ডাইমেনশন রহস্য

আজকের আবহাওয়াটা খুব মনোরম। স্নিগ্ধ হাওয়া বইছে চার পাশে। বেশ কিছুক্ষণ হল সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়েছে। অন্ধকার নামছে। একটু পরেই মাথার উপর নক্ষত্রখচিত আকাশ শামিয়ানার মতো মেলে ধরবে নিজেকে। আজ মনটাও বেশ ফুরফুরে আছে মৈনাকবাবুর। অনেক কসরতের পর দু’দুটো বিশাল সাইজের কাতলা পাকড়াও করেছেন।

Advertisement

জয় সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৬ ০০:০৩
Share:

আজকের আবহাওয়াটা খুব মনোরম। স্নিগ্ধ হাওয়া বইছে চার পাশে। বেশ কিছুক্ষণ হল সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়েছে। অন্ধকার নামছে। একটু পরেই মাথার উপর নক্ষত্রখচিত আকাশ শামিয়ানার মতো মেলে ধরবে নিজেকে। আজ মনটাও বেশ ফুরফুরে আছে মৈনাকবাবুর। অনেক কসরতের পর দু’দুটো বিশাল সাইজের কাতলা পাকড়াও করেছেন।

Advertisement

ঝিলপাড়ের এই জায়গাটা বেশ আরামদায়ক। বিশেষ করে জুন মাসের প্রচণ্ড গরমে সন্ধেবেলা কিছুক্ষণ এখানে বসে থাকলে দেহমন শীতল হয়ে যায়। কিছুটা দূরে দূরে নানা ধরনের গাছ। দিনের বেলায় এই নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে চোখ জুড়িয়ে যায়। রাতের প্রকৃতি অন্য রকম। ফাঁকা মাঠে সে সময় একটা গা-ছমছমে ভাব ছড়িয়ে পড়ে। তখন ঝোপের ফাঁকে ফাঁকে অগণন জোনাকির আলো। নিঝুম ঝিলের জলে উলটো দিকের বিশাল বাড়িগুলোর আলো পড়ে চকচক করে। এই নৈঃশব্দ্যে শুকনো পাতার ওপর দিয়ে সারমেয় চলে যাওয়ার খরখর আওয়াজ, আর মাঝে মাঝে কোনও রাতপোকার একটানা কি-র-র-র কি-র-কি-র-র শব্দ। এই সময় একা বসে থাকতে একটু ভয় ভয় করে। মৈনাকবাবু অবশ্য কোনও দিন সন্ধে অবধি থাকেন না। বিকেল-বিকেল ছিপটিপ সব নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। তবে আজ কাতলা দুটোকে খেলিয়ে পাড়ে তোলার পর তাঁর মনটাও বেশি খুশি-খুশি। আর সেই খুশির আমেজেই চোখ বুজে গুনগুন করে একটা গান ধরেছিলেন। হঠাৎই একটা অদ্ভুত আওয়াজ ভেসে এল তাঁর কানে, সঙ্গে সঙ্গে ধড়মড় করে চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। আর তার পরই আশ্চর্য হয়ে গেলেন একেবারে। এ কোথায় বসে আছেন তিনি! আশপাশে টকটকে রোদ। চোখের উপর সূর্যের আলো সব কিছু ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। কিছুটা দূরেই বিশাল একটা পাহাড়, তা থেকে ঝরনার জল গড়িয়ে পড়ছে। অবাক হয়ে গেলেন মৈনাকবাবু। এ কোন জায়গা? তিনি তো ঝিলপাড়ে বসেছিলেন। সন্ধে হয়ে গিয়েছিল। মাছ ধরা হয়ে যাওয়ার পর একটু প্রকৃতির হাওয়া খাচ্ছিলেন।

অদ্ভুত শব্দটা আবার ভেসে এল, বেশ কিছুটা দূর থেকে। যে দিক থেকে শব্দটা এল, সে দিকে তাকিয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার অবস্থা মৈনাকবাবুর। দূরে একটা বিরাট আকৃতির অদ্ভুত জন্তু দাঁড়িয়ে আছে! আর তার গলা থেকেই বেরোচ্ছে ওই আওয়াজ। জন্তুটার আয়তন প্রায় চারটে হাতির সমান। বিশাল লম্বা গলা, আর লেজটাও বিশাল। এ রকম কোনও জন্তু তো পৃথিবীতে নেই! তবে হ্যাঁ, এক সময় ছিল, কিন্তু সে তো প্রাগৈতিহাসিক যুগে। জুরাসিক যুগের প্রাণীদের মধ্যে আকৃতিতে সবচেয়ে বড় ছিল এরা। বইয়ে পড়েছেন, ছবি দেখেছেন, ‘জুরাসিক পার্ক’ সিনেমাতেও দেখেছেন মৈনাকবাবু। এ তো ডাইনোসর। কিন্তু ডাইনোসর অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছে আজ থেকে প্রায় ছ’কোটি বছর আগে। তখনও মানুষের আবির্ভাব হয়নি পৃথিবীতে। সেই জন্তু এখানে এল কী করে? মৈনাকবাবু ভাবলেন, তিনি কি স্বপ্ন দেখছেন? হাতে চিমটি কাটলেন। নাঃ, দিব্যি জেগে আছেন। তা হলে এ সব কী হচ্ছে তাঁর চার পাশে!

Advertisement

জন্তুটা ডাকতে ডাকতে ধীরে ধীরে পাহাড়টার আড়ালে চলে গেল। মৈনাকবাবু উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে চললেন সামনের দিকে। কিছুটা দূরে বিশাল আকৃতির সব গাছ। সেই সব গাছের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলেন আর একটা জন্তুকে। বিশাল আকৃতির জন্তুটা চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। তাঁকে দেখতে পায়নি। আরে, এটাও তো প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী! এটার নাম স্টেগোসরাস। কুঁজের মতো আকৃতির পিঠে বড় বড় কাঁটার আচ্ছাদন। মৈনাকবাবু জানেন, এটা নিরীহ এবং নিরামিশাষী প্রাণী, তা-ও প্রচণ্ড ভয় পেলেন। কী করবেন কিছুই বুঝতে পারলেন না। এ বার দ্রুত পিছন দিকে হাঁটতে আরম্ভ করলেন। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর যেখানে পৌঁছলেন, সেটা একটা রুক্ষ প্রান্তর আর চার পাশে ছোট ছোট পাহাড়। আশপাশে তাকাতে লাগলেন। এ বার যা দেখলেন তাতে ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল তাঁর। মনে হল নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে এখনই। দূরে দাঁড়িয়ে তাঁর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে একটা ডাইনোসর— টিরানোসরাস রেক্স। এরা তো ভয়ঙ্কর হিংস্র এবং মাংশাসী। এ বার বোধ হয় আর রেহাই নেই তাঁর। মুহূর্তের মধ্যে ডাইনোসরাসটা দ্রুত বেগে ছুটে আসতে লাগল তাঁর দিকে। প্রচণ্ড ভয়ে আর কিছু ভাবতে পারলেন না মৈনাকবাবু। অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন।

জ্ঞান ফিরে এলে মৈনাকবাবু দেখলেন, বাড়ির বিছানায় শুয়ে আছেন। চার পাশে বাড়ির লোক জন, পাড়া-প্রতিবেশীরাও অনেকে এসেছেন। সকলেই খুব চিন্তিত। মাছ ধরতে গেলে সন্ধের আগেই তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। সন্ধের পরও বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বাড়ির সকলে খুঁজতে গিয়ে ওই ঝিলপাড় থেকে তাঁকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে। মৈনাকবাবুর গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা। হাতটাও ফুলে গিয়েছে, যন্ত্রণা হচ্ছে। ছড়ে গিয়েছে দু’হাতের কনুই দুটো। টিরানোসরাস রেক্সকে দেখে ভয় পেয়ে, দাঁড়ানো অবস্থায় মাটিতে পড়ে যাওয়ার ফলে এই অবস্থা। কিন্তু কী হয়েছিল তাঁর? সব ঘটনা খুলে বলতে তাঁর এই অবস্থার মধ্যেও সকলে হাসাহাসি শুরু করে দিল। কেউ বলল মৈনাকবাবু স্বপ্ন দেখছিলেন, কেউ বলল, তাঁর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে, কেউ বলল বানিয়ে বানিয়ে এ সব বলছেন তিনি— আসলে কারও সঙ্গে মারপিট করেছেন, মার খেয়ে ওই অবস্থা হয়েছে। কিন্তু তিনি জানেন, তাঁর মাথাও খারাপ হয়নি, স্বপ্নও দেখছিলেন না আর মারপিটের তো কোনও প্রশ্নই নেই। শুধু পাশের বাড়ির সোমনাথবাবু বিশ্বাস করলেন তাঁর কথা। সোমনাথবাবু কলকাতার একটা নামী কলেজের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। তিনি বুঝিয়ে দিলেন ব্যাপারটা। বললেন, ‘দেখুন মৈনাকবাবু, আমরা যা কিছু দেখি, তা সবই তিন মাত্রার। তিন মাত্রা মানে, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর বেধ। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বলে গিয়েছিলেন এই তিন মাত্রা ছাড়াও আর একটা মাত্রা আছে, সেটা হল কাল বা সময়। অর্থাৎ, অতীত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান। আর এখন তো বিজ্ঞানীরা বলছেন চতুর্থ মাত্রা ছাড়া আরও অনেক মাত্রা আছে। যেমন, পঞ্চম, ষষ্ঠ ইত্যাদি। কিন্তু সেই সব মাত্রায় আমরা পৌঁছতে পারি না। তবে কাল পরিবর্তন করতে পারলে অতীত বা ভবিষ্যতে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা কাল পরিবর্তন করার কোনও উপায় আবিষ্কার করতে পারেননি। যা-ই হোক, কোনও কারণে হয়তো কিছুক্ষণের জন্য আপনি অন্য ডাইমেনশনে চলে গিয়েছিলেন, আর সেটা ছিল অতীত কাল। আপনি চলে গিয়েছিলেন অতীতের প্রাগৈতিহাসিক যুগে, যখন ডাইনোসররা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পৃথিবীতে। আবার কিছুক্ষণ পরেই মাত্রা পরিবর্তিত হয়ে যায় আর আপনি চলে আসেন বর্তমান কালে। সেটা না হলে একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে যেত। কোনও একটা কারণে হয়তো বর্তমান এবং অতীত, এই দুই ডাইমেনশনের মধ্যে একটা যোগসূত্র তৈরি হয়েছিল, সেতুবন্ধন হয়েছিল একটা। তবে ঠিক কী ভাবে এটা হয়েছিল, সেটার ব্যাখ্যা আমি দিতে পারব না। এ ছাড়া এই রহস্যময় ঘটনার আর কোনও সমাধান আমার মাথায় আসছে না।’

মৈনাকবাবু ভয় পেলেন। ভাবলেন, এ রকম ঘটনা যদি আবার ঘটে? আবার যদি কখনও তিনি চলে যান অতীত কালে আর পড়ে যান ওই ভয়ানক টিরানোসরাস রেক্সের সামনে? ঠিক সেই সময় যদি এ বারের মতো অতীত কাল পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান কাল ফিরে না আসে, কী হবে তখন? গুম হয়ে বসে রইলেন তিনি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement