চালবাজ চাঁদু

পুঁটি আর মৌরলা ছাড়া বিশেষ তেমন মাছ নেই ডোবাটায়। তবু মাছ ধরার নেশায় পুজোর ছুটির দুপুরগুলিতে দুই বন্ধু ছিপ নিয়ে হত্যে দেয় ডোবার ধারে। তা আজও তেমনি অর্ক আর দীপ ছিপ নিয়ে বসতে না বসতেই ছেলেটি এল। অর্কদের পাশের বাড়িতেই নতুন ভাড়াটে হিসেবে ক’দিন হল এদের আগমন ঘটেছে। ছেলেটির ডাকনাম চাঁদু। দেখে মনে হয় ওদের থেকে সামান্য বড় হবে বয়সে।

Advertisement

বিপুল মজুমদার

শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:০৩
Share:

অলঙ্করণ: অভিষেক ভট্টাচার্য

পুঁটি আর মৌরলা ছাড়া বিশেষ তেমন মাছ নেই ডোবাটায়। তবু মাছ ধরার নেশায় পুজোর ছুটির দুপুরগুলিতে দুই বন্ধু ছিপ নিয়ে হত্যে দেয় ডোবার ধারে। তা আজও তেমনি অর্ক আর দীপ ছিপ নিয়ে বসতে না বসতেই ছেলেটি এল। অর্কদের পাশের বাড়িতেই নতুন ভাড়াটে হিসেবে ক’দিন হল এদের আগমন ঘটেছে। ছেলেটির ডাকনাম চাঁদু। দেখে মনে হয় ওদের থেকে সামান্য বড় হবে বয়সে। হয়তো ক্লাস নাইন-টেনে পড়ে। কোমরে বারমুডা, গায়ে লাল গেঞ্জি, চোখে সানগ্লাস, হাতে ঘড়ি। কাছে এসে সানগ্লাসটাকে কপালের উপরে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘কী মাছ ধরা হচ্ছে শুনি?’

Advertisement

অর্ক ফাতনা থেকে চোখ তুলল, ‘পুঁটি মাছ।’

পুঁটি মাছ...! আমি ভাবলাম রুই-কাতলা বুঝি। চাঁদু ঠোঁট উলটে কথাটাকে এমন ভাবে বলল যে দেখে গা পিত্তি জ্বলে গেল অর্কের। সে তিরিক্ষি হয়ে বলল, ‘কেন পুঁটি বুঝি মাছ নয়?’ চাঁদু হাসল একটু, ‘আমি বলতে চাইছি— মারি তো গণ্ডার লুটি তো ভাণ্ডার। মাছ ধরবি তো বড় মাছ।
বঁড়শি মুখে নিয়ে মাছ ছুটবে, খেলিয়ে খেলিয়ে কায়দা
করে তাকে ডাঙায় তুলবি তবেই না মাছ ধরা। পুঁটি মাছে সেই মুখ কোথায়?’

Advertisement

দীপ এ বার মুখ খুলল, ‘শখের অ্যাংগলার আমরা, তার উপর ছোট। মজা যে পাচ্ছি এটাই আসল কথা।’

সে ঠিক আছে, তবে মাছ ধরার আসল মজা কিন্তু সমুদ্রে। আমার কিন্তু সমুদ্রে মাছ ধরার ব্যাপক অভিজ্ঞতা আছে!

দুই বন্ধু ফ্যাল ফ্যাল করে চাঁদুর মুখের দিকে তাকাল। বিস্ময় কাটতেই দীপ বলল, ‘তা শুনি কী অভিজ্ঞতা?’

গত বছর ব্যাঙ্ককে বেড়াতে গিয়ে হুইল নিয়ে এক দিন বসে পড়েছিলাম মাছ ধরতে। এক সময় বঁড়শিতে বিশাল এক ইলিশ মাছ ধরা পড়ল। মাছটাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গেই ওটাকে ছেড়ে দিলাম।

ছেড়ে দিলি...! কেন? দীপের চোখ প্রায় ছানাবড়া।

না ছেড়ে করবটা কী, আমরা তো কেউ ইলিশ মাছ খাই-ই না! আমাদের ফেভারিট মাছ হল ভেটকি, পমফ্রেট, বোয়াল আর কাতলা। বাড়িতে মাছ হলে বেশির ভাগ সময় এ সবই হয়। পুঁটিফুটি আমাদের একদম পোষায় না!

নতুন আলাপ আর তাতেই এত লম্বা চওড়া কথা! দীপ অর্কদের পাশের পাড়াতেই থাকে। ডেঁপো ছেলে হিসেবে পাড়ার দীপের খুব নামডাক। সেই দীপও চাঁদুর বাগাড়ম্বরে কেমন যেন মিইয়ে গেল। ছিপ হাতে পাশে বসে থাকা অর্ককে ফিসফিস করে বলল, ‘যন্তর একটা!’

তা ওই যন্তরের সঙ্গেই ক’দিনের মধ্যে ওদের ভাব জমে গেল। কিন্তু তার পরেও কী করাণে যেন মাছের গল্প থেকে চাঁদু সরল না। তবে এ বার ডোবা সমুদ্র থেকে মাছকে নিয়ে তুলল রান্নাঘরে। এক দিন বলল, ওদের বাড়িতে প্রায়দিনই নাকি তিন চার পদের মাছ রান্না হয়। আজ হয়েছে কাতলা, পমফ্রেট, পাবদা আর পারশে! আর এক দিন বলল, ভেটকি, বোয়াল আর চিতল মাছ খেয়ে ওর নাকি পেট ভার! এই ভাবে দিনের পর দিন মাছ খাওয়ার সাতকাহন শুনতে শুনতে তিতিবিরক্ত অর্ক এক দিন দীপকে বলল, ‘কাল চাঁদুদের বাড়ির চার পাশে সারা দিন আমি চক্কর কেটেছি! কোথাও মাছের কাঁটার চিহ্নমাত্র খুঁজে পাইনি। আমার তো মনে হয় ব্যাটা নির্ঘাত গুল মারছে!’

চাঁদুর বকবকানিতে দীপও অতিষ্ঠ। সে তাই ঘাড় নাড়ল, ‘আমারও তাই মনে হচ্ছে। তুই খেয়াল করেছিস কি না জানি না, চাঁদু যে ঘড়িটা পরে থাকে সেটা কিন্তু অচল ঘড়ি!’

অর্ক চোখ গোলগোল করল, ‘তাই নাকি! আমাকে তো বলেছে প্রচণ্ড দামি ঘড়ি। মুম্বই থেকে কেনা।’

মুম্বই না হাতি। ‘ঘড়িটা বন্ধ কেন’ জানতে চাওয়ায় ও কী বলল জানিস? বলল, ব্যাটারি ডাউন হয়ে গেছে। দিল্লি থেকে ব্যাটারি আনাতে হবে।

অর্ক ভুরু কোঁচকাল, ‘ও এটাও বলেছে সানগ্লাসটা নাকি দুবাই থেকে কেনা। দাম দু’হাজার টাকা। এখন তো মনে হচ্ছে পুরোটাই গ্যাস!’

ব্যাটা ঘুঘু দেখেছে ফাঁদ দেখেনি! চোখ তেরছা হয়ে গেল দীপের, ‘দাঁড়া ওর ব্যবস্থা আমি করছি।’

পর দিন ডোবার ধারে চাঁদু এলে পাকা অভিনেতার মতো দীপ বলল, ‘আমাদের বাড়িতে চারখানা বেড়াল আছে। তোরা তো রোজ প্রচুর মাছ খাস। তা মাছের কাঁটাগুলিকে ফেলে না দিয়ে যদি আমাকে দিস তা হলে বেড়ালগুলোর খুব উপকার হয়। দিবি?’

দীপের কথায় থতমত খেলেও পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিল চাঁদু, ‘কাঁটা... কাঁটা তো আমরা ফেলি না! মাছ খাওয়ার পর কাঁটাগুলিকেও আমরা চিবিয়ে খেয়ে ফেলি!’

মাছের কাঁটা... খাস তোরা! দীপের চোখ প্রায় কপালে।

খামোকা ফেলতে যাব কেন বল তো! কাঁটায় যে ক্যালসিয়াম আছে সেটা জানিস না বুঝি?

চাঁদুর কথায় অর্ক আর দীপ পুরো ভ্যাবলা। খানিকবাদে চাঁদু বিদায় নিলে অর্ক দীপকে বলল, ‘বারাসাতে পুঁতলে বেড়াচাঁপায় গিয়ে গাছ হয়ে বেরোবে এমন ধড়িবাজ ছেলে। ওর সঙ্গে তুই পেরে উঠবি না রে দীপ।’

দীপের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল, ‘এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র আমি নই। একটা মতলব আমার মাথায় এসেছে। গোয়েন্দাগিরি করেই ব্যাটাকে এ বার জব্দ করব!’

মানে?

মানেটা ক্রমশ প্রকাশ্য!

পর দিন সকালে চাঁদুর বাবা থলে হাতে বাজারে বেরোতেই দীপ ভদ্রলোকের পিছু নিল। এটা সেটা কেনবার পর একটা সময় ভদ্রলোক মাছের বাজারে গিয়ে ঢুকলেন। দীপ আড়াল থেকে স্পষ্ট দেখল দুশো গ্রাম পুঁটিমাছ কিনলেন ভদ্রলোক। এর পর আর কোনও রকম মাছ না কিনে চাঁদুর বাবা মাছের বাজার ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই দীপ ‘ইয়াহু’ বলে দু’হাত শূন্যে ছুড়ে দিল। মনে মনে চাঁদুকে বলল, তোর চালবাজির বেলুনটাকে এ বার আমি ঠিক চুপসে দেবই।

দুপুরবেলা ডোবার ধারে দু’জনে ওঁত পেতেই ছিল। চাঁদু হাজির হতেই পরিকল্পনামাফিক দীপ লাফ দিয়ে পড়ল। কোনও রকম ভণিতা না করেই বলল, ‘তোর বাবাকে আজ বাজার থেকে দুশো গ্রাম পুঁটিমাছ কিনতে দেখলাম। ব্যাপারটা আমার ঠিক হজম হল না। শুধু পুঁটিমাছ, তাও আবার কিনা দুশো গ্রাম!’

দীপ ভেবেছিল ওর কথায় ঘেমে নেয়ে বোধ হয় একসা হবে চাঁদু। কিন্তু সেই রকম কিছু ঘটলই না। উলটে মুখে আলতো একটা হাসি টেনে চাঁদু বলল, ‘তুই যে বাবার পেছন পেছন যাচ্ছিল সেটা আমি দেখেছি! আরে ও মাছ তো তোদের বেড়ালগুলোর জন্যই কেনা! আজ আমাদের নিরামিষ। তোদের বেড়ালগুলোর কথা বাবাকে বলায় বাবা আজ বাজারে গিয়েছিলেন ওদের জন্য কিছু মাছ কিনতে। কিন্তু পরে ওই পুঁটিমাছগুলো তোদের বাড়িতে পৌঁছতে গিয়ে জানতে পারলাম তোদের কোনও বেড়ালই নেই!’ অগত্যা কী আর করি, মাছগুলোকে ড্রেনে ফেলে দিয়ে চলে এলাম। তা বেড়াল নিয়ে ফালতু এমন গুল মারলি কেন রে? জানিস না মিথ্যা বলা মহাপাপ!’

চাঁদুর অন্তিম কথায় দীপের চোয়াল প্রায় এক হাত ঝুলে পড়ল। নিজে ভুরি ভুরি মিথ্যা কথা বলে এখন বলছে মিথ্যা বলা মহাপাপ! বন্ধুর ভাবগতিক দেখে অর্ক গলা নামিয়ে বলল, ‘তুই ওর উপর কী গোয়েন্দাগিরি করবি, ও তার আগেই তোর নাড়িনক্ষত্র জেনে নিয়েছে। উফ, কী ঘোড়েল ছেলে রে বাবা!’

দীপ কোনও মন্তব্য করল না। সে ফ্যালফ্যাল করে ডোবার জলের দিকে তাকিয়ে রইল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement