ছবি: সুমন চৌধুরী
শ্যাম্পেন-এর বোতল ঝাঁকিয়ে খুললে যেমন ভাবে ছড়িয়ে পড়ে মাদকতা আর এনার্জি, একসঙ্গে, সলিলদা ঠিক সে রকম একটা মানুষ ছিলেন। হইহই প্রাণশক্তি, আর তেমন সম্মোহনী ক্ষমতা। আলো যেমন সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে, তেমনই ছড়িয়ে পড়তেন সলিলদা আমাদের প্রতিটি রক্তের ফোঁটায়, জীবনপাত্রে। আমার সঙ্গে সলিলদার আলাপ ফিল্মে আসার আগে। আইপিটিএ আর বম্বে ইয়ুথ কয়্যার-এর সূত্রে। তখন সলিলদা একাধারে কমিউনিস্ট কর্মী, গান-বাঁধিয়ে আর চোস্ত অর্গানাইজার। সলিলদার গান যেমন পপুলার হচ্ছে, তেমন নিষিদ্ধ হচ্ছে, সলিলদা কখনও জেলে তো কখনও আন্ডারগ্রাউন্ডে। যখন সে সব কোথাও নেই, তখন দেখতাম, কী অসামান্য সংগঠক তিনি! দেখেশুনে আমার ঘোর লেগে যেত।
রুমা (গুহঠাকুরতা) শুরু করেছিল বম্বে ইয়ুথ কয়্যার, ও ভীষণ এফিশিয়েন্টও ছিল। সঙ্গে থাকতেন সলিলদা। গান তোলাতেন, রিহার্সাল দেওয়াতেন, দলের সঙ্গে ট্যুরে যেতেন। সে সব দিনে জীবনে একই সঙ্গে খিদে আর মুক্তো টুপটাপ ঝরে পড়ত, একই সঙ্গে আন্দোলন আর সুহানা সফর হত, একই সঙ্গে গুলজার আর সলিল চৌধুরী হেঁটে যেত বম্বের কোনও বস্তির পাশ দিয়ে।
এমন একটা অবিশ্বাস্য কৃতী মানুষকে যখন এক বিঘত দূর থেকে চিনলাম, দেখলাম, আরে, লোকটা মহা ফাঁকিবাজ। সারা দিন ক্যারম খেলতে ব্যস্ত, পিংপং-টেবিল টেনিস খেলতে মহা উৎসাহী, কেবল নিজের কাজ ছাড়া সব করছে! অথচ পিয়ানো-হারমোনিয়ামে হাত দিলে টইটম্বুর অমৃতের ঘড়া উল্টে গেল বলে। হায় হায়! এ রকম এক জন জিনিয়াস, এ ভাবে জীবন কাটাতে পারে? জিনিয়াস বলেই হয়তো পারে। এই আলস্য, এই বল্গাহীন প্রতিভা, জলের মতো বয়ে চলা আশ্চর্য চিন্তা, সাংঘাতিক অস্থিরতা, তুমুল প্রাণশক্তি, হইচই জীবন এ মিক্সচারে জিনিয়াসই তো ফলবে!
সলিলদা মোহন স্টুডিয়োতে সারা দিন নিবিষ্ট মনে ক্যারম খেলতেন। দেখে মনে হত, জীবনে এত বড় জরুরি একটা কাজ থাকতে লোকে কেন যে ‘সুর দাও, সুর দাও’ বলে মাথা খারাপ করে কে জানে! সলিলদা এক বার ক্যারম খেলছেন। এক জন এসে বলল, সলিলদা, একটা ক্রাইস্লার গাড়ি বিক্রি আছে। ‘নেহি চাহিয়ে।’ ‘অচ্ছা হ্যায়, সলিলদা, আপ এক বার দেখ তো লো।’ ‘নেহি চাহিয়ে ইয়ার, খেলনে দে মুঝে।’ ‘সলিলদা, ইনস্টলমেন্ট পে হ্যায়।’ ‘আচ্ছা তো রখ্ দে।’ সলিলদা এ রকমই।
ওঁর সম্পর্কে একটা গল্প চালু ছিল যদি ক্যারম খেলার সময় সলিলদাকে কেউ বলে, ‘সলিলদা এক হাথি হ্যায়।’ ‘নেহি চাহিয়ে।’ ফের যদি দু-এক বার ঘ্যানঘ্যান করে কানের কাছে, তো সলিলদা বলবেন, ‘আচ্ছা, বাঁধ দে বাহর।’ অতএব সলিলদার সব সময়ই টাকার দরকার পড়ত। যদিও টাকা তিনি কম কিছু রোজগার করেননি, কিন্তু খরচও করতেন দেদার।
কাজ করানো সলিলদাকে দিয়ে যে কী কঠিন ছিল! সব হবে, কিন্তু কাজটা আর হবে না। ‘ও সলিলদা, ওই গানের সুরটা...?’ ‘হবে হবে, আরে নতুন গাড়ি কিনেছি, চলো পওয়াই যাই, ট্রায়াল রানও হবে আর ঘোরাও হবে।’ সুর পড়ে থাকল ডিকিতে, আমরা চললুম বেড়াতে। ‘কাবুলিওয়ালা’র শুটিং চলছে তখন। আমি, বলরাজ সাহনি আর বিমলদার অ্যাসিস্ট্যান্ট গিয়ে কলকাতার অলিগলি থেকে টাইটেল শট তুলে নিয়ে বম্বে ফিরেছি। বিমলদা বললেন, দুটো গান রেকর্ডিং হয়েছে, একটু শুনে এসো তো গোলজার। শুনলাম। বললাম, ‘বিমলদা, ভজনটা আমার ঠিক পছন্দ হয়নি।’ বিমলদা বললেন, তা হলে সলিলের সঙ্গে বসে গানটার নতুন সুর ঠিক করো। নতুন করে লেখো। কিন্তু প্রেম ধবন লিখেছে অন্য গানগুলো, আমি কী করে হঠাৎ একটা গান লিখব? কাঁচুমাচু মুখে সলিলদাকে সমস্যাটা বললাম। সলিলদা বললেন, আরে প্রেম নিজেই বলেছে গোলমাল হলে তোমায় দিয়ে লেখাতে। ও যাবে আইপিটিএ-র ট্যুরে। যদি বিমলদা ওকে আটকে দেন, সেই জন্যই বলে গিয়েছে, গুলজার লিখে দেবে। ঠিক হ্যায়। আমি লিখলাম। কিন্তু গানের সুর কই। কয়েক বার বিমলদা আমায় জিজ্ঞেস করলেন। বললাম, সলিলদার সময় হচ্ছে না, মানে, ইয়ে...
এই সময় রাজেন তরফদারের ‘গঙ্গা’ রিলিজ করল। ‘আমায় ডুবাইলি রে’ গানটায় আমি ভেসে গেলাম। দিন কয়েক পরে এক দিন মোহন স্টুডিয়োতে গেছি সলিলদার কাছে। সলিলদার একটা মিউজিক রুম ছিল সেখানে। উনি তখন নীচের তলায় মন দিয়ে টেবিল টেনিস খেলছেন। বললাম, ‘সলিলদা, ‘আমায় ডুবাইলি রে’ গানটার সুর কাবুলিওয়ালার এই গানটায় বসালে হয় না?’ সলিলদা একটু বিরক্ত, কেন আমি ওঁর খেলার সময় কাজের কথা বলে ব্যাঘাত ঘটালাম। গলায় একটা তাচ্ছিল্য নিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক আছে। ওপরে গিয়ে কানুর সঙ্গে বসে নোটগুলো নিয়ে নাও।’ আমি গেলাম সলিলদার অ্যাসিস্ট্যান্ট কানু ঘোষের সঙ্গে কাজ করতে। কিছু ক্ষণ পরেই স্টুডিয়ো চত্বরে একটা স্টেশন-ওয়াগন গাড়ির হর্ন। মানে বিমলদা এসে গেছেন।
ওই হর্ন শুনে সলিলদা ঠিক এক জন স্কুল-ছাত্রের মতো দৌড়ে এসে ওঁর পিয়ানোর সামনে বসে পড়লেন। তার পর এমন মগ্ন হয়ে বাজাতে থাকলেন, মনে হল যুগযুগান্ত এইখানেই সাধনা চলেছে। বিমলদা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন, সলিলদা সে কথা বিলক্ষণ বুঝেছেন। কিন্তু তখন তিনি সাধনায় মগ্ন যোগীপুরুষ তো, তাই দেখতে পাননি। হঠাৎ যেন বিমলদাকে আবিষ্কার করলেন দরজার কাছে। বলে উঠলেন, ‘আরে বিমলদা, আমি ভাবছিলাম, ‘আমায় ডুবাইলি রে’-র সুরটা কাবুলিওয়ালার গানটায় বসালে কেমন হয়।’ ফের চোখ বন্ধ করে সলিলদা দু-চার বার টুংটাং, বিমলদা দাঁড়িয়ে। আধো চোখ খুলে সলিলদা ফের বললেন, ‘আমি ভাবছিলাম আর কী।’
বিমলদা বললেন, ‘ডোবাতে গেলে আর ভাবতে হয় না সলিল, কাজটা করো।’ গটগট করে বিমলদার প্রস্থান। গাড়ি গেট থেকে বেরলো কি বেরলো না, সলিলদা পিয়ানো থেকে লাফিয়ে উঠে কড়া মাস্টারের মতো আমায় বললেন, ‘অ্যাই গুলজার, তুমি কানুর সঙ্গে বসে পুরো কাজটা করে যাবে।’ যেন আমিই এত ক্ষণ ওঁকে কাজ করতে বারণ করছিলাম, ফাঁকিটা আমিই দিয়েছি। কথা শেষ করেই এক দৌড়ে নীচে এবং টেবিল টেনিস তখুনি শুরু। আমি আর কী বলব, শুধুই দর্শক!
ইনি সলিল চৌধুরী। মানুষ আর সুর দুটোই যেন অনেক উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়া পাহাড়ি ঝরনা, একটা কখনও-না-শেষ-হওয়া সেলিব্রেশন!