রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ১

প্র মিস হয়ে গেল

নেতারা প্রমিস রাখেন না, এ নতুন কথা নয়। কিন্তু ‘মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে এ দেশে থাকব না’ প্রমিস করলেন যাঁরা, তাঁরাও কথা রাখেননি। শিশির রায়।টুইটারে গুজগুজ ফুসফুস হতে হতে হঠাত্‌-বোমা: বলিউডের বাদশা নাকি দেশ ছাড়ছেন? ক্কে?? ইয়েস, এসআরকে! কিং খান! @iamsrk হ্যান্ডলে জ্বলজ্বল করছে টুইট: ‘ইট্জ মাই চ্যালেঞ্জ টু এনটায়ার ওয়ার্ল্ড দ্যাট ইফ নরেন্দ্রমোদী জি উইল বিকাম নেক্সট পিএম দেন আই শ্যাল নট লিভ ওনলি টুইটার বাট ইন্ডিয়া অলসো ফরএভার।’

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৪ ০০:০০
Share:

টুইটারে গুজগুজ ফুসফুস হতে হতে হঠাত্‌-বোমা: বলিউডের বাদশা নাকি দেশ ছাড়ছেন? ক্কে?? ইয়েস, এসআরকে! কিং খান! @iamsrk হ্যান্ডলে জ্বলজ্বল করছে টুইট: ‘ইট্জ মাই চ্যালেঞ্জ টু এনটায়ার ওয়ার্ল্ড দ্যাট ইফ নরেন্দ্রমোদী জি উইল বিকাম নেক্সট পিএম দেন আই শ্যাল নট লিভ ওনলি টুইটার বাট ইন্ডিয়া অলসো ফরএভার।’ ১১১০ বার রিটুইট হয়েছে, ১০০৯ জন ফেভারিট বলে দাগিয়েছেন এসআরকে’র বিস্ফোরক বার্তাকে!

Advertisement

কথায় কথা বাড়তে সময় লাগে না। আন্তর্জালে তো আরও না। আরে, বাদশা তো কী, মুসলিম না! তা বলে শাহরুখ? আরে, সেলেব্রিটি বলে কী ভয়ডর নেই নাকি? পিএম যেখানে নরেন্দ্র মোদী, শক তো লাগবেই! সব মুসলমানের লাগবে। দুয়ে দুয়ে চার দেখছিস না, এ জন্যেই আইপিএল-এ এ বার অত নাচানাচি করছে না, সব ম্যাচে মাঠেও যাচ্ছে না! এত শত কমেন্টে যখন ফেসবুক দেওয়াল উপচে, ঠিক তক্ষুনি আর একটা টুইট এল খোদ এসআরকে’র: ‘গুড টাইম টু টেল অল ফুল্স হু আর টকিং অব আ টুইট দ্যাট আই ডিড্ন্ট টুইট, ইউ সাক অ্যাজ মাচ অ্যাজ দ্য গ্রামার অব দ্যাট ফেক টুইট, অ্যান্ড আয়্যাম বিয়িং কাইন্ড।’ রাত ১২.৩৩, ১৯ মে ২০১৪। এটা ৪৫৮৬ রিটুইট, ৪০৫৭ ফেভারিট। তার মানে আগেরটা অন্য কোনও ফেকু’র কাণ্ড! @iamsrk নামে ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে ‘ভারত ছাড়ছি’ রটিয়ে দিয়েছে। আর হ্যাঁ, এই ফেকু সত্যিই ব্যাকরণ জানে না। কনটেন্টের জন্য তো বটেই, ও রকম বাজে ইংরেজিতে লেখা ফেক টুইট বুঝদার যে কারও নামে ছড়ালে রাগ হওয়াটা বিলক্ষণ সঙ্গত।

শাহরুখ খানের এই টুইট-কাণ্ড বাজারে নিয়ে এল আর এক আলোচনা। আর কে কে যেন বলেছিল, নমো জিতলে ভারত ছাড়বে? কে যেন বলেছিল, মোদী নাকি দাঙ্গাকারী, থাকব না সেই রাজার রাজত্বে!

Advertisement

কামাল রশিদ খান। সংক্ষেপে, কেআরকে। পেশা: মূলত টেলিভিশনের অ্যাক্টর। ‘দেশদ্রোহী’ বলে একটা ছবি করেছেন, ‘বিগ বস’-এ অংশ নিয়ে খানিকটা কল্কে পেয়েছেন। স্বঘোষিত স্টার সেলেব্রিটি। নেশা: উত্‌পটাং, আলটপকা টুইট-মন্তব্য করা। সমাজবাদী পার্টিতে যোগ দিয়ে ভেবেছিলেন ভোটে দাঁড়াবেন, শেষে দল ছাড়তে হয় ওই ভুলভাল টুইট-স্বভাবের জন্যই। তারও পর আছে। ঠিক করলেন, উত্তর-পশ্চিম মুম্বই কেন্দ্র থেকে নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াবেন। স্বভাবোচিত হম্বিতম্বির পর, ভোটের ঠিক আগে, নাম তুলে নিলেন। কিন্তু টুইট করা থেকে আটকাবে কে? @kamaalrkhan টুইটার-হ্যান্ডল থেকে একের পর এক পটকা। লোকে বলছে, এসআরকে’র নামে বাজারে ছাড়া ভুলভাল টুইটটা আসলে কেআরকে’র কাজ। ভোটের রেজাল্টের দিনই দুপুর ১.৪৮-এ টুইট, ‘সো আই অ্যাম লিভিং ইন্ডিয়া ফরএভার অ্যাজ আই প্রমিস্ড। আই ডোন্ট নো ইফ এসআরকে অ্যান্ড আদার্স উইল কিপ দেয়ার প্রমিস বাট আই উইল কিপ।’ তার সোয়া ঘণ্টা বাদেই ফের: ‘মোদী জি হ্যাজ ওয়ান সো আই অ্যাম লিভিং ইন্ডিয়া ফরএভার উইথ শোয়েব আখতার। বাই বাই ইন্ডিয়া।’ উইথ শোয়েব আখতার?? সে আবার কী? আগেই দুবাই যাওয়ার টিকিটের ছবি পোস্ট করেছিলেন, এ বার দেখা গেল, প্লেনের ভেতর তোলা ছবিতে কামাল সত্যি সত্যি শোয়েব আখতারের পাশে বসে। চেনা-অচেনা সবার বক্তব্য, আরে এটা স্রেফ গিমিক। দুবাইয়ে যাচ্ছিল, একই প্লেনে শোয়েব, খচ করে একটা ছবি তুলে ওটা লিখে ছেড়ে দিয়েছে টুইটারে।

১৭ মে’র কলার-তোলা টুইট, ‘দেবী গৌড়া, এসআরকে, ফারুক আবদুল্লা অলসো সেড দ্যাট দে উইল লিভ ইন্ডিয়া ইফ মোদী উইল বিকাম বাট হু কেপ্ট হিজ প্রমিস? ওনলি মি মি মি কেআরকে।’ নেট-দুনিয়ায় যেই না সবাই ভাবছে লোকটা প্রমিস করে রেখে তো দেখাল, ও মা, অমনি একগুচ্ছ টুইট। ‘গুড নাইট অ্যান্ড কিস টু @narendramodi জি ফর উইনিং উইথ নমো স্টাইল, অ্যান্ড কিক টু কেআরকে ফর ডুয়িং রং প্রেডিকশন।’ ‘আফটার সিক্সটি ইয়ার্স অব ইন্ডিপেনডেন্স ওয়ান ওয়ারিয়র কল্ড মোদী হ্যাভ কাম অ্যান্ড ফিনিশ্ড কংগ্রেস পার্টি ফরএভার। আনডাউটেডলি মোদী ইজ মোস্ট ক্লেভার পলিটিশিয়ান।’ আমি গাই ঘরে ফেরার গান?

‘নমো’কে প্রধানমন্ত্রী করার ব্রত নিয়ে লোকসভা ভোটের আগে তৈরি হয়েছিল ‘নমো ব্রিগেড’। ১৭ মে, ভোটের রেজাল্টের পর দিন, এই ব্রিগেডের রাজ্য আহ্বায়ক নরেশ শেনয় সংবাদমাধ্যমকে জানালেন, তাঁরা তাঁদের প্রমিসমাফিক এগজিট পোল-এর পর দিনই একটা প্লেন-টিকিট বুক করেছিলেন, আজ সেটা ডাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন লেখক ইউ আর অনন্তমূর্তির বেঙ্গালুরুর ঠিকানায়। শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইন্সের ওয়ান-ওয়ে টিকিট, ব্যাঙ্গালোর-করাচি, ভায়া কলম্বো। কী প্রমিস? জ্ঞানপীঠ পুরস্কারজয়ী ভারতবিখ্যাত লেখক ইউ আর অনন্তমূর্তি বরাবরের মোদী-বিরোধী। ভোটের অনেক আগেই বলেছিলেন, মোদী কখনওই ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। আর যদি পারেন, তিনি চির দিনের জন্য দেশ ছেড়ে চলে যাবেন। নরেশের সোজাসাপটা কথা, আমরাও প্রমিস করেছিলাম, মোদীজি প্রধানমন্ত্রী হলে আমরাই ওঁর টিকিটটা কেটে দেব। উনি চাইলে গন্তব্যে পৌঁছে অন-অ্যারাইভাল টিকিটের পয়সাটা দিয়ে দিতে পারেন, নইলে আমরাই দিয়ে দেব। টিকিট পাঠিয়ে দিলাম, এ বার অনন্তমূর্তি তাঁর কথা রাখুন। অনন্তমূর্তির বাড়িতে টিকিট পৌঁছেছে কি না জানা নেই, তবে তিনি দেশ ছাড়েননি। অবশ্য তাঁর বিবৃতি নিয়ে গণমাধ্যম আর সোশাল নেটওয়ার্কে জল ক্রমশ ঘোলা। লেখক বলেছেন, আমার বক্তব্যকে অন্য ভাবে দেখানো হয়েছে। আমি বলেছিলাম, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী হলে মানুষের মনে ভয় গেড়ে বসবে। আমি এমন দেশে থাকতে চাইব না, যেখানকার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ‘থাকতে চাইব না’ যদি পালটে গিয়ে ‘চলে যাব, ছেড়ে যাব’ হয়ে যায়, তা হলে আর কী করা? পরে এ-ও বলেছেন, যা বলেছেন, আবেগে বলেছেন, একটু বেশিই বলেছেন। একাশি বছর বয়সে চিরকালের জন্য দেশ ছেড়ে গিয়ে থাকা কি সম্ভব? নরেশও কি সত্যিই চান উনি মোদীর আমলে দেশ ছেড়ে চলে যান? উত্তরে নরেশ বলেছেন, না চাই না, উনি সম্মাননীয় লেখক, পুরস্কারবিজয়ী। কিন্তু আমরা যে প্রমিস করেছিলাম, ওঁর দেশ ছাড়ার পরিস্থিতি তৈরি হলে রাহা-খরচটা দেব। প্রমিস রাখার জন্য ডাকে টিকিটটা পাঠাতেই হত ভাই!

কেআরকে টুইটে লিখেছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়ার কথা। মোদী প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার আগেই অশীতিপর দেবগৌড়া নাকি জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি চলে যাচ্ছেন, তবে ভারত ছেড়ে নয়, তাঁর নিজের রাজ্য কর্নাটক ছেড়ে, এবং রাজনীতি ছেড়ে। লালুপ্রসাদ যাদবও বলেছিলেন ভারত ছাড়বেন, তিনি এখনও পর্যন্ত আর কিছু বলেননি বা করেননি।

আম-ভারতীয় খবরের কাগজে, টিভির পরদায় আর ভার্চুয়াল দুনিয়ায় রোজ নজর ফেলছে আর গজালি করছে, কোন রাজনীতিক তাঁর প্রমিস রাখলেন, বা রাখলেন না। ইয়াব্বড় দেশটার ভাগ্যবিধাতাদের সম্পর্কে অতি-কমন যে মতামত শেয়ার করেন জনগণ, তা হল: নেতারা কথা দেবেন, এবং রাখবেন না। এটাই চল, এটাই দস্তুর। আমরা গণতন্ত্রের নিশান পতপতিয়ে ভোটের লাইনে দাঁড়াব, ওঁদের জেতাব, পার্লামেন্টে পাঠাব, আর তার পর ভোটের আগে দুশো তেত্রিশটা রোড শো’য়, হাজারটা মিটিংয়ে আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে ওঁরা যে লক্ষ প্রমিস বিলিয়েছেন, তার আউন্সখানেক না রাখলেও বাসে-মেট্রোয়, অফিসে-বাজারে, রোজের ঘেমো-অপমানিত-বিপর্যস্ত যাপনে নিঃশর্ত ক্ষমাশীল আমরা ওদের ক্ষমা করে দেব। কেননা, ওঁদের ক্ষেত্রে তো ‘প্রমিসেস আর মেড ওনলি টু বি আনমেড!’

আর পাশাপাশি অবশ্য নেতানেত্রীদের নিয়ে হাসাহাসিও করব তেড়ে, চুটকিও পরিবেশন করব হাসিমজা-শো’য়, চায়ের দোকানেও হাতের ভঙ্গিতে আশা-আকাঙ্ক্ষার মাছি উড়িয়ে বাজখাঁই গলায় বাতলাব: ওই এসেছেন সাইরেন-বাজানিয়া প্রতিশ্রুতি-দেনেওয়ালা, আর কিস্যু পারেন না, বড় বড় বক্তৃতা ও হ্যান করেঙ্গা ত্যান করেঙ্গা পিতিজ্ঞে। কথা বলতে তো আর ট্যাক্স লাগে না!

কিন্তু বাপু নিজেদের বেলায়? আমরা কি দাপিয়ে কথা দিয়ে, তার পর কথা রাখছি? গণতন্ত্রে এটা যেমন বলা চলে না, ‘ও প্রধানমন্ত্রী হলে আমি খেলব না’, এটা বলাই চলে, ও কাপ্তেন হলে আমি ময়দান ছেড়ে চলে যাব। যখন সেই প্রমিস রাখার দায় ঘাড়ে এসে পড়ছে, তখন, ‘হেঁহেঁহেঁ, ধুর, ইয়ে, তা কি হয়, তবে কিন্তু’ বলে তোতলাচ্ছি কেন? তা হলে তো ও কথাই সত্যি: ইউ গেট দ্য নেতানেত্রীজ ইউ ডিজার্ভ।

আসলে আমাদের নিজেদেরই রোজকার জীবনে করা প্রমিস রাখার কোনও ঠিকঠিকানা নেই! ধোয়া তুলসীপাতা আমাদের লিডাররা নন, আমরা নাগরিকরাও নই! কাল ব্যাংকে যাব বলেই আমরা কিছুতেই ব্যাংকে যাই না, আর আদর্শগত প্রতিজ্ঞা! নিজের জঞ্জাল ফেলার সময় এ দিক ও দিক দেখে প্রতিবেশীর বাড়ির সামনে চালান করে পালিয়ে আসব, আর নেতা ঘোটালা করলেই আঙুল তুলে চেঁচাব, তা কী করে হয়? শুধু নেতা বলে ওঁরাই যাবতীয় প্রমিস-শপথ-কসমের গাধাবোট? আর তুমি শুধু বিশ্ব-সিনিক আঁতেল সমালোচক বা মেগা-খিস্তিয়াল? নিউবর্নের কাছে নিউ টাউনটা বাসযোগ্য করে যাওয়ার প্রমিস শুধু নিউ গরমেন্টের না, আমার-আপনারও যে। ফোঁস শ্বাস ফেলে বলতে হয়, এ পোড়া দেশে ওয়াদা নিভানোর মুরোদ কোনও ফিল্ডেই কারও নেই। ওই যে পুনম পান্ডে শপথ করেছিলেন না, ইন্ডিয়া ওয়ার্ল্ড কাপ জিতলে উদোম-গা দৌড়বেন? ধোনি উইনিং-ছক্কা হাঁকালেন, কিন্তু পুনম ঠিক পিছিয়ে গেলেন। শপথ, তুমি কি পথ হারাইয়াছ?!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement