‘নাইট অ্যাট দ্য মিউজিয়াম’ ছবিতে নাইট ওয়াচম্যান বেন স্টিলার। প্রতি রাত্তিরে আজব কাণ্ড।
আসিফের রাত
বেহালা চৌরাস্তা পেরিয়ে ছিমছাম পাড়াটা। নিজেরাই দায়িত্ব নিয়ে রাতের জন্য আমাকে গার্ড ঠিক করে। রাতের বেলায় টহল দেওয়া আর একটু পর পর লাঠিটা ঠুকে বাঁশির আওয়াজে জানান দেওয়া: জেগে আছি। নানান রকমের মানুষ হয়: রাতপাহারায় ফাঁকি দিচ্ছি কি না দেখার জন্য জেগে বসে থাকে নিজেরাই। তবে বেশ কয়েক দিন হয়ে যাওয়ার পর ভরসা বা বিশ্বাসটা তৈরি হয়ে গেছিল। শুধু পাহারা নয়, কারও কারও বাড়ির টুকটাক কাজও করে দিতাম। ব্যাপারটা ঘটেছিল কিছুটা আচমকাই। এক জন মহিলা প্রায় নিয়মিত রাত দেড়টা নাগাদ বড় রাস্তা থেকে এসে এ-গলি সে-গলি হয়ে কোথাও চলে যান। এক-আধ দিন ভোর রাতে মহিলাটিকে ফিরেও যেতে দেখেছি। তবে, গোবেচারা দুর্বল এক মহিলাকে দেখে আলাদা করে সন্দেহ হওয়ার কিছু নেই। রাতপাহারার একটা একঘেয়েমি আছে। সেই অর্থে কিছুই হয় না, কিন্তু তাও সজাগ থাকতে হয়। এক দিন মহিলাকে দূর থেকে আসতে দেখে ঠিক করলাম, ফলো করব। বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে মহিলাকে এ গলির পর সে গলি হয়ে ফলো করে যেতে থাকি। রাস্তাটা পেরিয়ে বাঁ দিকে গোরস্থান। ভাঙা পাঁচিলের পাশ দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলেন মহিলা। আমারও জিদ চেপে গেছে। ক’দিন আগেই পড়েছি কঙ্কাল চুরি যাওয়ার ঘটনা। কোনও যোগ নেই তো? কিছুটা ভয় আর উত্তেজনা নিয়ে পাঁচিল পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। রাতের কবরস্থান, যতই সাহস থাকুক, গা ছমছম করছিল। তার মধ্যে ওই মহিলাকে আর দেখতে পাচ্ছি না। কিছুটা অপেক্ষা করার পর হালকা একটা শব্দ। আরও খানিক এগোতে কানে এল: ‘আর একটু কষ্ট কর, সোনা বাবা আমার, তোকে এখান থেকে নিয়ে যাব। অনেক দিন তোকে দেখিনি।’ হাড় হিম হয়ে গেলেও সাহস করে টর্চটা জ্বাললাম। একটা ছোট্ট খুরপি দিয়ে কবরের ওপর অসহায় ভাবে আঁচড় কেটে চলেছেন মহিলা। একমাত্র ছেলে সতেরো বছর বয়সে অ্যাক্সিডেন্ট করে। তার পর থেকেই... বিশ্বাস করেন ছেলে মারা যায়নি: বাকিরা জোর করে ওকে ভিতরে আটকে রেখেছে। ছোটবেলায় পড়া না করলে যে ভাবে ওর আব্বা দরজা বন্ধ করে রাখত। অনেক দিন পর মহিলাকে আর এক বার অজন্তা সিনেমা হলের সামনে প্রচণ্ড গরমে গায়ে কম্বল দিয়ে সিগনাল না মেনে রাস্তা পেরোতে দেখেছিলাম।
কমলের রাত
গ্রামের স্কুলে ইলেভেন। বাবার অসুস্থতার জন্য আর পড়াশোনা হয়নি। কলকাতায় এসে কাজকর্মের ধান্দায় ঘুরে এটা-সেটা জোটানোর পাশাপাশি বড় একটা কমপ্লেক্সে নাইট গার্ডের কাজ নিয়ে নেওয়া রাতটুকুর জন্য। অনেকগুলো ফ্ল্যাট। অনেক রাত পর্যন্ত গাড়ি আসে-বেরয়। বিশেষ কথা কারও সঙ্গেই হয় না। যারা আসে, তারা নির্দিষ্ট টাওয়ারের লিফ্টে ওপরে উঠে যায়। বাইরের কেউ এলে খাতায় নাম লিখে বা ইন্টারকমে কথা বলে উপরে পাঠানো হয়। আচমকাই এক দিন ভদ্রলোক ডাকলেন আমাকে। সিগারেট দিয়ে, নানান কথার পর বললেন, ‘কাউকে বলার দরকার নেই। এই হাজার টাকাটা রাখ। আমার আট তলার বাঁ দিকের ফ্ল্যাট। দিন দুয়েকের জন্য কলকাতার বাইরে যাচ্ছি। বউ চাকরি করে, সন্ধেবেলায় ফেরে। তোর একটাই কাজ। সন্ধের পর আমার ফ্ল্যাটে কারা কারা আসছে, নজর রাখবি। যে সব ছেলে আসবে, তাদের কেমন দেখতে, কত ক্ষণ থাকে, আমায় ফোন করে জানাবি।’ আজব কাজ! কিন্তু হাজার টাকাটা এটুকু কাজের জন্য অনেক। রাজি হয়ে গেলাম। ভদ্রলোক চলে যাওয়ার পর ওঁর স্ত্রীকেও ঠিকঠাক চিনে রাখলাম। সন্ধেবেলায় স্ত্রী একাই ফিরলেন। একটু রাতের দিকে একটি অল্পবয়সি ছেলে সরাসরি লিফ্টের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেখে কোথায়, কেন এ-সব প্রশ্ন করার মাঝেই ফোন করে সে কাউকে ডাকল। আটতলার ভদ্রমহিলা নেমে এসে আমাকে সটান বললেন, ‘কোনও নাম লিখবে না। আর অন্য কেউ আমার ফ্ল্যাটে যেতে চাইলে বলবে, আমি বাড়ি নেই।’ আবার একটা হাজার টাকার নোট এগিয়ে এল আমার দিকে। বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল। বাড়ির মালিক বাইরে আর সেই সুযোগে অবৈধ প্রেমিক এসেছে, ওঁকে একটা ফোন করে জানাব কি জানাব না ভাবছি, এমন সময় পুলিশের গাড়ি! আমাকে পাত্তা না দিয়ে, লিফ্টের পরোয়া না করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায় দুজন। কয়েক মিনিট পর প্রায় টানতে টানতে ছেলেটিকে নীচে নিয়ে আসে পুলিশ। ছেলেটি নিরুত্তাপ। গাড়িতে মারতে মারতে তোলে। টুকরো টুকরো কথা শোনা যায়: ‘বাকি নামগুলো বল শালা...’। পুলিশ নিয়ে চলে যায় ওকে। কানাঘুষো আলোচনা আর পর দিন খবরের কাগজ থেকে জেনেছিলাম, নিষিদ্ধ এক সংগঠনের সক্রিয় সদস্য ছিল এই মেধাবী ছেলেটি। অভিজাত বাড়ি, ঝকঝকে কেরিয়ার: সব ছেড়ে ঝাঁপ দিয়েছিল। গতকাল আটতলায় যে মহিলার কাছে ও এসেছিল, সে ওর ছোট্টবেলার সঙ্গী একমাত্র বোন। পরিবারের আর কেউ ওই ছেলেটির খোঁজ রাখেনি।
বিনোদের রাত
এখন এটিএম-এর সিকিউরিটি। তবে গায়ে কাঁটা দেয় বেশ কয়েক বছর আগের সেই মফস্সলের রাতটা মনে পড়লে। দূরে রেললাইন, তারও পরে বস্তি। পুকুরপাড়ের দিকটা নিরিবিলি। গার্ড দিতে দিতে ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। কাজ তো বাঁধানো সিঁড়িটার ওপর বসে মাঝে মাঝে মশাগুলোকে ওড়ানো। হঠাৎ কুকুরদের ভয়ংকর চিৎকার। পুকুরপাড়ের দিক থেকে একটানা ডেকে চলেছে। গা ঝাড়া দিয়ে ও দিকে এগনোর পর মনে হল কুকুরগুলো কোনও কিছু টানাহ্যাঁচড়া করছে। আরও এগোতে বুঝলাম সাদা কাপড়ের একটা জিনিসকে নিয়ে রীতিমত লড়াইতে নেমেছে এক দল কুকুর। প্রায় পুকুর থেকে তুলে আনা একটা সাদা বস্তা। আরও কাছে যেতে কানে এল কান্নার আওয়াজ। শিশু! মেয়ে হয়েছে বলে বস্তাবন্দি করে পুকুরে ভাসান দিতে এসেছিল বাড়ির লোক। পিছন ফিরতেই দেখলাম, রেললাইন পেরিয়ে কয়েকটা ছায়ামূর্তি অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
অনুপের রাত
জুটমিল কর্মী ছিলাম। আচমকাই বন্ধ হয়ে গেল। ট্রেনে ধূপকাঠি বিক্রি করে যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন। বন্ধুর কাছে খোঁজ পেয়ে গঙ্গার ধারের বিরাট আবাসনের নাইট গার্ডের কাজটা পেয়ে গেলাম। ডনবৈঠক করা পেটানো চেহারা কাজটা পেতে সাহায্য করেছিল। বড় বড় নিয়ন। রাতের বেলাতেও পড়তে অসুবিধা হত না। আমি গল্পের বই পড়ি। দিনের শেষে খবরের কাগজে চোখ বোলাই। ফ্ল্যাটে পাশের লোকের সঙ্গেই কেউ কথা বলে না আর নাইট গার্ডকে আলাদা করে কে পাত্তা দেয়! আবাসনের সেক্রেটারি আর মাতব্বর কয়েক জন যোগাযোগ রাখত। আপাত-শান্ত এই ফ্ল্যাটে সে ভাবে আলাদা করে কিছু না বুঝতে পারলেও, একটা মেয়ে গানের রেওয়াজ দিত বুঝতে পারতাম। ঝগড়ার আওয়াজ আসত ওপরের ফ্ল্যাট থেকে। ভদ্দরলোকদের ঝগড়ায় চিৎকার কম হলেও খিস্তি কম থাকত না। বেশ কয়েক মাস কেটে যাওয়ার পর যখন পুরো জায়গাটা সম্পর্কে আমার একটা ধারণা তৈরি হয়ে গেছে, হঠাৎ ঘটল ঘটনাটা। রাত অনেকটাই হয়েছে। একা একা বসে ফিল্মি ম্যাগাজিন পড়ছি, আচমকা মেয়েলি গলা: ‘ব্যস্ত আছেন?’ আমি অবাক! উঠে দাঁড়িয়ে কোনও সমস্যা কি না জানতে যাব, বলল: ‘সিগারেট আছে? বিড়ি হলেও চলবে।’ ‘নেই’ জানাতে মেয়েটি হঠাৎ যেচে গল্প শুরু করল: বাড়িতে কে কে, ছুটিতে কী করি, অনেক কিছু। ছোট মেয়ে আছে শুনে বলল, ‘পড়াশোনাটা ছাড়িও না কাকু।’ এই মেয়েটি ইলেভেন। সকালে ডিউটি ছেড়ে যাওয়ার সময় স্কুলবাসে উঠতে দেখেছি মনে পড়ল। বলল, ‘দাঁড়াও এক মিনিট, আসছি।’ কিছু ক্ষণ পর ওপর থেকে রঙের বাক্স আর অনেক চকোলেট এনে মেয়েকে দিতে বলে ফিরে গেল। বড়লোকের খেয়াল, কোনও মতলব আছে ভাবলাম। হয়তো রাত-বিরেতে বেরোবে। বাড়ির লোককে যাতে না জানাই তাই হাত করার চেষ্টা। দেখতে দেখতে সকাল হয়ে গেল। ডিউটি শেষ, বেরিয়ে চা খাচ্ছি, এমন সময় ফ্ল্যাটের ভিতরে গুঞ্জন। ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। ভিতরে ঢুকে এলাম। চার তলায় একটি মেয়ে গলায় ওড়না জড়িয়ে সুইসাইড করেছে। চকোলেটগুলোয় ফ্রিজের ঠান্ডা তখনও কাটেনি। জেনেছিলাম, ঝগড়াটা ওই ফ্ল্যাটেই হত। বাবা-মায়ের অন্য প্রেমিক বা প্রেমিকারা অবশ্য সে দিন মেয়েটিকে দেখতে আসেনি।
রতনের রাত
প্রাইভেট সিকিউরিটি সংস্থা থেকে নিযুক্ত। এখন বয়স হয়েছে। একাই থাকি। এক সময় বেশি ঝক্কি না নিয়ে একটা পাড়ার নাইট গার্ড হয়েছিলাম। বাড়ির থেকেও কাছে। সাইকেল নিয়ে চলে যেতাম রাতে খেয়ে। সঙ্গে একটা ছোট্ট গান শোনার যন্ত্র থাকত। এক মহিলা ওই পাড়ায় আমাকে দাদা বলে ডাকতেন। ভাইফোঁটাও দিয়েছিলেন। নানান কথা বলার মধ্যে মদ্যপ স্বামীর হাতে মার খাওয়ার কথাও বেশ কয়েক বার বলেছেন। মাঝে মাঝে আমিও বুঝতে পারতাম টহল দিতে দিতে। বিশেষ কিছু করার থাকত না, ওই বাড়ির সামনে এলে বাঁশিটা বাজাতাম জোরে। ক’দিন পর মহিলাটি তার গোপন প্রেমিকের কথাও আমাকে জানায়। ছেলেটিকে দেখিয়েওছিল। আমি হয়ে গেলাম ওদের প্রেমের মাধ্যম। এটা-ওটা পৌঁছে দেওয়া, সুযোগ বুঝে দেখা করার সময় জানানো, লুকিয়ে দেখা করার জায়গা ঠিক করা: আমার ওপর অগাধ ভরসা করত ওরা। কোনও কোনও দিন মাতাল বর ঘুমিয়ে গেলে বাড়ির পিছন দিক থেকে বেরিয়ে আসত মেয়েটি। আমার দায়িত্ব ছিল চার দিক নজর রাখা। লুকিয়ে-গোপনে ভালই চলছিল ওদের প্রেম। এখন শুনেছি একসঙ্গেও থাকে। কিন্তু আমার সঙ্গে ওদের আর যোগাযোগ নেই। সে দিন রাত্রে ছেলেটি চলে যাওয়ার পর ভুলে যাওয়া রাতের ওষুধটা খেতে সাইকেল চালিয়ে বাড়িতে ফিরে আসি। দরজায় কড়া নাড়তে গিয়ে থমকে যাই। কারও সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে আমার ছয় মাসের বিয়ে করা বউ। ছেলেটির গলাতেও প্রেম। ওরা আমার খাটটাতেই শুয়ে ছিল। একটা গোটা পাড়ার নাইট গার্ড হলাম, কিন্তু নিজের ওই ছোট্ট ঘরটুকুই সামলাতে পারিনি।
banerjeeriksundar@gmail.com