাতা দূরদর্শনের স্টুডিয়োতে মহালয়ার অনুষ্ঠান রেকর্ডিংয়ে শিল্পীরা।

১৯৭৫-এ টিভি আসায় সে বছরই প্রথম লোকেরা ঘরে বসে পরদায় দুর্গাপুজো দেখার আনন্দ পেলেন। শুরু হল ‘পূজা পরিক্রমা’। প্রথম বছর থেকেই এই অনুষ্ঠানের দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। লক্ষ করেছিলাম, সেরা পুজোর প্রতিযোগিতা কী ভাবে পুজো আয়োজনের চরিত্রটাকেই ক্রমে বদলে দিল। প্রথমে একটি কোম্পানির উদ্যোগে প্রতিযোগিতা থেকে বাড়তে বাড়তে, এখন অসংখ্য প্রতিযোগিতা। কলকাতা দূরদর্শনের তরফ থেকেও আমরা সেরা পুজোর প্রতিযোগিতার আয়োজন করতাম, তা নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা জেগে উঠত, কারণ প্রতিযোগিতার ব্যাপারটা তখনকার একমাত্র টিভি চ্যানেল দূরদর্শনের পরদায় দেখানো হত। প্রথম বার পূজা পরিক্রমায় মূলত কলকাতার বিভিন্ন মণ্ডপের প্রতিমা দেখানো হল, আর পূজা কমিটির নামগুলো বলে দেওয়া হল। পরের বছর তার সঙ্গে ঢাকের বাদ্যি যোগ করলাম। তার পরের বছর ঢাক ও যন্ত্রসংগীত ব্যবহার করা হল। এই ভাবে ক্রমে ক্রমে এল ভাষ্য, তার সঙ্গে গান, দর্শনার্থীদের এবং পুজো আয়োজকদের সাক্ষাৎকার ইত্যাদি। যখন বিজ্ঞাপন নেওয়া চালু হল, বড় বড় পুজো কমিটিগুলো বিশেষ কভারেজের জন্য দূরদর্শনকে ফি দিতে লাগল। গ্রামাঞ্চলের ও অন্য প্রদেশের পুজো দেখানোর ব্যবস্থা করা হল। বিদেশে বাঙালিদের দুর্গাপুজোও দেখানোর ব্যবস্থা হয়। চালু হয় গঙ্গার ঘাটে প্রতিমা বিসর্জন নিয়ে আমাদের নিজস্ব অনুষ্ঠান আয়োজন। বেলুড় মঠ থেকে রামকৃষ্ণ মিশনের দুর্গাপুজো সরাসরি দেখানোর ব্যবস্থাও দূরদর্শন প্রথম শুরু করে। এখন যা-সব বিভিন্ন চ্যানেলে দেখা যায়, তা দূরদর্শনের প্রথম কয়েক বছরের মধ্যেই হয়ে গিয়েছিল। মনে পড়ে আমাদের বিজয়া সম্মিলনীর কথা, ইছামতী নদীতে দুই বাংলার দুর্গাপ্রতিমা বিসর্জনের লাইভ টেলিকাস্টের কথা। এখন চ্যানেলে চ্যানেলে ‘পুজোর আড্ডা’। এই ‘আড্ডা’ ফরম্যাটটির প্রথম সূত্রপাত করেছিলাম দূরদর্শনের ‘নববর্ষের বৈঠক’ অনুষ্ঠানটির মাধ্যমে।

Advertisement

আমাদের মনে পুজো শুরু হয়ে যায় আকাশবাণী থেকে মহালয়ার প্রভাতী অনুষ্ঠান সম্প্রচারের মধ্য দিয়ে। প্রথম বছরই যখন আমাকে টিভিতে মহালয়ার অনুষ্ঠান করতে বলা হয়, আমি একটা ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য আনতে চেয়ে ‘নববর্ষের বৈঠক’ অনুষ্ঠানটি সূত্রপাতের অনুমতি চেয়ে নিই, এবং আকাশবাণীর মহালয়া অনুষ্ঠানের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত— বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, পঙ্কজকুমার মল্লিক, সুপ্রীতি ঘোষ, রাইচাঁদ বড়াল এবং অন্যদের আমন্ত্রণ জানিয়ে একটি বিশেষ অনুষ্ঠান করি। কী ভাবে রেডিয়োর মহালয়া অনুষ্ঠান গড়ে ওঠে, তা নিয়ে তাঁরা সুন্দর স্মৃতিচারণ করেন। পরের বছর থেকে, বিশেষ করে আমাদের সংগীত বিভাগের দায়িত্বে, মহালয়ার টিভি অনুষ্ঠান করার রীতি চালু হয়। হেমামালিনীও দূরদর্শনের মহালয়ার অনুষ্ঠানে এক বার দেবী দুর্গার ভূমিকায় ছিলেন।

এক বার পুজোর চার দিনই খুব বৃষ্টি হয়েছিল, লোকেরা খুব একটা বেরোতে পারেননি। আমাদের কম সংখ্যক কর্মীই কাজে আসতে পেরেছিলেন। আমি একটানা স্টুডিয়োতে বসে যেমন যেমন পরদায় পুজোর দৃশ্য আসছে, দেখে ‘পূজা পরিক্রমা’য় তাৎক্ষণিক কমেন্ট্রি করে গেছি। পরে ‘দর্শকের দরবারে’ আসা চিঠিপত্র থেকে যখন জানলাম, দূরদর্শনের পরদাতেই লোকেরা সে বার পুজো দেখেছেন আর দু’হাত তুলে আমাদের আশীর্বাদ করেছেন, তখন আমাদের সকলের খুব মন ভাল হয়ে গেল।

Advertisement

পুজোর ছুটির সময় ছোটদের জন্য করা হত ‘ছুটি ছুটি’ অনুষ্ঠান। পুজোর আগে পুজো নিয়ে নানা ধরনের অনুষ্ঠান করার রীতিও ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। পুজোর কেনাকাটা, পুজোয় ভ্রমণ, পুজোর গান, পুজোর ফ্যাশন, এ-সব তো ছিলই, তার সঙ্গে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কয়েক পর্বে করতাম ‘শারদ সাহিত্য’ অনুষ্ঠান— ‘সাহিত্য সংস্কৃতি’অনুষ্ঠানে। লিট্‌ল ম্যাগাজিনকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হত। অধ্যাপক অশোক কুণ্ডু খুব পরিশ্রম করে শারদ সংখ্যার বিপুল সংগ্রহ নিয়ে নানা পরিসংখ্যান হাজির করতেন। এক বারের অনুষ্ঠানে কোনও এক বিখ্যাত পত্রিকার সম্পাদক অনেক আগে থেকে যাঁদের লেখার জন্যে তাগাদা দিতে হয়, তাঁদের নামের মধ্যে বিমল মিত্রের নাম বলতে ভুলে গিয়েছিলেন বলে তিনি আর কোনও দিন সেই পত্রিকাতে লেখেননি।

এক বার পুজোর সময় বিশ্বজিৎ রায় শান্তিনিকেতনের ছোটদের নিয়ে স্টুডিয়োতে রবীন্দ্রনাথের ‘শারদোৎসব’ নাটকটি করলেন। সিনিক ডিজাইনার সঞ্জিৎ সেন শর্মা সত্যিকারের কাশফুল দিয়ে স্টুডিয়োতে কাশবন তৈরি করেছিলেন। সেই কাশফুল উড়ে গিয়ে ক্যামেরার লেন্সে লেগে গিয়ে সে এক বিপত্তি।

লক্ষ করেছিলাম, নানান সৃজনশীলতার প্রয়োগ থেকে এক সময় ‘থিম পুজো’র প্রচলন হল। থিম পুজোর অসাধারণ সব সৃষ্টি ও নির্মাণ দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিয়ে নিজেরাই কৃতজ্ঞ বোধ করতাম।

pankajsaha.kolkata@gmail.com

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement