প্রক্সিরূপেণ

যদি এ বার মা দুর্গা না আসেন, কার পুজো হবে? লিখে পাঠিয়েছিলেন অজস্র পাঠক-পাঠিকা। নির্বাচিত চিঠিগুলি সাজিয়ে দেওয়া হল।দশভুজার জায়গায় এ বছর পূজিত হবে পরিচারিকার মূর্তি। বাড়ি-ফ্ল্যাট-আবাসনের হাজারও গিন্নিকে সামলে যাঁরা সংসার চালান, তাঁরা তো দশভুজা বটেই। মূর্তির পরনে থাকবে ছাপা অথবা সিন্থেটিক শাড়ি। বাহন অবশ্যই ভারতীয় রেল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০১
Share:

কাজের মাসি

Advertisement

দশভুজার জায়গায় এ বছর পূজিত হবে পরিচারিকার মূর্তি। বাড়ি-ফ্ল্যাট-আবাসনের হাজারও গিন্নিকে সামলে যাঁরা সংসার চালান, তাঁরা তো দশভুজা বটেই।

মূর্তির পরনে থাকবে ছাপা অথবা সিন্থেটিক শাড়ি। বাহন অবশ্যই ভারতীয় রেল। দশ আয়ুধের মধ্যে প্রথমেই বাসন মাজার সবুজ সাবান, তার পর একে একে ছোবড়া, ন্যাতা, বালতি, ঝাঁটা, ফুলঝাড়ু, কাপড় কাচার সাবান এবং অবশ্যই মোবাইল। আর দু’হাতে ধরা থাকবে ত্রিশূল। সেখানে লেখা থাকবে সেই ব্রহ্মবাণী: ‘এখন ক’দিন আসবুনি।’ এবং এই বাণী-সহ ত্রিশূলে বিদ্ধ হবেন বাড়ির গিন্নির মূর্তি।

Advertisement

দশভুজার ডান পাশে গণেশের বদলে আর এক আরাধ্য দেবতা— ট্যাক্সিচালক। চির উদ্ধত-উন্নাসিক-উদাসীন ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন শূন্য দৃষ্টিতে। পাশে মিটার ডাউন করে দাঁড়িয়ে আছে হলুদ বাহনটি। করজোড়ে, চোখেমুখে গভীর আকুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পরীক্ষার্থী, অফিসযাত্রী, রোগী। ভ্রুক্ষেপহীন ট্যাক্সিচালকের অস্ত্র— এক হাতে ইউনিয়নের কাগজ, অন্য হাতে পানমশলার প্যাকেট।

মা লক্ষ্মীর জায়গায় আয়ার মূর্তি। তাঁরও বাহন ভারতীয় রেল। এক হাতে ধরে আছেন বাচ্চার ফিডিং বট্ল, অন্য হাতে শয্যাশায়ী বৃদ্ধ-বৃদ্ধার ওষুধ। মুখের কাছে ঝুলছে কমিক্‌স-এর বাব্‌ল। লেখা: ‘সন্ধেবেলা মেগাসিরিয়াল দেখতে দিতে হবে।’

কার্তিকের স্থানে অটোচালক। পাশেই হলুদ-সবুজ তেচাকা বাহন। এই আরাধ্য দেবতা মৃদুভাষী। স্টিলের বালা-পরা দু’হাতে ধরে রেখেছেন ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ প্ল্যাকার্ড। সেখানে জ্বলজ্বল করছে— ‘আট টাকা ভাড়া। পুরোটাই খুচরো দিতে হবে।’

দেবী সরস্বতীর স্থানে রান্নার মাসি। ভারতীয় রেল তাঁরও বাহন। এঁর অস্ত্র হাতা-খুন্তি। পরনে শাড়ির উপরে দেওয়া যেতেই পারে অ্যাপ্রন। সেখানে ফুলতোলা নকশায় লেখা আছে ‘বাড়িতে লোক বেশি এলে বাড়তি পয়সা লাগবে।’

অর্পিতা রায়চৌধুরী ভিআইপি রোড

ইন্টারনেট

ইন্টারনেটও অনন্ত শক্তিধারিণী এবং সর্ববিশ্বে ‘ডব্লিউ ডব্লিউ ডব্লিউ’ রূপে বিরাজমানা। গুগ্‌লে তিনি জ্ঞানরূপেণ সংস্থিতা, ফেসবুকে বন্ধুরূপেণ এবং ইউটিউবে ভিডিয়োরূপেণ। সরস্বতীর বদলে ‘kindle’ ও কার্তিকের বদলে স্মার্টফোন আসবে। লক্ষ্মী ও গণেশরূপে যথাক্রমে ল্যাপটপ ও হার্ডডিস্ক। কি-বোর্ড হবে সেতার, মাউস হবে ইঁদুর, স্কাইপ-এর ক্যামেরা হবে পেঁচা, হেডফোন হবে হাঁস এবং ব্লুটুথ ময়ূর। অসুর হল ট্রোজান-হর্স আর সিংহের জায়গায় পান্ডাসিকিউরিটির পান্ডা। আদম-ইভ থেকে নিউটন হয়ে আইফোন-যুগ পর্যন্ত আপেলের সঙ্গে সৃষ্টির নিয়মের গূঢ় সংযোগ থাকায়, প্যান্ডাল হবে অ্যাপ্‌ল-রূপী!

বাসুদেব চক্রবর্তী পুঁটিয়ারি ব্যানার্জি পাড়া রোড

ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়

মা দুর্গার বদলে প্যান্ডালে প্যান্ডালে এ বার সপরিবারে মা ‘ইন্দ্রাণী’ (পদবি: Mukerjea)। সপরিবারে বলতে বৃহত্তর পরিবারটি নিয়ে, অর্থাৎ একেবারে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর সুদ্ধু! সেই তিনের জায়গা নেবেন সিদ্ধার্থ দাস, সঞ্জীব খন্না, পিটার মুকেরজি। দুই কন্যা শিনা আর নিধি থাকবেন এ যুগের লক্ষ্মী-সরস্বতী হয়ে। দুই পুত্র মিখাইল আর রাহুল হবেন গণেশ আর কার্তিক। মা ইন্দ্রাণীর যত রোষ আছড়ে পড়বে অসুরবেশী ড্রাইভার শ্যাম রাইয়ের ওপর, ওর জন্যই এ ভাবে হাটে হাঁড়ি ভাঙল কিনা! শিববেশী ‘ভোলেনাথ’ পিটারের সঙ্গে নন্দিভৃঙ্গি বেশে মঞ্চে থাকতে পারেন কলকাতার অভিজিৎ সেন, সুজিতমোহন সরকার। প্যান্ডাল সাজানো হবে কুখ্যাত রায়গড় জঙ্গলের আবহে, পাশে থাকবে নির্দিষ্ট মডেলের চারচাকা গাড়িটিও!

ভাস্কর রায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রোড, কলকাতা

ইরম শর্মিলা চানু

দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে মণিপুর রাজ্যের সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন ‘আফস্পা’ বাতিল করার জন্য তিনি অনশন করছেন। তাই এ বারের দুর্গাপুজোর প্যান্ডাল হবে মণিপুরের জনজাতিদের গ্রামের অনুকরণে। প্রতিমার পরনে মণিপুরি হ্যান্ডলুমের সুতির শাড়ি। নাকে নাকছাবির বদলে ঝুলবে খাবারের নল। এখানে অসুরের পোশাক হবে সেনা-উর্দির মতো। সে জামায় লেখা থাকবে ‘আফস্পা’। শর্মিলা মহাত্মা গাঁধীর আদর্শে অনুপ্রাণিত অহিংসার পূজারি। তাই তাঁর অনশনরত শরীরটাই প্রতিবাদের মূল অস্ত্র। এখানে অবশ্যই দেবীর দশ হাতে কোনও অস্ত্র থাকবে না। থাকবে শুধু ফুল, সাদা পায়রা, মণিপুরের ফুল ‘সিরয় লিলি’, বরাভয়। পায়ের কাছে বসে থাকবে মণিপুরিদের কুলপ্রতীক, অর্ধেক ড্রাগন অর্ধেক সাপ ‘পাখাংবা’। বা ড্রাগনমুখী সিংহ ‘কাংলা-সা’। মণ্ডপে ভোগের আয়োজন থাকলেও দেবী যেহেতু উপোস করে থাকবেন, তাই তাঁর ইচ্ছানুযায়ী সেই মহাভোগ এলাকার গরিব মানুষদের বিতরণ করা হবে। দেবীর চার ছেলেমেয়ে হবেন মণিপুরের সাধারণ অত্যাচারিত বঞ্চিত মানুষের প্রতিনিধি। তাই তাঁরাও অনশনরত। বিপ্লবের প্রতীক হিসেবে তাঁদেরও নাকে থাকবে খাবারের নল।

পারমিতা ভদ্র পাইন বেহালা, কলকাতা

মমতা

মা দুর্গার অনুপস্থিতিতে তাঁর পরিবর্ত খুঁজতে বেশি দূরে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। দৃপ্ত তেজোময়ী দেবীমূর্তি মা কালীর পাড়াতেই তো মজুত। দেবীর পরনে সরু পাড়ের সাদা শাড়ি। গয়না বলতে ডান দিকের হাতগুলোয় দুটো করে সরু চুড়ি, বাঁ দিকের হাতগুলোয় বাদামি স্ট্র্যাপের ঘড়ি, কানে দুটো ছোট টপ, ব্যস। চমক দিতে নাকের ওপর ঝুলুক চশমা, পায়ে সাদা হাওয়াই চপ্পল। ডান দিকে প্রধান হাতে অস্ত্র নয়— থাকুক উদ্ধত তর্জনীর মানানসই ভঙ্গি, বাঁ হাতে ট্যাব: ক্যামেরা মোড-এ। বাকি আট হাতে শোভা পাক তুলি, ক্যানভাস, দার্জিলিং চা, জঙ্গলমহলের কেন্দুপাতা, রবীন্দ্রসংগীতের সিডি, ভূষণ-বিভূষণের ট্রফি, লন্ডনের ম্যাপ আর এক খাবলা মাটি। দেবী হন্টনপন্থী, তাই নো বাহন। চালচিত্র সাজুক ১০০% কাজের ফিরিস্তিতে, অসুরের বদলে পদতলে জড়ো করা হোক কার্টুনশিল্পী, প্রতিবাদী, মাওবাদী ও সিপিএমকে। ঘাসফুল দিয়ে সাজানো নীল-সাদা পেল্লায় খোপ-কাটা প্যান্ডালে অধিষ্ঠান করুন এই আধুনিক মহাদেবী। পুজোর প্রধান দায়িত্ব নিক সিন্ডিকেটকর্মী, ছোট ছোট ছেলেমেয়ে, টলিউড, উপাচার্য ও তাজা নেতারা। নিন্দুকেরা যে যা-ই বলুক না, কে না জানে, বড় ‘দিদি’দের আমরা বাঙালিরা চিরকাল মায়ের স্থান দিয়ে থাকি।

রাজদীপ দেব শ্রীরামপুর

দ্রৌপদী

পুজোর মিটিং-এ মানুবউদি বললেন, দুর্গার বদলে দ্রৌপদীর পুজো করতে হবে। পঞ্চসতীর এক সতী বলে কথা! সবাই থ! তবে কি একশো জন কৌরবের অসুরমূর্তি বানাতে হবে? জবাবে বেণুমাসিমা মুখ বেঁকিয়ে, হাত ঝাঁকিয়ে ঝংকার দিয়ে উঠলেন, ‘কেন? পাণ্ডব হতচ্ছাড়াগুলোই তো ওর জীবনের সবচেয়ে বড় অসুর। ছ্যা ছ্যা, এক ঘর লোকের সামনে পরপুরুষে কাপড় ধরে টানাটানি করল, আর পাঁচটা মুশকো স্বামী মাথা নিচু করে বসে রইল? এমন তো খালপাড়ের বস্তিতেও হয় না।’

অকাট্য যুক্তি। দ্যূতসভার আদলে প্যান্ডাল, ব্যাকগ্রাউন্ডে পাশার ছক। যষ্ঠীতে যুধিষ্ঠির, সপ্তমীতে ভীম, অষ্টমীতে অর্জুন, নবমী-দশমী এ বছর এক দিনে পড়ায় নকুল-সহদেবকে একসঙ্গে অসুরের জায়গায় বসানো হবে। দশ হাতের দরকার নেই। দ্রৌপদী তো দ্বিভুজা।

শেষ বিতর্ক, দ্রৌপদী-মূর্তির মাথার ওপর কি শিবের বদলে কৃষ্ণের ছবি বসবে? শিরিন আর ঋদ্ধি কলকলিয়ে উঠল, ‘করণ-এর ফোটো দাও। পুওর সোল, হোল লাইফ দ্রৌপদীকে মিস করেছে, আর গায়ে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরে ঘুরে বেড়িয়েছে!’ এ প্রস্তাবও পাশ।

কৌশিক আইচ মহিম হালদার স্ট্রিট, কলকাতা

ধর্ষিতা মেয়ে

খবরে যেমন দেখি। ধর্ষণের পর অ্যাসিড-ছোড়া পোড়া মুখ, ঝলসানো। মেয়েটি বেঁচে যায়। দুর্গা হোক সেই ঝলসানো মুখের মেয়েটি। দশটা হাতই থাক। তার একটা হাতে থাকবে বই। অসুরের জায়গায় থাকবে ধর্ষক। প্যান্ডালটা হবে টেলিস্কোপে বা পূর্ণিমার রাতে দেখা চাঁদের ছবির মতো। বিনাদোষে কলঙ্ক। চাঁদের মতো গোল প্যান্ডাল। যার অন্তও নেই, অস্তও নেই।

সরস্বতী হোক সেই অজ পাড়াগাঁয়ের গরিব মেয়েটা, কন্যাশ্রী প্রকল্পের টাকায় কেনা বই আর সঙ্গে পাওয়া লেডিজ সাইকেল নিয়ে যে পাঁচ কিলোমিটার দূরের ইস্কুলে পড়তে যায়। লক্ষ্মী হোক সেই মেয়ে, রোদজলবৃষ্টিতে যে ধান রোপণ করে। হাট থেকে দু’কেজি চাল আর সবজি কিনে দুপুরে বাড়ি ফেরে।

গণেশ, ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প থেকে ঋণ নিয়ে যে ছেলেটি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। আর কার্তিক ইন্ডিয়ান আর্মির কমান্ডোর মুখ। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে যে সেনাবাহিনীতে চাকরি করতে এসেছে। যে রুখেছে উগ্রপন্থা। সোনালি ধানের রাস্তাচেরা গ্রামে তার ঘর, যেখানে তার অপেক্ষায় কিছু মুখ। অপেক্ষায় তার নতুন বউ। তখনও সে জানে না, উগ্রপন্থীর গুলিতে তার স্বামীর শরীরী নির্মাণ ভেঙে যাচ্ছে।

মিহির নন্দন শিবপুর মেন রোড, হুগলি

‘মা’ সিরিয়ালের মা

বাঙালি আর কাকে এমন ভক্তিভরে রোজ সন্ধেয় ‘মা’ ‘মা’ করে ডেকেছে? লক্ষ্মী হবে ‘বধূবরণ’-এর লক্ষ্মীমন্ত বউ কনক। পরিবারের সমস্ত বিপদ-আপদ যে নিজের ঘাড়ে তুলে নেয়। সরস্বতী অবশ্যই ‘ইষ্টিকুটুম’-এর বাহা। সাকুল্যে মিনিটখানেক পড়াশোনা করে, অথচ সব পরীক্ষায় টপাটপ ফার্স্ট হয় রেকর্ড নম্বর পেয়ে। গণেশ হবে বিশ্বনাথ, নাদুসনুদুস চেহারা। যিশু সেনগুপ্ত কার্তিকের রোলে দুরন্ত। ময়ূরের ওপর বসে, রিয়েলিটি শো অ্যাংকর করছে। গোটা প্যান্ডালটাই হবে একটা টিভি-র আদলে। সামনে ছোট পরদার আড়াল। ঢুকলেই দেখা যাবে ‘মা’ সেখানে সাঙ্গোপাঙ্গ-সমেত স্রেফ চোখের জলে বধ করছেন ‘কিরণমালা’-র রাক্ষসরানি কটকটির সেনাপতি বিটকেলকে।

সুলগ্না গোস্বামী পূর্বায়ন, সোদপুর

নরেন্দ্র মোদী

ধাপা উজাড় করা জঞ্জালের ঢিপির মাঝে দু’হাতে ঝ্যাঁটা-সহ মোদীজির মূর্তি। পরনে নিজের নাম ছাপানো দশলাখি কোট। ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি তাতে আরও ফিটফাট দেখাচ্ছে। দশ নয়, এ মূর্তির চারখানা হাত। বাকি দুটো হাতে ধরা দু’খানি মোবাইল, সেলফি মোড-এ তাক করা। তিনি একাই একশো। তাই লক্ষ্মী-গণেশের প্রয়োজন নেই! বাহনেরও না। দরকার মতো গুজরাত থেকে অর্ডার দিয়ে দু-একটা আনিয়ে নেবেন। সবই তো ওঁর পোষা! মূর্তির মাথার ওপর বিশাল এক ঝাড়বাতি। আইপ্যাড, ট্যাবলেট, আইফোন-এর মতো নামীদামি গ্যাজেট দিয়ে তৈরি। গোটা প্যান্ডাল জুড়ে সাঁটা নানা চমকদার তথ্য আর পরিসংখ্যান, যেমন— ভারতে বেকার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রতি কোটিতে এক জন, টাকা ডলারের বিনিময় মূল্য এক টাকায় ছেষট্টি ডলার, খাপ পঞ্চায়েতের সদস্যরা এখন সারা ভারতে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ভিন জাতে বিয়ের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে ব্যস্ত, গণেশ গিয়েছেন গরিব গাঁয়ে প্লাস্টিক সার্জারি শেখাতে ইত্যাদি। আর প্যান্ডালটা হবে বিরাট এক বুদ্বুদ। স্বচ্ছ আর ফিনফিনে, কিন্তু ফাঁপা। সঙ্গে থাকবে কড়া নজরদারি। পাছে কেউ তার গায়ে আঙুল ছুঁইয়ে ফেলে!

তিতি দাস টালিগঞ্জ, কলকাতা

মার্ক জুকেরবার্গ

২০০৪ সালে মানুষের সঙ্গে ফেসবুকের পরিচয় ঘটিয়ে মার্ক জুকেরবার্গ সভ্যতায় নতুন বিবর্তন এনে দিয়েছেন। এ বার তাঁরই পুজো। পাশে থাকবেন ফেসবুকের সহ-স্রষ্টা অ্যান্ড্রু ম্যাককোলাম, এদুয়োর্দো স্যাভেরিন, ক্রিস হিউজ, ডাস্টিন মস্কোভিট্জ। যেহেতু বাঙালির পুজো, তাই প্রতিমার পরনে থাকবে সাদা ধুতি ও নীল পাঞ্জাবি। তাতে ফেসবুকের লোগো। প্রত্যেকের বাহন হিসেবে থাকবে একটি করে ডেস্কটপ। অসুরের জায়গায় বসে থাকবে হ্যাকার। তার পরনে কালো ধুতি, কালো পাঞ্জাবি। তাতে বড় করে ‘H’ লেখা।

কেয়া দে রামলাল অগ্রবাল লেন, কলকাতা

মনসা

দেবীর পরনে গাঢ় নীল শাড়ি— গরলের প্রতীক। ঘন কালো কেশরাশি পিঠে ছড়ানো। কিন্তু মা মনসার এক চোখ যে কানা! শিল্পীরা তাঁর চোখে পরিয়ে দেবেন গগল্‌স বা সানগ্লাস। মনসার ডান হাতে থাকবে বরাভয় মুদ্রা, বাঁ হাত থেকে ঝুলবে কেউটে সাপ। মঞ্চের বাঁ দিকে হেমা মালিনীর ভঙ্গিতে নৃত্যরতা বেহুলা। তাঁর পায়ের কাছে শায়িত মৃত লখিন্দর। আর এক দিকে দণ্ডায়মান ‘চ্যাংমু়ড়ি কানি’র থেকে মুখ ফেরানো, অমরীশ পুরীপ্রতিম চাঁদ সদাগর— তাঁর বাঁ হাতে অবহেলার গাঁদাফুল। প্যান্ডালের ভেতরে, দু’ধারের কাপড়ে আঁকা থাকবে মনসামঙ্গলের বেসিক স্টোরিলাইন, তরুণ দর্শকদের সুবিধার্থে। সিলিং থেকে ঝুলবে ঝাড়লণ্ঠন, দেখতে হবে ঠিক সাপের কুণ্ডলীর মতন। প্রবেশদ্বারে একটি প্রকাণ্ড সর্পমূর্তি ফণা উঁচিয়ে ও হিসহিস শব্দে সবাইকে সাদর অভ্যর্থনা জানাবে।

পার্থসারথি ঘোষ দস্তিদার কানপুর

সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়

মূর্তি হবে সেই বিখ্যাত পোজে— লর্ডসের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ভারতের অধিনায়ক জামা ওড়াচ্ছেন। চারপাশে থাকবেন তেন্ডুলকর, লক্ষ্মণ, দ্রাবিড় ও কুম্বলে। অসুর কে হবেন সেই নিয়ে খুব বিতর্ক চলছিল। শেষ অবধি ঠিক হয়েছে, প্রত্যেক দিন ফার্স্ট ইনিংসে স্টিভ ওয়, সেকেন্ড ইনিংসে গ্রেগ চ্যাপেল অসুর হবেন। আলোকসজ্জা তো সোজা, সারা ক্ষণ ফ্লাডলাইট জ্বলবে। মাইকে গান-টান চলবে না, শুধু সেই চেনা কলরব:
দাদা... দাদা...!

অরিত্র বসু মধ্যমগ্রাম

মেরি কম

মা দুর্গার সঙ্গে মেরি কমের কিছু মিলও আছে। দুজনেই পাহাড়বাসী। দুজনেই মাতৃরূপে স্নেহময়ী, শত্রু নিধনে রণং দেহি। অসুর বাবাজিকে নক আউট করতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না। কারণ, রিংয়ের চৌহদ্দির মধ্যে কোনও রেফারি থাকবে না। মেরিকে অবশ্যই শাড়ি পরতে হবে (বাঙালিয়ানায় নো কম্প্রোমাইজ)। তবে দশ হাতে বক্সিং গ্লাভ্স-ই যথেষ্ট। মান্ধাতার আমলে লোন নেওয়া অস্ত্রের প্রয়োজন নেই। ওই দশ হাতের ‘টোটাল’ ঘুসি সামলাতেই অসুর বাছাধনের নুডল্স-মার্কা চুল পার্পেন্ডিকুলার হয়ে যাবে। প্যান্ডাল হবে বক্সিং রিং। রিংয়ের চার কোনায় মেরির বর ওনলার ও তিন ছেলে দাঁড়াবে। দর্শক ও চিয়ার-পার্সনের ভূমিকায়। তবে সিংহ বাবামশাইকে বেশি ক্লোজে আনার দরকার নেই। কারণ তাঁকে নিয়ে মাতামাতি করলে রিংয়ের সামনে ডিসক্লেমার বোর্ড লাগাতে হবে, সে বড় বেমানান দেখাবে।

প্রদীপ কুমার দাস বেলেঘাটা, কলকাতা

ফুচকা

পুজোর সময়, জনপ্রিয়তায় মা দুর্গার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে একমাত্র ফুচকা। তাই বেদির ওপর ফুচকার হাঁড়িকে লাল চান্দেরি শাড়িতে সাজানো হোক। হাঁড়ির তিনটি চোখও ফুচকা দিয়ে তৈরি হবে। অসুরের জায়গায় আসবে বিষঝাল সসের আড়াল থেকে উঁকি মারা পাঁচটি ঠান্ডা মোমো, যারা অলি-গলি-রাজপথে ফুচকার সঙ্গে টক্কর দেওয়ার পরিত্রাহি চেষ্টা করছে। জলের ঘটির গায়ে সিঁদুর লেপে স্বস্তিকা আঁকা। প্যান্ডাল সাজানো ফাউ শুখা-ফুচকা গেঁথে। পূজারি সাজুক ফুচকাওয়ালা। ড্রেসকোড সাদা ধুতি ও আসমানি হাফ শার্ট। চরণামৃত তৈরি তেঁতুলগোলা জলে।

মাধুরী সাহা চুঁচুড়া, হুগলি

সনিয়া গাঁধী

শারদোৎসবের পুণ্যলগ্নে মাতৃরূপিণী সনিয়ার আবির্ভাব। অসুরদলনীর লক্ষ্মীরূপিণী প্রিয়ংকা পূর্ণঝাঁপি-ক্রোড়ে বিদ্যমানা। কার্তিকবেশী রাহুল। দুটি পুত্র-কন্যা কম পড়িয়াছিল, এমতাবস্থায় জ্যাঠাইমার সাদর আহ্বানে পারিবারিক ‘ক্রাইসিস’ দূরীকরণে (কর্মহীনতার ক্লেশও বোধ করি কারণ) বরুণবাবাজি অভিমানাদি বিসর্জনপূর্বক শুঁড়-ভুঁড়ি সামলাইয়া ইমার্জেন্সি সার্ভিসস্বরূপ ফ্যামিলি ফ্রেমে শামিল হইয়াছেন। দ্বিতীয় সমস্যার সমাধানে কাত্যায়নী বাঙালির ভাবাবেগকে তুষ্ট করিয়া অগ্নিকন্যার শ্রীহস্তে কলম-তুলিকা এবং ‘মা-মাটি-মানুষ’ পুস্তকটি ধরাইয়াছেন। ‘মা কমলা, জাগো! শিক্ষাজগতে ঘোর অনাচার হইতে বাঙালিকে রক্ষা করো!’ ভক্তগণের করুণার্তিতে বিচলিতা শ্বেতাম্বরী ঘাসফুলশোভিতা ‘নো পবলেম’ বলিয়া ঠাকরুন হইতে কিঞ্চিৎ দূরত্বে উপবিষ্টা হইলেন। সিংহস্থানে বফর্স কামান। যুদ্ধবাজ অসুররূপ মোদী আক্রমণোন্মুখ... ত্রিশূল পরিহারপূর্বক রণচণ্ডী তাই বজ্র নিক্ষেপে উদ্যত...হানি বাজ নাহি লাজ— স্ট্র্যাটেজি! জগন্মাতা টেনশনপীড়িতা। বঙ্গ রঙ্গমঞ্চে ‘পোচুর’ পলিটিক্স। মণ্ডপটি পর্যন্ত পার্লামেন্টের পরিবর্তে রোজভ্যালি রিসর্ট বানাইয়াছে উজবুকগুলি। কে কাহাকে কখন ফাঁসাইবে, বিশ্বাস নাই। ভাবজর্জর বাঙালি কঠিন ঠাঁই! সেই কারণে মা দুর্গার তিনটি চক্ষু চতুর্দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখিতে চরকির ন্যায় বন্‌বন‌্‌ করিয়া ঘুরিতেছে। দেখিবার মতো বটে। বিস্ময়াবিষ্ট বাঙালির মুখে একটিই প্রশ্ন— ‘সত্যি?’

শুচিস্মিতা দেব সল্টলেক, কলকাতা

উত্তমকুমার

বাঙালির একদা প্রিয় যে পোশাকটি তাঁর জন্যই অনেকখানি আন্তর্জাতিক পরিচিতি পেয়েছে, সেই ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত চেহারাটির আদলে আর ‘নায়ক’ সিনেমায় ভক্তদের সামনে হাত নাড়ানোর ভঙ্গিমাটিতেই প্রতিমা তৈরি হোক। কিন্তু, কুমোরটুলি নয়, টালিগঞ্জের দুঃস্থ টেকনিশিয়ানরা মূর্তিটি গড়ে তুলুক। প্যান্ডালের অর্ধেকটা হোক ‘সাড়ে ৭৪’ ছবির বিখ্যাত মেসবাড়ি অন্নপূর্ণা বোর্ডিংয়ের মতো, আর বাকি অর্ধেকটা ‘সপ্তপদী’র সেই ম্যাডামকে পেছনে বসিয়ে চালানো বাইকটির আদলে। প্যান্ডালের থিম সং হোক ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ গানটি, বাঙালি যাকে সেরা রোম্যান্টিক গানের মর্যাদা দিয়েছে। পুজোর ক্যাচলাইন ‘নায়ক’ সিনেমার সেই অতি-বিখ্যাত ডায়লগ: ‘আই উইল গো টু দ্য টপ, টু দ্য টপ, টু দ্য টপ।’ প্যান্ডালের সামনে এফএম চ্যানেলের কুইজ কনটেস্টের প্রশ্ন হবে: গৌরী দেবী ও সুপ্রিয়া দেবী বাদে তিনি ১৯৮০ সাল পর্যন্ত কত জন মহিলার হৃদয় হরণ করেছেন? সফল উত্তরদাতারা পাবেন ভবানীপুরের কোনও রেস্তরাঁয় বসে মহানায়কের প্রিয় খাবার চিংড়ির মালাইকারি খাওয়ার আজীবন সুযোগ। টিকিট না কাটতে ভালবাসা রেলযাত্রীদের জন্য সুখবর, পুজোর পাঁচ দিন মেট্রো রেলের ‘মহানায়ক উত্তমকুমার’ স্টেশনটিতে টিকিট চেকিং সিস্টেমই বন্ধ থাকবে।

অরূপরতন আইচ কোন্নগর, হুগলি

ঐশ্বর্য রাই

ঐশ্বর্যর যা রূপ, মর্তকুলে দেবী বললেই হয়। আর মহিষাসুর হবেন ছোটা বচ্চন। অভিষেক। এমনিতেই তো তিনি ‘রাবণ’-এর রোল করেছিলেন। তা ছাড়া কোন বউই না চায় স্বামীকে আল্টিমেট ত্রিশূল-খোঁচা দিতে? প্যান্ডাল হবে অমিতাভের মাথার ওপর। কারণ, এই বুড়ো বয়সে এখনও অমিতাভ ফ্যামিলিটাকে ক্যারি করে চলেছেন।

রামকৃষ্ণ হালদার বারুইপুর

বড় দিদিমণি

প্রতিমার চোখে লাল ফ্রেমের গিক গ্লাসেস, মুখে দুষ্টু ছাত্রছাত্রীদের জব্দ করার তৃপ্তিপূর্ণ হাসি। পরনে বড়দিমণি-স্টাইল তাঁতের শাড়ি। অলংকার হিসেবে স্কুলের প্রাপ্ত সব মেডেল আর ওঁর সমস্ত ডিগ্রির সার্টিফিকেট, কারণ বিদ্যা আর সম্মানের চেয়ে বড় গয়না পৃথিবীতে নেই। বাহন রূপে থাকবেন স্কুলের ডিসিপ্লিনারি স্যর, আর অসুর হবে স্কুলের সেরা বখাটেটা। অস্ত্র নিষিদ্ধ, তাই শূলের বদলে বখাটের কান থাকবে যথাক্রমে মা দুর্গারূপিণী হেডমিস্ট্রেস আর ডিসিপ্লিনারি স্যর-এর হাতে। প্রতিমার বাকি নয় হাতে বই-খাতা, পেন, পেনসিল, রুলার, ডাস্টার, ইরেজার, চক, বেত আর স্কুলের ঘণ্টা। প্যান্ডালের বাইরেটা হবে স্কুলবাড়ির আদলে আর ভিতরের থিম হেডমিস্ট্রেসের বাতানুকূল ঘর, যা কিনা সমস্ত দুষ্ট ছাত্রছাত্রীর দুঃস্বপ্নের এপিসেন্টার।

অরণ্য ব্রজবাসী বিবেকানন্দ মিশন স্কুল, জোকা

ঘুষদেবতা

মূর্তির শুধু দুটি বাঁ হাত। আর হাত নেই। মণ্ডপে থাকবে ফাঁপা বেদি ও তার চারপাশে গোছা গোছা টাকা। কমোড, ওয়াশিং মেশিন, ফ্রিজ খোলা থাকবে, যেখানে টাকা দেখা যাবে। নমস্কার মন্ত্র: ‘হে মোর বিত্ত, ঘুষের ঠেলায় বাড়বি কি রে?/ এই ভারতের টাকা কামাবার সাগরতীরে।’ অঞ্জলির মন্ত্র: ‘উন্নতি চাহে যারা, ঘুষ তো নেবেই তারা/ ঘুষ নিয়ে হতে হয়, নেতা জনতার/ এক বার নহে, ঘুষ নাও বার বার।’ এ পুজোর অসুরকে সামনাসামনি দেখা যাবে না। কারণ, অসুর তো লুকনো ক্যামেরা।

উৎপল সান্যাল সাউথ সিঁথি, কলকাতা

ছবি: সুমন চৌধুরী।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement