ছবি: সুমন চৌধুরী
কাজটা একটু কঠিন, বুঝলে ভায়া!
কতটা এরিয়া খুঁজতে হবে?
এ বার এরিয়াটা একটু বেশি। পুলিশের কাছে যা খবর, তাতে ধরো হাওড়া ব্রিজের আশপাশ থেকে প্রায় বাগবাজার ঘাট পর্যন্ত।
কোন দিন আর ছোট এরিয়া দিলেন!
তবে এই লাশ খুঁজে দিতে পারলে পার্টি একেবারে কড়কড়ে ১৫০০ টাকা দেবে। লাশটা পার্টির কাছে দামি।
ছাড়ুন তো পার্টির কথা। লাশ পেলে পার্টি এমন কান্নাকাটি শুরু করে দেয়, তখন আর টাকা চাওয়া যায়?
দেবে দেবে, এই পার্টি দেবে। দামি লাশ। লাশ পেলে পার্টি মোটা টাকার ইনশিয়োরেন্স পাবে কোম্পানি থেকে। লাশ না পেলে টাকাটা আটকে যেতে পারে। তুমি একটু ভাল করে চেষ্টা করো তো ভায়া।
কথা না বাড়িয়ে প্রায় মাঝগঙ্গা থেকে কোমরে দড়ি বেঁধে ঝাঁপ দিলেন ভোলানাথ পাল। পেশায় খবরের কাগজ বিক্রেতা। আর পার্ট টাইমে বির্পযয় মোকাবিলা বাহিনীর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কর্মী।
গঙ্গার পাড়ে বাগবাজার ঘাটে বসে ভোলানাথ জানান, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর এই সব কাজ করতে গিয়ে নিজেদের জীবনের বিপর্যয় নেমে এসেছে অনেকবার। ‘গঙ্গার জলে যত গভীরে যাবেন, তত জলের চাপ বাড়বে। মাঝে মধ্যে তো নাক দিয়ে রক্তও বেরিয়ে যায়। এক বার ফেসবুকে প্রেম করে প্রতারিত হয়ে জলে ঝাঁপ দিয়ে সুইসাইড করা মহিলার লাশ খুঁজতে গিয়ে নিজেই লাশ হয়ে যাচ্ছিলাম।’ একগাল হেসে বলেন ভোলানাথ, ‘আমাদের কাজে একটা হয় লাইভ প্রোগ্রাম, আর একটা রেকর্ডিং।’
লাশ খোঁজার আবার লাইভ আর রেকর্ডিং?
বাগবাজার ঘাটের দূরের একটা লঞ্চ দেখিয়ে ভোলানাথ বলেন, ওই ধরুন দূরের ওই লঞ্চটা থেকে কেউ ঝাঁপ দিল। তখন তো আর উপায় নেই। আমাকেও গঙ্গায় ঝাঁপ দিতে হবে।
তাই!
এটাই তো আমাদের কাজ দাদা। গঙ্গার পাড়ে বসে লক্ষ রাখি কে কোথা থেকে ঝাঁপ-টাঁপ দিচ্ছে। কী করছে। আমাদের নজরেও ঠিক পড়ে যায়। মতিগতি দেখেই বোঝা যায়, কোনটা সুইসাইড কেস আর কে আচমকা পড়ে গেল। চার মিনিটের বেশি জলের ভেতর হাবুডুবু খেলে মানুষটার লাশ হয়ে যাওয়ার চান্সই বেশি। কিন্তু বেঁচে থাকবে এই আশা নিয়ে খুঁজতে হয়। তখন তো আর মুখে মাস্ক পরা বা অক্সিজেন নেওয়ার সময় নেই। কোমরে দড়ি পরারও সময় নেই। একেবারে ঝাঁপ। এটাকে বলে লাইভ প্রোগ্রাম।
আর রেকর্ডিং?
ধরুন পুলিশের কাছে খবর এল, সকালে বালি ব্রিজ থেকে গঙ্গায় একটা ঝাঁপ হয়েছে। সেই লাশ খুঁজে বের করতে হবে আশপাশের এলাকা থেকে। তখন শুরু হয় খোঁজা। কোমরে দড়ি পরে। মুখে মাস্ক পরে। কত ক্ষণে এই খোঁজা শেষ হবে কেউ জানে না। এটা হল রেকর্ডিং। আগে ঘটে গিয়েছে। পরে খুঁজে বের করো। দু’দিন তিন দিন ধরে খুঁজতে থাকা। শেষে হয়তো দেখা গেল জেটির খাঁজে কোথাও লাশ আটকে রয়েছে। বা গঙ্গার গভীরে যে বড় বড় গর্ত আছে, সেখানে আটকে রয়েছে। সেই গর্ত থেকে টেনে তোলো এ বার।
গঙ্গার গভীর তো অন্ধকার?
না, সব সময় অন্ধকার নয়। জলে সূর্যের আলো পড়লে, ওখানটা একটু ঘোলাটে দেখায়। তবে বেশি গভীরে তো অন্ধকারই।
সেই অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে পেয়ে যান?
কিছু কায়দা আছে। জানতে হয়। যেমন গঙ্গার জলের তলায় মেয়েদের লাশ থাকে উপুড় হয়ে। আর ছেলেদের লাশ চিত হয়ে। গঙ্গার জলের তলায় সব লাশ ফরসা। কালো মানুষের লাশও ওখানে কয়েক ঘণ্টা কাটালে একেবারে ফরসা হয়ে যায়।
একটু থেমে ভোলানাথ বলেন, তবে সেই লাশের মাঝেমধ্যে যা অবস্থা হয়, টেনে তোলার পর আপনি চার দিন খেতে পারবেন না।
কেন?
অনেক সময় এতটাই পচে যায়, লাশের পেটে আঙুল লেগে গেলেও একেবারে চামড়া ভেদ করে পেটের ভেতর সেই আঙুল ঢুকে যায়। লাশের দশটা হাতের আঙুলই হয়তো দেখা গেল মাছে খেয়ে নিয়েছে। কী ভাবে টেনে তুলব বলুন তো? দড়ি দিয়ে বাঁধতে গিয়েও বাঁধা যায় না। চামড়া খসে খসে পড়ে।
ভোলানাথ জানালেন, তবে সব কোশ্চেন পেপার সব সময় কঠিন হয় না। যেমন শীতকালে লাশ দ্রুত ভেসে ওঠে। ভেসে উঠলে তখন তো আর খোঁজার কিছু নেই, বাঁশ দিয়ে বা দড়ি দিয়ে টেনে আনলেই হল। মুশকিল হয় গরম কালে। লাশ ভাসতে সময় লাগে। আর কোথাও যদি, মা গঙ্গার শরীরের কোনও খাঁজে আটকে যায়, তা হলেই হয়েছে। খুঁজতে গিয়ে কখনও মাছের কামড় খেতে হয়। কখনও সাপের গর্তে হাত পড়ে যায়। কখনও বা বেশি বড় গর্তের মধ্যে হাতড়াতে গিয়ে হাতে পাথর চাপা পড়ে যায়।
মাছের কামড়?
মাগুর আছে, শাল আছে আর আছে বাগদা মাছ। সাপের মধ্যে ঢোঁড়াই বেশি। ও-সব পাত্তা দিই না। বরং বেশি ভয় মাছের। বড় বড় মাগুর হামেশাই কামড়ায়, জোর কামড়ালে রক্ত পর্যন্ত বেরিয়ে যায়। তবে সবচেয়ে ভয়ের শাল মাছের কাঁটা। সে কী সর্বনেশে কাঁটা দাদা! নাক মুখ টিপ করে কাঁটা মারে। এক বার লাগলে আর দেখতে হবে না!
আবার অসাবধান হলে মাথার ফুট খানেক ওপর দিয়ে সাঁই করে চলে যায় লঞ্চের প্রপেলার। প্রপেলারের ব্লেডে হাত বা মাথা লেগে গেলেই আপনিও কুচি কুচি লাশ হয়ে যাবেন। আমাদের এক সহকর্মী লাশ খুঁজতে গিয়ে লঞ্চের প্রপেলারে টুকরো হয়ে গিয়েছিল।
তবে এই লাশ খুঁজে পাওয়া মানেই তো পার্টির কাছে পয়সা, তাই না?
না দাদা। এ তো আর জলের নীচে মণি-মাণিক্য খুঁজে পাওয়া নয়। জলের গভীরে হাড়ভাঙা খাটুনির পর তিন-চার দিন গরুখোঁজা খুঁজেও সব সময় পার্টির কাছে টাকা চাওয়া যায় না।
বাগবাজার ঘাটে গঙ্গার জল তোলপাড় করে কয়েকটা সাত-আট বছরের বাচ্চা সাঁতার কাটছিল। ওই দিকে আঙুল দেখিয়ে ভোলানাথ বললেন, ওই যে কালো হাফপ্যান্ট পরা বাচ্চাটাকে দেখছেন, ওর দাদা দু’বছর আগে জলে এই ভাবে খেলতে খেলতে ডুবে গেল। বয়স কত হবে, বড়জোর সাত। গঙ্গার ঘাটগুলোর অবস্থা ভাল নয়। পাড়ের কাছেই সব বড় বড় গর্ত হয়ে গিয়েছে। কোনও একটা গর্তে পড়ে গিয়েছিল ছেলেটা। উঠতে পারেনি। খুব চেষ্টা করেছিলাম, গর্ত থেকে জ্যান্ত বের করতে পারিনি। ওরা থাকে গঙ্গার পাশেই লাইনের ধারে বস্তিতে। ছেলের লাশ দেখে মায়ের কী কান্না! তখন কি পয়সা চাওয়া যায়, বলুন?
একটা ছোট্ট গোল বাঁশের কাঠামো। সেটায় লাগানো আছে ছোট ছোট গোল চুম্বক। আর চুম্বকের মাঝে মাঝে আবার কাপড়ের পুঁটলির মধ্যে রাখা পারদ। জিনিসটা কী? মশা মারার ব্যাটের মতো?
এটাই হল গঙ্গার জলের তলায় ‘কয়েন ধরার ছিপ।’ ওই ছিপ ফেলে কিছু ছেলে ধরে ফেলে গঙ্গায় ভেসে যাওয়া এক টাকা পাঁচ টাকার কয়েন। ভাগ্য ভাল থাকলে ছিপের পারদের পুঁটলিতে আটকে যায় সোনার চেন, লকেট, কানের দুল।
সোনার গয়না গঙ্গার ঢেউয়ে বয়ে যায়? হাওড়া স্টেশন সংলগ্ন একটা ঘাটের কাছে এক স্টিমারের খালাসি জানান, স্নান করতে নেমে অনেক মহিলাই গলার হার হারিয়ে ফেলেন, বা কানের দুল। স্রোতের টানে ভেসে যাওয়া সোনার গয়না ওরা ধরে ফেলে ওই ছিপ দিয়ে।
কয়েকটি চালচুলোহীন কিশোর খুব ভোরে ছিপ ফেলতে আসে। হাওড়া স্টেশনের ২৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মের পাশে যেখানে মালগাড়ির প্ল্যাটফর্ম, তার কাছেই ওরা ইতিউতি থাকে। আগে ওরা হাওড়া স্টেশনে থাকত (এখন বারণ), দূরপাল্লার ট্রেন স্টেশনে এলেই লাফিয়ে উঠে পড়ত ট্রেনে। যাত্রীদের সিটে ফেলে দেওয়া কেক, পেস্ট্রি খুজে বের করত। এমনকী মাঝে মাঝে প্যান্ট্রি কারের খাবারও জুটে যেত ওদের। মলিন গেঞ্জি পরা এক কিশোর জানাল, রাজধানী এক্সপ্রেসের প্যান্ট্রি কারের খাবারও খেয়েছি! কিন্তু এখন পুলিশের কড়াকড়িতে আর ট্রেনে এ ভাবে ওঠা যায় না।
কিন্তু স্টেশন চত্বর ছাড়েনি ওরা। দোকানে ফাইফরমাশ খাটে, আর উপরি-ইনকাম বলতে মা গঙ্গাই ভরসা। ময়লা জিনস পরা ঢ্যাঙা একটা ছেলে, লিডার টাইপের, জল থেকে ছিপ তুলে সঙ্গীদের বলল, চল চল আজ আর কিছু হবে না।
কিন্তু অনেক দিনই হয়। অনেকেই ভোরে গঙ্গাকে প্রণাম করতে এসে পুণ্য লাভের আশায় গঙ্গার জলে কয়েন ছুড়ে ফেলেন। শুরু হয় ছিপ ফেলে ওই কয়েন ধরার প্রতিযোগিতা। ছিপের গায়ে যতগুলো চুম্বক আটকানো, ততগুলো কয়েন যদি আটকায়, তা হলে তো কেল্লা ফতে। এ রকম অবশ্য খুব কমই হয়। হলে, জলখাবারে মুড়ির বদলে ডিম পাউরুটি। কিংবা ডেনড্রাইটের আঠার নেশার বদলে অন্য কোনও নেশা!
aryabhatta.khan@gmail.com