ছবি: সুমন চৌধুরী।
ফাঁসির আসামি চলেছে বধ্যভূমির দিকে। মার্চ মাসের সকালে তাকে দেখতে লন্ডনের রাস্তায় ইতস্তত জটলা। সেখান থেকে ঘৃণা-মেশানো বিদ্রুপ-বাণ তার দিকে। ঠগ জোচ্চোর বাটপাড় কোথাকার! উচিত শাস্তি হয়েছে ব্যাটার! আসামি কর্ণপাত করছে না সে-সবে। সে বরং চেঁচাচ্ছে তারস্বরে। ‘ভাই সব, বিচারের নামে প্রহসন! বাঁচাও, আমাকে খুন করা হচ্ছে!’ তার চেঁচানিতে জনতার আমোদ বাড়ে।
১৬৯৯ খ্রিস্টাব্দের লন্ডন। ভূগর্ভ নর্দমা দূর অস্ত। পথের পাশে পড়ে থাকে গু-মুত। হাত-পা বেঁধে স্লেজগাড়িতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আসামিকে। অপরাধী সে, তাই এর চেয়ে ভাল যান বরাদ্দ নয় তার জন্য। ঘষটে ঘষটে চলেছে স্লেজ। গু-মুত ছিটকে পড়ছে আসামির জামাকাপড়ে। তা দেখে জনতার অট্টহাসি। তাতেও আসামি নির্বিকার। সে শাপ-শাপান্ত করছে সেই বিচারকদের, যাঁরা রায় দিয়েছেন তার ফাঁসির। আর সেই সঙ্গে কুশ্রাব্য গালাগাল বিশেষ এক জনের নামে। আইজাক নিউটন।
নিউটন? হ্যাঁ। যিনি গতির তিন সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন, স্বর্গে-মর্তে ক্রিয়াশীল অভিন্ন মহাকর্ষ বলের সন্ধান পেয়েছিলেন, সাগরে জোয়ার-ভাটার কারণ বুঝেছিলেন, সূর্যালোকের উপাদান বিশ্লেষণ করেছিলেন, ক্যালকুলাস নামে গণিতের অসীম মূল্যবান শাখা উদ্ভাবন করেছিলেন, যাঁর প্রতিভাকে স্বয়ং আলবার্ট আইনস্টাইন কুর্নিশ জানিয়েছিলেন, সেই নিউটন। হায়, বিজ্ঞানীকুলচূড়ামণি হিসেবে যিনি পূজিত, তিনি কেন কুখ্যাত এক অপরাধীর খিস্তির লক্ষ্য? পিছনে লুকিয়ে আছে কিস্সা।
১৬৯৬। অধ্যয়ন অধ্যাপনা এবং গবেষণায় কেমব্রিজের ট্রিনিটি-তে ৩৫ বছরের পাট শেষ। নিউটন এ বার গড়তে চান নতুন কেরিয়ার। মোটা মাইনের সরকারি আমলার চাকরি। তাঁর নতুন ঠিকানা দেশের রাজধানী লন্ডন। বন্ধুদের উমেদারিতে জুটেছে চার গুণ বেশি বেতনের কাজ। সরকারি টাঁকশালে। প্রথমে ওয়ার্ডেন, পরে ভাল কাজ দেখিয়ে সেখানকার ‘মাস্টার’ বা প্রধান।
সরকারি কোষাগারে অবশ্য সে বড় সুখের সময় নয়। রাজা তৃতীয় উইলিয়াম ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধে নামতে চান। তাঁর চাই অর্থ। বাজার থেকে পাউন্ড তুলতে তিনি ব্যর্থ। কারণ? মুদ্রার বাজারে মড়ক। এক দিকে হু-হু করে ঢুকছে নকল কয়েন, চোরাকারবারিদের দৌলতে। অন্য দিকে এদের আর এক কুকীর্তি। আসল কয়েন থেকে রুপো কেটে নিয়ে শত্রু-দেশ ফ্রান্সে তা বিক্রি। ওখানে ধাতুটা বিক্রি হয় বেশি দামে। টাঁকশালের প্রধান হিসেবে সমস্যা মোকাবিলার দায় নিউটনের। তিনি কি পারবেন তা সামলাতে? এত কাল ছিলেন গবেষণার গজদন্তমিনারে। এ বার অপরাধ-দুনিয়ার সঙ্গে লড়াই। চোর-ছ্যাঁচড়দের মোকাবিলা।
শয়তান অনেক। পালের গোদা এক জন। উইলিয়াম শ্যালোনার। অতীত ইতিহাস দারুণ! জোচ্চুরি দিয়ে জীবন শুরু। কখনও ডাক্তার, কখনও গণৎকারের ভেক ধরে রোজগার। কখনও আবার যৌনক্রিয়ার যন্ত্রের ব্যবসাদার। শেষমেশ কয়েন-চোরাকারবারের ডন। বিবাহিতা স্ত্রী পরিত্যক্তা বহুকাল। এখন একাধিক রক্ষিতা। কপালে বিপদ লেখাই ছিল এই কুচক্রীর, শুধু বুদ্ধির দোষে তা ত্বরান্বিত করল সে। প্রচুর অর্থব্যয়ে কাজে নামাল প্রচারযন্ত্র। রটিয়ে দিল, নিউটনের অধীনে টাঁকশালে চলছে দুর্নীতি, সুতরাং রাজা বরখাস্ত করুন তাঁকে। শ্যালোনার পরবর্তী টাঁকশাল- প্রধান হতে রাজি। অভিযোগ গড়াল বহু দূর। নিউটনকে দাঁড়াতে হল তদন্ত কমিশনের কাঠগড়ায়।
বুনো ওলকে টেক্কা দিতে ময়দানে এ বার বাঘা তেঁতুল। মানুষ চিনতে ভুল করেছিল শ্যালোনার। ভেবেছিল, আমলা তো কেমব্রিজের পুরনো অধ্যাপক, ফাঁদে ফেলা যাবে তাঁকে। কার ফাঁদে কে পড়ে! শ্যালোনারের যাবতীয় কুকীর্তি ফাঁস করতে তদন্তের দায়িত্ব পুলিশের বদলে নিজের হাতে নিলেন নিউটন। আমলা থেকে বনে গেলেন গোয়েন্দা। রাতের অন্ধকারে মাঝে মাঝে ছদ্মবেশে হানা দিলেন অপরাধ জগতে। ভয় দেখিয়ে, ঘুষ দিয়ে হাত করলেন শ্যালোনার-এর এক-এক স্যাঙাৎকে। জোগাড় করলেন তার চোরাকারবারের সাক্ষ্যপ্রমাণ। মাফিয়া ডন এ বার শ্রীঘরে। শুরু হল আদালতে বিচার। মুদ্রার চোরাকারবার মানে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। সুতরাং, সাজা ফাঁসি। এ বার শ্যালোনার নিউটনের সামনে নতজানু। করুণ আর্তি জানিয়ে তাঁর উদ্দেশে একাধিক চিঠি। দয়াপরবশ হয়ে তিনি যেন শ্যালোনারের প্রাণভিক্ষা চান রাজার কাছে। নিউটন নির্বিকার। ফাঁসির দড়ি গলায় পরার আগে তাই প্রাণ ভরে গালাগালি তাঁকে।
এ এক অন্য নিউটন। আমাদের অচেনা। জনমানসে গ্রথিত তাঁর অন্য এক ইমেজ। এক গবেষক, যিনি একা একা অঙ্ক কষে উদ্ঘাটন করেন বিশ্বরহস্য, না খেয়ে ও না ঘুমিয়ে কাটান রাতের পর রাত, শুধু পরীক্ষার জন্য সূর্যের প্রচণ্ড দীপ্তির দিকে তাকিয়ে থাকেন অনেক ক্ষণ, অথবা নিজের চোখে নিজে ফুটিয়ে দেন পিন। আশ্চর্য, এই জ্ঞানতপস্বীরও ছিল যে অন্য এক জীবন, তা জানা গেছে ধীরে ধীরে। বিশেষজ্ঞেরা বিস্মিত। লিখে চলেছেন একের পর এক বই। দু’রকম নিউটন নিয়ে। ২০ মার্চ তাঁর মৃত্যুর ২৮৭ বর্ষপূর্তি। ক’দিন আগে প্রকাশিত হয়েছে ৫৫০ পৃষ্ঠার বই। ‘নিউটন অ্যান্ড দি ওরিজিন অব সিভিলাইজেশন’। লেখক দুই বিশেষজ্ঞ। ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির জেড বাকওয়াল্ড। এবং তাঁর সহকর্মী মরদেশাই ফিনগোল্ড। নিউটন বিষয়ে যাঁদের গবেষণা বহু কালের। ওঁদের উদ্দেশ্য: দুই নিউটন আলোচনা।
জনমানসে অজানা নিউটনের আত্মপ্রকাশ ১৯৩৬ সালে। তার আগে? প্রায় ২০০ বছর মানুষ জানত কেবল এক জন নিউটনকে। মহাবিজ্ঞানীর মৃত্যু হয় ৮৪ বছর বয়সে। ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ মার্চ। ঘটনাচক্রে তখন লন্ডনে উপস্থিত বিখ্যাত এক ব্যক্তিত্ব। ফরাসি লেখক ভলতেয়ার। প্রয়াত নিউটনকে রাষ্ট্রের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন দেখে তিনি বিস্মিত। মরদেহ কাঁধে নিলেন এক জন চ্যান্সেলর, দুই ডিউক, তিন আর্ল। পিছনে রয়াল সোসাইটি’র সভ্যবৃন্দ। দেহ ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবে-তে রাখা হল আট দিন। তার পর সেখানে রাজকীয় মর্যাদায় সমাধি। আর তাতে প্রস্তরফলকে উৎকীর্ণ বিশেষ প্রশস্তি। ‘এখানে শায়িত তিনি, যাঁর মনীষা ঈশ্বর-তুল্য। মানবজাতির এ হেন অলংকার আমাদের গর্ব।’ অচিরে ব্রিটিশ কবি আলেকজান্ডার পোপ লিখলেন বিখ্যাত সেই দুটি লাইন। বাইবেল-এর পংক্তির অনুকরণে। সৃষ্টির আদিপর্ব বর্ণনায় ওখানে বলা হয়েছে, বিশ্ব ছিল তমসাচ্ছন্ন। তার পর ঈশ্বরের আশীর্বাদে কাটল অন্ধকার। ‘গড সেড লেট দেয়ার বি লাইট, অ্যান্ড দেয়ার ওয়জ লাইট।’ ওই লাইন ভেবে পোপ লিখলেন— নেচার অ্যান্ড নেচার’স ল’জ লে হিড ইন নাইট/ গড সেড, ‘লেট নিউটন বি’, অ্যান্ড অল ওয়জ লাইট। প্রকৃতির রহস্য ছিল অন্ধকারে ঢাকা। নিউটন আবির্ভূত হলেন আলোকবর্তিকা নিয়ে।
ওই ভাবমূর্তি ক্রমে এত দৃঢ় হল, জীবনীলেখকরা মজে রইলেন তাতে। ১৮৩১ সালে প্রকাশিত হল স্যর ডেভিড ব্রুস্টার-রচিত ‘দ্য লাইফ অব স্যর আইজাক নিউটন’। উপজীব্য: এক জ্ঞানতপস্বী, যিনি কিনা মহামানব। সেই ইমেজ চুরমার হল অকস্মাৎ। ওই ১৯৩৬ সালে। সে এক কাহিনি। ব্যক্তিগত কাগজপত্র প্রায়ই পুড়িয়ে ফেলতেন বিজ্ঞানী। তার বাইরেও বান্ডিল ছিল বহু। যে সব তাঁর জীবনীলেখকরা ছুঁয়েও দেখেননি। আর কেমব্রিজ বিশ্ববিদালয়ের মহাফেজখানা সংগ্রহে রাখেনি। রাখবে কেন, ও সব নাকি ফালতু। ও রকম বহু বান্ডিল নিউটনের পরিবারের তরফে ওই বছর নিলামে তোলা হল। মাত্র ৯০০০ পাউন্ডে অনেকটা কিনলেন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইন্স। লেখাজোখা পড়তে বসে তিনি বিস্ময়ে হতবাক। নিউটন যতটা না ভেবেছেন গ্রহ-তারা নিয়ে, তার চেয়ে ঢের বেশি পরীক্ষা করেছেন অ্যালকেমি বিষয়ে। হ্যাঁ, অ্যালকেমি। মধ্যযুগীয় বুজরুকি। পারদকে সোনা বানানোর স্বপ্ন। অথবা অনন্ত যৌবন লাভের সালসা প্রস্তুতের খোয়াব। ডাকিনীতন্ত্র চর্চাতেও আগ্রহ তাঁর। ৬৬৬ সংখ্যাটি যে অশুভ, ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম যে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০৪ অব্দে, কিংবা ব্রহ্মাণ্ড যে ধ্বংস হবে ২০৬০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ— এ সব বিষয়েও বিস্তর খেটে প্রবন্ধ রচনা! হায়, এই নিউটন নাকি বস্তুবাদের জনক! মহাবিজ্ঞানীর জন্মের ত্রিশতবর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে কেইন্স যে বক্তৃতা দিলেন তার শিরোনাম— ‘নিউটন, দ্য ম্যান’। কেইন্স বললেন, ‘নিউটন ওয়জ নট দ্য ফার্স্ট অব দি এজ অব রিজন, হি ওয়জ দ্য লাস্ট অব দ্য ম্যাজিশিয়ানস।’
বিজ্ঞান নাকি বিশ্বপিতার গরিমা-হানির ধারাবিবরণী। এ ব্যাপারে পূজা পান তিন মনীষী। নিকোলাস কোপার্নিকাস, যিনি মানুষের বাসভূমি পৃথিবীকে উৎখাত করেছিলেন বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু থেকে। চার্লস ডারউইন, যিনি বলেছিলেন, মানুষ ঈশ্বরসৃষ্ট আলাদা কোনও জীব নয়, নেহাতই উন্নত পশু। ওঁদের দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন নিউটন। তিনি খর্ব করেছিলেন স্বর্গের মহিমা। প্রমাণ করেছিলেন, যে কারণে গাছের আপেল পড়ে মাটিতে, ঠিক সে কারণেই গ্রহেরা ঘোরে সূর্যের চার পাশে। অর্থাৎ স্বর্গে আর মর্তে বলবৎ একই নিয়ম। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নিউটন-আবিষ্কৃত নিয়মের দাস। সব কিছুর ব্যাখ্যা কণায়-কণায় আকর্ষণ। ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। এর বাইরে আর কোনও ঘটনা নেই। এই বিশ্বাস, বলা বাহুল্য, আধুনিক বিজ্ঞানের মূলমন্ত্র। এর সুবাদে নিউটন পূজিত হন কার্যকারণবাদের প্রবক্তা হিসেবে। অথচ, তিনিই ছিলেন পরম ঈশ্বরভক্ত। বিশ্বাস করতেন মহাকর্ষ জিনিসটা বিশ্বপিতার অভিপ্রায়। নইলে গ্রহ-তারা সব দিগ্বিদিকে ছুটে পালাবে যে। ওদের মাঝে টান না থাকলে বিশ্বসংসার বাঁধা থাকবে না। ঈশ্বর? তিনি তো সর্বত্র বিরাজমান। তিনি আছেন বলেই গ্রহ-উপগ্রহেরা হাঁটছে নিজ নিজ পথে। ধাক্কা খাচ্ছে না কেউ কারও সঙ্গে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, নিউটনের অবচেতন মনের হদিশ মিলবে তাঁর শৈশবের তীব্র বেদনাক্লিষ্ট দিনযাপনে। জন্মের আগে পিতৃবিয়োগ। বয়স তিন বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মায়ের আবার বিয়ে। এমন এক বৃদ্ধের সঙ্গে, যে আবার মায়ের চেয়ে তিরিশ বছরের বড়। ওই শিশু সৎবাবার চক্ষুশূল। ফলে শিশু নিউটন মায়ের কোল থেকে বঞ্চিত। মা নতুন স্বামীর ঘর করতে গেলে নিউটন ঠাকুমার আশ্রয়ে। শৈশবের আর কী বাকি থাকে? শিশুটি নিজের খাতায় লেখে মনের বাসনা। সে চায় মা ও বাবাকে একটা ঘরে ঢুকিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিতে। এ শিশু একা, নিতান্ত একা। তার খেলার সঙ্গী নেই কোনও, সে মেশে না কারও সঙ্গে। এ হেন শিশু পিতার আসনে বসিয়েছিল এক জনকেই। ঈশ্বর, বিশ্বপিতা। বিশ্বের রহস্য উদ্ধার মানে তাঁর বাণী শোনা।
প্রেম-ভালবাসা? না, নারীসংসর্গে বিমুখ ছিলেন আজীবন। এক সন্ন্যাসিনী সম্পর্কে সরস মন্তব্য করায় বাক্যালাপ বন্ধ করেছিলেন এক বিজ্ঞানীর সঙ্গে। চিকিৎসককে জানিয়েছিলেন, নিজের কৌমার্য নষ্ট হতে দেননি কখনও। তবে, কেউ কেউ সন্দেহ করেছেন নিউটনের সমকামী প্রবণতা। নিকোলাস ফ্যাতিয়ো দ্য দুইলিয়ের নামে এক যুবকের সঙ্গে রাতের পর রাত কাটত তাঁর। দুজনে গোপনে এক্সপেরিমেন্ট করতেন অ্যালকেমির। আর কোনও ব্যক্তির সঙ্গে এমন গভীর বন্ধুত্ব হয়নি নিউটনের। আর কারও রোগভোগে অতটা গভীর বিচলিত হননি তিনি। অবশ্য এ সখ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বহু বছরের বন্ধুত্বে অকস্মাৎ ইতি টেনে নিকোলাস সরে গিয়েছিলেন নিউটনের জীবন থেকে। আর নিউটন ডুবে গিয়েছিলেন তীব্র অবসাদে। প্রায় মানসিক বিপর্যয়ের মুখে। এতটাই যে, সতীর্থ বিজ্ঞানীদের উদ্দেশে লেখা চিঠিতে তিনি হঠাৎ ভীষণ রূঢ়, কর্কশ। তাঁরা তো বিভ্রান্ত। এ কোন নিউটন? এমন বদমেজাজি আর অভদ্র তো তিনি ছিলেন না আগে। কী হল হঠাৎ? অবশ্য কারও কারও মতে, অবদমিত যৌনতা নয়, ওই মানসিক দশা ভিন্ন কারণে। ওটা অ্যালকেমি পরীক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা পারদের বাষ্প প্রশ্বাসে প্রবেশের পরিণাম।
নিউটনের আধুনিক জীবনীকারেরা একটা ব্যাপারে একমত। বন্ধুত্বে যতটা না চেনা যেত তাঁকে, তার চেয়ে ঢের বেশি বোঝা যেত শত্রুতায়। তখন বিজ্ঞানী কুটিল, প্রতিহিংসাপরায়ণ। প্রায় হিংস্র।
জ্যোতির্বিজ্ঞানী জন ফ্ল্যামস্টিড অ্যাস্ট্রোনমার রয়াল। মানে গ্রিনউইচ মানমন্দিরের অধিকর্তা। সুতরাং, গ্রহ-তারার চলনের প্রচুর তথ্য তাঁর হাতে। নিউটন চান সে সব। কেন? যে গ্রন্থ রচনা করে তিনি জগদ্বিখ্যাত হয়েছেন, সেই ‘প্রিন্খিপিয়া ম্যাথমেটিকা’-র নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হবে। নিউটন চান তাতে সংকলিত হোক জ্যোতির্বিজ্ঞানের সর্বশেষ তথ্য। যা রয়েছে মানমন্দিরের হেফাজতে। নিউটন তখন রয়াল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট। পদাধিকার বলে সোসাইটিতে ডেকে পাঠালেন ফ্ল্যামস্টিড-কে। এলেন তিনি। প্রবল অনিচ্ছাসত্ত্বেও। নিউটন তাঁর দু’চক্ষের বিষ। বলা বাহুল্য, নিউটনও তাঁকে দেখেন না সুহৃদ হিসাবে। বিদ্বেষ দ্বিপাক্ষিক। ফ্ল্যামস্টিড সন্দেহ করেন নিউটন কলকাঠি নাড়েন বলেই অ্যাস্ট্রোনমার রয়াল হয়েও তিনি বেতন পান কম। তেমন মানুষের তলব পেয়ে রয়াল সোসাইটিতে আসা। তীব্র বাদানুবাদ হল দুজনের। ফ্ল্যামস্টিড নিউটনের মুখের ওপর জানিয়ে দিলেন মানমন্দিরে সংগৃহীত তথ্য গ্রিনউইচ-এর সম্পত্তি। হুকুম করলেই নিউটন তা পেতে পারেন না। ঝগড়ার পরিণাম? রয়াল সোসাইটি থেকে বহিষ্কৃত হলেন ফ্ল্যামস্টিড।
আর এক জন। রবার্ট হুক। রয়াল সোসাইটির কিউরেটর। তিনি অভিযোগ করলেন ‘প্রিন্খিপিয়া’-য় নিউটন সাহায্য নিয়েছেন তাঁর গবেষণার। অথচ কৃতজ্ঞতা স্বীকারের সৌজন্য দেখাননি। অভিযোগ শুনে নিউটন ক্ষিপ্ত। মন্তব্য করলেন, ‘আমি যদি বহু দূর দৃষ্টিপাত করে থাকি, তবে তা দৈত্যদের কাঁধে দাঁড়ানোর সুবাদে।’ অর্থাৎ, হুক কোথাকার কে? ‘প্রিন্খিপিয়া’ তো রচিত কোপার্নিকাস, কেপলারের সাফল্যের সূত্র ধরে। নাহ্, মন্তব্যের ইঙ্গিত শুধু ওটুকু নয়। খোঁচাও লুকিয়ে তার মধ্যে। সাহায্য যদি নিয়েই থাকি তবে তা দৈত্যদের থেকে, বামনদের থেকে নয়। খোঁচার লক্ষ্য হুক। দেহ-গঠনে তিনি যে খর্বকায়।
নিউটনের জীবনে সবচেয়ে বড় কাজিয়া বিজ্ঞানের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। এ ঝগড়ায় তাঁর প্রতিপক্ষ জার্মান গণিতজ্ঞ গডফ্রিড উইলহেল্ম ফন লিবনিৎজ। ক্যালকুলাসের আবিষ্কর্তা কে, নিউটন না লিবনিৎজ? সত্য এই যে, নিউটন প্রথমে আবিষ্কার করেন গণিতের ওই শাখাটি। কিন্তু গোপনীয়তা তাঁর প্রিয় বলে আবিষ্কারটি না ছেপেই তিনি বসে থাকেন চুপচাপ। এর অনেক পরে লিবনিৎজ নিজের মতো করে আবিষ্কার করেন ক্যালকুলাস। এবং তা ছাপেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। নিউটনের বন্ধুদের উস্কানিতে নিউটনের সন্দেহ হয়, কারও মারফত তাঁর আবিষ্কার পৌঁছেছে লিবনিৎজ-এর কাছে। তড়িঘড়ি ছেপে দিয়ে তিনি এ বার দাবি করছেন কৃতিত্ব। লিবনিৎজ সন্দেহ উড়িয়ে দিলেন ফুৎকারে। শুরু হল কাজিয়া। প্রথমে গালমন্দ, পরে প্রায় রাজনৈতিক ঝামেলা। ইউরোপ মহাদেশ দু’ভাগ হয়ে গেল ক্যালকুলাস কাজিয়ার সূত্রে। এক দিকে নিউটন ও ইংল্যান্ডের প্রায় সমস্ত বিজ্ঞানী। অন্য দিকে লিবনিৎজ এবং ইউরোপের অন্য দেশের বিশেষজ্ঞরা। ঝগড়া চলল প্রায় তিন দশক। নিষ্পত্তি? হ্যাঁ, রয়াল সোসাইটি বসাল তদন্ত কমিশন। যার সদস্য মনোনীত করলেন নিউটন স্বয়ং। করবেনই তো, তিনি যে সোসাইটির প্রধান। সবচেয়ে বড় স্ক্যান্ডাল এই যে, কমিশনের রিপোর্ট বেনামে লিখলেন নিউটন। সিদ্ধান্ত? কী আবার, এই সারসত্য যে, নিউটনই ক্যালকুলাসের আসল আবিষ্কর্তা। বিজয়ী নিউটন মন্তব্য করলেন, ‘দ্বিতীয় আবিষ্কর্তা মানে লবডঙ্কা।’
অথচ, এ সব সত্ত্বেও, বিজ্ঞানী নিউটন কিন্তু অনেক, অ-নে-ক, বড়। তাই তাঁকে নিয়ে ধন্দে পড়েন জীবনীলেখকেরা। জ্ঞানতপস্যা এবং ক্রূরতা একসঙ্গে সামলানো যে কঠিন। রিচার্ড ওয়েস্টফল, যিনি লিখেছেন নিউটনের ন’শো পৃষ্ঠার জীবনী (‘নেভার অ্যাট রেস্ট’), তাঁর স্বীকারোক্তি স্মরণীয়। কাজ শুরুর আগে লেখক ভেবেছিলেন সময় লাগবে দশ বছর। বাস্তবে লাগে তার দ্বিগুণ। ২০ বছরকাল নিউটনে মজে থাকতে গিয়ে তাঁর মনে হয় তিনি ডুবে যাচ্ছেন অতলে। নিউটনের ৮৪ বছরের জীবনে কত যে চড়াই-উতরাই। মানুষটাও যে ভীষণ রহস্যময়। তাঁর মনের সন্ধান পাওয়া কি সহজ কথা! ওয়েস্টফল ভাবেন, অন্য কেউ নয়, এক জন নিউটনই কেবল লিখতে পারেন তাঁর জীবনী। অবশ্য, এটাও মনে হয় যে, সে কাজে রাজি হতেন না নিউটন। হবেন কী করে, তাঁর সম্পর্কে শেষ কথাটি যে বলেছিলেন অলডাস হাক্সলি। ‘অ্যাজ আ ম্যান নিউটন ওয়জ আ ফেলিয়োর, অ্যাজ আ মনস্টার হি ওয়জ সুপার্ব।’