দিদুন বার বার বলছে, ছি ছি, কী কেলেঙ্কারি! চশমাটা গেল তো গেলই? কোনও মতেই পাওয়া গেল না! পুজোর ছুটিতে এক সপ্তাহের জন্যে বাবা, মা, সোনাকাকুর সঙ্গে ভণ্ডুলও এসেছে। সকােল চা খেয়ে যে যার মতো উঠে পড়লেও, সোনাকাকু আর দাদুভাই বারান্দায় বসে অনেক ক্ষণ গল্প করেছে। দাদুভাই চলে আসার পরও সোনাকাকু একা একা বসে স্কেচ করছিল। স্নান করে চশমা খুঁজতে গিয়ে দেখে বারান্দায় নেই।
মা এসে ঘুমন্ত ভণ্ডুলকে নাড়াচাড়া দিয়ে চশমা খুঁজল। বাবাও এটা সেটা উলটে পালটে খোঁজার চেষ্টা করল। দিদুন আর দাদামশায়ও বাকি নেই। লক্ষ্মীমাসি সারা বাড়ি পরিষ্কার করে রান্নাঘর-ছাদ-সিঁড়ি সব জায়গায় খুঁজে দেখল। মা বোঝার চেষ্টা করল, বাইরে থেকে চোর ঢুকে নিয়ে গেল কি না! দিদুন বলল, মোবাইল, কলম, ঝোলা ব্যাগ— সবই তো তা হলে চোর নিয়ে যেত। সেগুলো তো যেমনকার তেমনই পড়ে আছে। শুধু চশমাটাই গায়েব! বাবার ইঙ্গিত ভণ্ডুলের দিকে। কারণ, সে মাঝে মাঝেই এটা সেটা নিয়ে লুকিয়ে রাখে। কখনও বের করে দেয়। মাঝে মাঝে আবার ভুলেও যায়। মা বললেন, ভণ্ডুল তো তখনও ঘুমোচ্ছিল, ও কী করে লুকোবে! বাবা বললেন, তা হলে চশমা ছাড়াই সোনা এখানে এসেছে!
সোনাকাকু কোনও কথা বলছে না। কারণ, চশমা না পরলে সে শুধু ঝাপসা দেখে তাই নয়, কানেও কম শুনতে পায়। কয়েক দিন ধরে সোনাকাকু কত স্কেচ করেছে। কবিতাও লিখেছে কয়েকটা। গতকাল মা আর দিদুনকে সে সব দেখাচ্ছিল। বাবা আর সোনাকাকু রোজ একসঙ্গেই বেরিয়ে যায়। বাড়ির ব্যবসা দেখে দু’জনে মিলে। ঘুম থেকে উঠেই দাদুভাইয়ের কাছে চলে এল ভণ্ডুল। বাড়ির সবাই কী যেন খুঁজে চলেছে। রাতের পোশাক ছেড়ে, দাঁত ব্রাশ করে বারান্দার চেয়ারে পা তুলে ভণ্ডুল বসল। সোনাকাকু একা একা বাগানে পায়চারি করছে। মাঝে মাঝে মুখ তুলে, গাছগুলোর মাথা দেখার চেষ্টা করছে বোধ হয়। এক গ্লাস দুধ খেয়ে ভণ্ডুলও বসে থাকল সোনাকাকুর চেয়ারটায়। খুব রাগ হয়েছে ভণ্ডুলের। কে জানে সোনাকাকুও বাবার মতো ভাবছে কি না যে, ভণ্ডুলই চশমাটা লুকিয়ে রেখেছে। আজ বোধ হয় সোনাকাকুর সঙ্গে আর বাঁধের ধারে বেড়াতে যাওয়াও হবে না। পুকুরে নেমে স্নানও কি হবে? ভণ্ডুল তার ড্রইং খাতাটা এনে নিজেই ছবি আঁকতে বসল।
হঠাৎ হইহই শব্দে কান পাতাল ভণ্ডুল। ঘর পেরিয়ে দরজার দিকে গিয়ে দেখে, পাশের বাড়ির তারকদাদু দু’চার জন লোক সঙ্গে নিয়ে দাদুভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কী সব বলে চিৎকার জুড়েছেন। মা একটা মোড়া এনে বসতে দিয়েছে। দিদুন কয়েক গ্লাস জল এনে সকলকে দিচ্ছেন। দাদুভাই সব শুনে বললেন, শুধু মইটা নিয়ে তো হবে না, বড় লগিটাও নিয়ে যাও। গাছে মই লাগিয়ে কাকের বাসা ভাঙবে, সে আবার হয় নাকি! ভণ্ডুল জানে মস্ত সরু লাঠিটাকে লগি বলে। আর এই কাঠের মইটায় উঠে দিদুন পাখা মোছে, কখনও বাড়ির বাইরে লাগিয়ে জানলার শার্শিও পরিষ্কার করে। মইটাকে তাই দিদুন হাতছাড়া করতে চায় না। বাবা তো হো হো করে হেসেই খুন। তারকদাদুর টেবিল থেকে চশমা নিয়ে উড়ে যাবার সময়, কাকটার সঙ্গে দৌড়ে, তারকদাদু দেখেছেন যে নিমগাছের ডালে ওই বাসাটাতেই নাকি চশমাটা রেখেছে একটা ‘বদমায়েশ’ কাক! বাবা বলল, ভণ্ডুল চল, চল, বাগানে যাই, নকশাটা দেখেই আসি। মা তো আগেই লগি নিয়ে পৌঁছে গেছে। সোনাকাকু গাছতলায় চুপচাপ বসেছিল। সবাইকে মই, লগি, ঝাঁটা, ঝুলঝাড়ু নিয়ে দল বেঁধে আসতে দেখেই উঠে দাঁড়াল।
তারকদাদুর দল গাছটার কাছাকাছি আসতেই ‘কা-কা’ শব্দে বাগান ভরে গেল। যত কাক যেখানে ছিল, সক্কলে এসে পড়েছে বাসাটা বাঁচাতে। দাদুভাই, বাবা আর ভণ্ডুলের মাথায় টোকা চাপানো। ঠোকরাবার ভয় নেই। সোনাকাকু হাত দিয়ে কাকা তাড়াচ্ছে। মায়ের মাথায় ওড়নার ঘোমটা। দিদুন নিজের মাথায় একটা স্টিলের গামলা চাপিয়ে, তারকদাদুর জন্যে একটা ননস্টিক কড়া নিয়ে এসেছে। তারকদাদু সেটা মাথায় চাপিয়ে নীচে থেকে লাফালাফি করছেন। সঙ্গে কাকেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চিৎকার। লম্বা গাছটার গায়ে মই লাগিয়ে কয়েক জন ছেলে গাছে উঠে পড়ল। ঝাঁটা, ঝুলঝাড়ু দিয়ে কাক তাড়াতে তাড়াতে, বাসাটার কাছে পৌঁছতেই কাকেদের ঠোঁটের রাম ঠোক্কর। অত সোজা! বাবা-কাক, মা-কাক তো আছেই। সঙ্গে কাকু, কাক, সোনাপিসি-কাক, পিশেমশায়-কাক, মামাদাদু-কাক— সব্বাই এসে পড়েছে। ভণ্ডুলরা খেলার সময় যে ভাবে ঝগড়া করে সে রকম নয়। পল্টু খেলায় হেরে গিয়ে কাঁদলে যে ভাবে তার বাড়ির লোকেরা এসে পল্টুর বন্ধুদের বেদম বকাবকির পর তাকে কোলে করে বাড়ি নিয়ে যায় চেঁচাতে চেঁচাতে, অনেকটা সেই রকম। সমস্ত নিমগাছটার মাথা জুড়ে উড়ন্ত রাগী কাকের দল, আর গাছটার মোটা মোটা ডালের ফাঁকে ফাঁকে তারকদাদুর বাহিনী। তাদের মাথায় বাঁশের ঝুড়ি। ডাল ভেঙে ভেঙে পড়ছে। আর দিদুন চিৎকার করছে, ওরে ডিম থাকতে পারে। বাচ্চা কাক থাকলে বাসাটা ভাঙিস না। সাবধান!
ইতিমধ্যে টুক করে কখন লগিটা তাদের হাতে মা ধরিয়ে দিয়েছে। সেই লগিতে লাগানো আঁকশির মুখে উঠে আসছে যত হাবিজাবি তার, স্টিলের চামচ, রাংতা, দড়ি— এই সব। হঠাৎ লগির আঁকশিতে উঠে এল ভারী মতো কিছু। দূর থেকে প্রথমে বোঝা গেল না। কিন্তু গাছে চড়া লোকেরা ‘পেয়ে গেছি’, ‘পেয়ে গেছি’ বলে শোরগোল তুলল। তারকদাদু গাছের নীচে দাঁড়িয়ে হাত বাড়ালেন। মা তাড়াতাড়ি ওড়নাটা গা থেকে খুলে গামছার মতো করে দু’হাতে বিছিয়ে ধরতেই ঝপ করে একটা চশমা পড়ল। তারকদাদু হাতে নেওয়ার আগেই ভণ্ডুল সেটা দেখেই বলল, এটাই তো সোনাকাকুর নতুন সোনার চশমাটা। তারকদাদু হতাশ হয়ে বললেন, কেউ নামবি না, ভাল করে খোঁজ। ব্যাটারা এই বাসাতেই লুকিয়েছে। কাকের ঠোকরানো খেয়েও তারা আবার লগি হাঁকাল। একটা প্লাস্টিকের ফুলের ঝাড়ের সঙ্গে ঝুলতে ঝুলতে নেমে এল তারকদাদুর ঝকঝকে চশমা। এটাও বোধ হয় সোনারই হবে। বাসাটা না ভেঙে দুমদাম করে নেমে এল সবাই। তারকদাদু বাহিনীসমেত বাড়ির দিকে ছুটলেন, চশমাটা নাকে লাগিয়ে। সোনাকাকু চশমটা নাকে না গলিয়ে এখনও ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়েই আছে, বিশ্বাসই হচ্ছে না
যে এ রকম একটা ঘটনা ঘটতে পারে! মা সোনাকাকুর হাত থেকে চশমাটা নিয়ে, তাকে পরিয়ে দিয়ে বলল, নাও এ বার চার চোখ খুলে ড্যাব ড্যাব করে দেখো। দাদুভাই হাসতে হাসতে বললেন সবটাই কাকতালীয় কী বুঝলে, তারক?
সন্ধেবেলা সকলকে টিভির সামনে জড়ো করে বাবা বললেন, কেউ নড়াচড়া কোরো না। একটা নতুন ডিভিডি দেখাব। ভণ্ডুল, সোনাকাকু আর দিদুন মাঝখানটায়। মা আর দাদুভাই দু’পাশের দুটো সিঙ্গল সোফায়, বাবা দাঁড়িয়ে। টিভির স্ক্রিন জুড়ে ভেসে উঠল ‘কাকতালীয়’— চিত্রনাট্য, সংলাপ, সঙ্গীত ও পরিচালনা তারক জ্যেঠামশায় ওরফে তারক গাঙ্গুলি (উকিল-জগদ্দলপুর)। দৃশ্যগ্রহণে, বাবার নাম— শুভময় চাকলাদার। ভণ্ডুল অবাক হয়ে দেখল সিনেমার মতো স্ক্রিনে ফুটে উঠছে সকালে ঘটা কাকের বাসায় চশমা খোঁজার নাটকটা। দিদুন আর তারকদাদুকে গামলা ও ননস্টিক প্যান মাথায় চড়িয়ে সবচেয়ে সুন্দর লাগছে। তারকদাদুর প্রত্যেকটা লাফে ভণ্ডুল দেখতে পেল তার ডান্স ক্লাসের ক্রিয়েটিভ স্যরের স্টেপগুলো। সোনাকাকুকে মনে হচ্ছে, আর্ট ফিল্মের নায়ক। আর মা’কে দেখে অবাক হয়ে গেল। লগি দেবার নাম করে, ওই অচেনা লোকগুলোর সঙ্গে কখন গাছে চড়ে হাত নাড়াচ্ছে চিৎকার করতে করতে। মোড়ায় বসা টুপি পরা দাদুভাইকে মনে হচ্ছে ডিসকভারি চ্যানেলের অ্যাঙ্কর। আর কাকগুলোকে দেখে ভণ্ডুল মুগ্ধ। বন্ধুদের নিয়ে এ রকম ভাবে দল পাকাতে পারলে, পল্টুর বাড়ির লোকেরা তাদেরও ভয় পাবে। দারুণ মজার ডিভিডি দেখা শেষ হলে সকলের হাতে হাতে পায়েসের বাটি ধরিয়ে দিদুন চটিতে পা গলিয়ে আর একটা বড় বাটিতে পায়েস নিয়ে বলল, যাই তারকবাবুকে একটু মিষ্টি মুখ করিয়ে আসি। তাঁর চশমা হারানো এবং তেড়ে এসে কাকের বাসায় লগি না লাগালে সোনার চশমাটা তো কোনও দিনই খুঁজে পাওয়া যেত না, আর সব দোষই চাপত আমার ভণ্ডুল সোনাটার ঘাড়ে।