পা ন্তা ভা তে…

জীবনানন্দ শুনিয়েছিলেন তনুদা’ই

ধুতি-পাঞ্জাবি পরা অনেক বাঙালি ভদ্রলোকের সান্নিধ্য আমি পেয়েছি। কিন্তু এই ভদ্রলোকটি যে আমার জীবনে বেশ একটু অন্য রকম হয়ে উঠবেন, তখন ভাবিনি। মালকোঁচা-মারা, মাড়-দেওয়া ধুতি পরার কায়দাটিও ওঁর থেকেই শেখা। এমনকী জীবনানন্দ দাশের কবিতা প্রথম ওঁর কাছ থেকেই শোনা। বাঙালি জীবনের বিশেষ অঙ্গ, আমারও। আমার তনুদা, মানে তরুণ মজুমদার।

Advertisement

গুলজার

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০৩
Share:

ধুতি-পাঞ্জাবি পরা অনেক বাঙালি ভদ্রলোকের সান্নিধ্য আমি পেয়েছি। কিন্তু এই ভদ্রলোকটি যে আমার জীবনে বেশ একটু অন্য রকম হয়ে উঠবেন, তখন ভাবিনি। মালকোঁচা-মারা, মাড়-দেওয়া ধুতি পরার কায়দাটিও ওঁর থেকেই শেখা। এমনকী জীবনানন্দ দাশের কবিতা প্রথম ওঁর কাছ থেকেই শোনা। বাঙালি জীবনের বিশেষ অঙ্গ, আমারও। আমার তনুদা, মানে তরুণ মজুমদার।
তনুদা’র সঙ্গে প্রথম আলাপ হেমন্তদা’র মাধ্যমে। বাংলায় তখন তিনি ‘পলাতক’ সিনেমাটা করে ফেলেছেন। এবং হইহই হিট। তাই ভাবছেন হিন্দিতে আরও একটা পলাতক বানানো যায় কি না। হেমন্তদা আমায় ডেকে আলাপ করিয়ে দিলেন। আর তার পর থেকে কলকাতায় বহু বার তনুদা’র নিউ থিয়েটার্স-এর অফিসে গিয়েছি আমি। সেখানে মানিকদা’র সঙ্গে, সুচিত্রাদি’র সঙ্গেও দেখা হয়েছে বহু বার। তখন নিউ থিয়েটার্স সারা ভারতের সিনেমা জগতের একটা হ্যাপেনিং প্লেস ছিল।
‘রাহগীর’-এর স্ক্রিপ্ট লেখা, গান লেখার কাজ শুরু হল। সন্ধ্যাদি’র সঙ্গে আলাপ হল। ভারী প্রাণবন্ত মানুষ। খোলাখুলি নিজের মনের কথা বলে দেন। যেমন ‘পলাতক’-এর হিন্দি ভার্সান ‘রাহগীর’-এর স্ক্রিপ্ট আর গান লেখার সময় তনুদা চেয়েছিলেন যেমনটা বাংলায় আছে, ঠিক তেমনটাই যেন হিন্দিতে হয়। কিন্তু প্রত্যেক ভাষার যেহেতু নিজের একটা শৈলী রয়েছে, তাই একই রকম রাখতে গেলে ছন্দটা একটু মার খায়। সন্ধ্যাদি এক দিন বললেন, ‘তুমি যে ওকে বাংলার থেকে ডিটো হিন্দি করতে বলছ, তাতে তো হিন্দি ভাষার ছন্দটা কেটে যাবে।’ কিন্তু তনুদা ঠিক ওই রকমটাই চান। কেন চান? সেটা আমি বুঝেছিলাম। বাংলার যে রস, যে ফ্লেভার ‘পলাতক’-এ ধরা রয়েছে, সেটা শুধু বাংলারই, সেটাকে হিন্দির ছাঁচে ঢালতে গেলে তার মাধুর্য নষ্ট হয়ে যাবে। আমি খুব চেষ্টাও করেছিলাম। প্রথমে ঠিক ছিল অনুপকুমার হিন্দিতেও করবে। সেই অনুযায়ী আমার সঙ্গে অনুপের রিহার্সালও শুরু হয়েছিল। কী যে স্বতঃস্ফূর্ত এক জন অভিনেতা! আহ্! It was a delight to see him acting. সত্যি, বাংলায় তখন দিকপাল অভিনেতারা রাজত্ব করছিলেন। কিন্তু বম্বে এসে যখন ‘রাহগীর’ সিনেমাটা বানানো শুরু হল, সেটা যেন একটা হিন্দি সিনেমাই হয়ে গেল। বাংলার মাদকতা যেন একটু হারিেয় গেল। এটা অবশ্য আমার মত।

Advertisement

এ গল্প অবশ্য তনুদা’র সঙ্গে কেবল সিনেমা সংক্রান্ত গল্প নয়। আসল রহস্য তো বাকি। তনুদা’র শ্যামলা রং, সন্ধ্যাদি’রও তাই। কিন্তু এই শ্যামলা ফ্যামিলিতে এক দিন আমার পরিচয় হল একটা বড্ড ফরসা বেড়াল-আঁখির মেয়ের সঙ্গে। রাখী।

সন্ধ্যাদিই ওকে মানুষ করেছিলেন। সেই দেখার পর বুক দুরুদুরু শুরু। তবে আলাপ শুরু বম্বেতে হেমন্তদা’র বাড়িতে। আমি যেতাম কাজে। আর আমার গাড়ির চাবি চুরি করে রাখী আর তার দুই বন্ধু বেমালুম বেড়াতে চলে যেত। চুরি মানে, হেমন্তদা’র ড্রাইভারকে দিয়ে বলে পাঠাত— জয়ন্ত, মানে হেমন্তদা’র ছেলে বেরোবে, তাই আমার গাড়িটা সরাতে হবে। আমি সরল বিশ্বাসে চাবি দিয়ে দিতাম। আর ওরা কোনও দিন ফুচকা খেতে, কোনও দিন এমনিই এখান ওখান বেড়াতে চলে যেত। ভাগ্যিস!

Advertisement

তনুদা তখন প্রায়ই বম্বে আসতেন। হেমন্তদাই ওঁর বেশির ভাগ সিনেমার সুর করতেন, সেই সূত্রে। আর তখন বন্ধুত্ব এমন জমে উঠেছে যে আমার জুহুর ছোট ফ্ল্যাটেও তনুদা’র আনাগোনা ছিল। আমি তখন বাঙালি মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু। সুতরাং বাংলায় প্রেমপত্র লেখাও শিখে ফেলেছি। বিমলদার জমানার আগে থেকেই বাংলায় বেশ দখল আমার, কিন্তু বাংলা লেখা শেখা প্রেমে পড়ে।

তনুদা আমার বাড়ি এসে ‘সঞ্চয়িতা’ নামিয়ে একটার পর একটা কবিতা পড়তেন। ওঁর ভারী উদাত্ত কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। অত ভাল রবীন্দ্রসংগীত আমি খুব কম শুনেছি। এক দিন হয়েছে কী, তনুদা গাইতে গাইতে ভুলে গিয়েছেন একটা লাইন। আমি চা করছিলাম। এসে বললাম, ‘আমায় বলুন না কোন গান?’ বললেন, ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন...’ গানটার সঞ্চারীটা ভুলে যাচ্ছি।’ আমি গীতবিতান নামিয়ে সূচিপত্র দেখে গানটা বের করে দিলাম। তনুদা তো অবাক। বাংলায় আমার এতটা মুনশিয়ানা বোধ হয় আশা করেননি। প্রেমের কী মহিমা! আমায় বাংলা লেখাতেও এক্সপার্ট করে দিল।

আমার বিয়েতে যদিও তনুদা আর সন্ধ্যাদি আসতে পারেননি, কিন্তু আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, কন্যাদান ওঁরাই করেছেন। আসল কন্যাদান অবশ্য করেছিলেন শচীন দেববর্মন। কিন্তু সেই যে ‘কনে দেখা আলো’য় আমি রাখীকে তনুদার বাড়িতে দেখেছিলাম,সেটাই আমার কাছে কন্যাদানের ক্ষণ। না-ই বা হল রিচুয়াল মেনে কন্যাদান। যে কন্যাকে ওঁরা যত্ন করে মানুষ করেছেন, বড় করেছেন, তার যে সময়ই বিয়ে হোক না কেন, আর যখনই বিয়ে হোক না কেন, কন্যাদানের আসল অধিকার তনুদা-সন্ধ্যাদির কাছেই গচ্ছিত রয়েছে।

দেখা হলে এখনও আমি তনুদা, সন্ধ্যাদি’র পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করি। আমার আত্মীয় কিনা! আত্মার টান তো আছেই, সঙ্গে শ্বশুরবাড়ির টানও।

তনুদার মতো শিক্ষিত, ভদ্র মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। আর ওঁর রবীন্দ্রনাথের প্রতি ভালবাসা, গভীর আস্থাও যেন আমাদের দুজনের মাঝে একটা যোগসূত্র হয়ে গিয়েছে। তনুদা’র সঙ্গ আমায় খুব এনরিচ করেছে। তনুদা’র আলো আমার জীবনটাকে অনেক ঝলমলে করে তুলেছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement