বিফাবিফি

গ রু খেলে জাত যায়। তাই ফ্রেশার্স ওয়েলকামের চার-পাঁচ দিন পরই কলেজ থেকে বেরিয়ে বললাম, চ, গরু খেতে যাই। কলেজ ধর্মতলা চত্বরেই। গ্রুপের এক বন্ধু বলল, যমুনা সিনেমা হল-এর পাশেই বিফ রোল পাওয়া যাবে। ঠিক হল, যমুনায় একটা সিনেমা দেখে, তার পর রোল। ও দাদা, রোল কত?

Advertisement

চন্দ্রিল ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০১
Share:

গ রু খেলে জাত যায়। তাই ফ্রেশার্স ওয়েলকামের চার-পাঁচ দিন পরই কলেজ থেকে বেরিয়ে বললাম, চ, গরু খেতে যাই। কলেজ ধর্মতলা চত্বরেই। গ্রুপের এক বন্ধু বলল, যমুনা সিনেমা হল-এর পাশেই বিফ রোল পাওয়া যাবে। ঠিক হল, যমুনায় একটা সিনেমা দেখে, তার পর রোল। ও দাদা, রোল কত? অ্যাঁ, মাত্তর এক টাকা! হেভি ইউরেকা হল। আর দেখি অ্যাক্কেরে ঠাসা মাংস! মানে ল্যাজা থেকে মুড়ো অবধি ভর্তি করে দিয়েছে, কোনও পেঁয়াজ দিয়ে স্পেস ভরাবার ঠগবাজিই নেই। খেয়েদেয়ে ঢেকুর তুলে ভাবলাম, এত সস্তায় যদি রোজ পেট ভরে এবং জিভেও উৎসব ঘটে, তবে জাত যাওয়া টেরিফিক ভাল। ক’দিন পর এই বিদ্রোহের পারফিউমটা উবে গেল, যেমন পরিচিতি এসে ঝাঁঝগুলো শুষে নেয়, বিফ তখন হয়ে গেল নিতান্ত ছোটভাই, যার ঘাড়ে হাত রেখে পাঁচমাথা মোড়ে যাওয়া যায়। তখন ঘুরতে-ফিরতে সবাই মিলে চিকেনও খাই, বিফও খাই, পর্কও, যেমন আইসক্রিমে কেউ আজ খায় চকোলেট স্টিক, কাল ভ্যানিলা কাপ। বাপ-মা’কে বললে তারা তিড়িংবিড়িং করে লাফায়, তাই মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরে আড়ে কপচাই, আজ গরু খেলাম, কাল শুয়োর খেলাম। ওদের হিস্টিরিয়া দেখতে বেশ লাগে। মূর্খকে খ্যাপানো এক ধরনের শিক্ষা-সার্ভিস বই কী। অবশ্য যাদের জীবনে প্রসন্নতা থইথই, চারিদিকে মজামৌজ ফুর্তিফার্তা, একটাও দুশ্চিন্তা নেই বেস্ট ফ্রেন্ডের কাছে প্রেমে হেরে যাওয়া ছাড়া, তারা আসলে জাত-টাত নিয়ে ভাবে না। ও-সব ভাবনার দায় সমাজের বুড়ো ও বুড়োটেদের, যাদের কোনও কাজ নেই। ব্যাটারা সকাল থেকে দাঁতন করতে করতে ডবল দাঁত কশকশায়, চ, সদ্যবিধবাকে চিতায় তোলার একটা নিদান দিই। আর হ্যাঁ, বড় জাতের কুয়ো থেকে জল নিলে হরিজনদের গণধোলাই দিয়ে খুন করার একটা উৎসব চালু করলে কেমন হয়? কিংবা এই সুযোগে যদি ওদের গ্রামের ডবকা মেয়েগুলোকেও রেপ করা যায়?

Advertisement

এক জন খুব বিখ্যাত লোকের গল্পও শুনলাম, তিনি একটা দোকানে গেছেন বন্ধুদের সঙ্গে রোল খেতে, সব বন্ধু চিকেন রোল অর্ডার দিয়েছে, তিনি অর্ডার দিয়েছেন বিফ রোল। বন্ধুরা তাঁর দিকে তাকিয়ে বললে, ছি ছি, তুই ব্রাহ্মণসন্তান হয়ে বিফ খাবি? তিনি অল্প হেসে বললেন, ভাই, তোমরাও বিফ খাবে, শুধু আমি দামটা কম দেব। অর্থাৎ, কোন রোলে কোন মাংস, চিকেনটা শকুন কি না, মাটনটা গরু কি না, কে জানছে? হয়তো সকলেই বিফ খাচ্ছে, কিন্তু হৃদয় ভাবছে চিকেন, তাই পৈতে তকতক করছে। আমার এক বন্ধু তো বারবার ‘অন গড’ দিব্যি গেলে বলত, তাদের পাড়ার রোলের দোকান প্রথমটা খুব রমরমিয়ে তার পর উঠে গেল, কারণ পাড়ায় আর নেড়ি ছিল না।

এত গল্প শুনিয়েও অবশ্য আমাদের ক্লাসে এক জনকে কিছুতে বোঝানো গেল না, সে ধরে বসে থাকল, প্রাচীন কালের মুনিঋষিরা যখন বলেছিলেন গরু খাওয়া বারণ, ওর মধ্যে টেরিফিক সায়েন্টিফিক কিছু একটা আছেই। তখন আমরা এমন দিগ্‌গজ ছিলাম না যে জানব, প্রাচীন ভারতীয় মুনিঋষিরা দেঁড়েমুশে গরু খেতেন। রাম বনবাসে যাওয়ার একদম গোড়ায় ভরদ্বাজ মুনি রামকে ইনভাইট করে ‘বৃষ, জল ও বন্য ফলমূল’ খাইয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বড় মূলধন ছিল এই প্রশ্ন, আমাদের জীবনটার চারপাশে জোরসে তাকিয়ে যা বুঝছি ভাবছি খতিয়ে দেখছি, তার ভিত্তিতে জীবনটা চালাব, না কয়েক হাজার বছর আগে ক’টা লোক কী উপদেশ দিয়ে গেছে (হয়তো কৃষির প্রয়োজনে গরুকে দেব্তা বানিয়েছে, যাতে তাকে খেয়েদেয়ে সংখ্যাটা কমিয়ে না দেওয়া হয়), তার ভিত্তিতে জীবনটা চালাব? শাস্ত্রে যদি এমন একটা জিনিস বলা থাকে যার কোনও সমর্থন আমরা আমাদের যুক্তি খাটিয়ে পাই না, তা হলে সেটা মানতে হবে কেন? প্রাচীন দাড়িওলা ঋষি মাত্রেই কোন হনু, যে, আমাকে আমার বিরুদ্ধে গিয়ে তার কাছে মাথা মোড়াতে হবে? আমরা জিগাতাম, তুই কি লজিক দিয়ে বলতে পারিস, গরু খাব না কেন? বন্ধু বলত, কারণ গরু পবিত্র। কেন পবিত্র? কারণ পবিত্র। কে বলেছে? বাবা বলেছে। তখন চ্যাংড়া জিজ্ঞেস করত, তোর বাবা, বা শাস্ত্র, বা শাস্ত্রবাবা, তোকে গু খেতে বললে তুই গু খাবি? ছেলেটি দুপদুপ করে পা ফেলে উঠে যেত। হাবভাব দেখে মনে হত, সম্ভবত একটুখানি খাবে, অনেকটা সস মিশিয়ে।

Advertisement

অবশ্য কত্ত যে কনভার্ট দেখলাম! ফার্স্ট ইয়ারে বালিশের তলায় গাজর নিয়ে শুত, এমন পাঁড় ভেজিটেরিয়ানকে থার্ড ইয়ারে দেখেছি পারলে গরুর মাংস দিয়ে বিছানা বর্ডার দেয়। একটা বিখ্যাত ব্যান্ডের ড্রামার যখন প্রথম বিদেশ গেল, সারা প্লেন শুধু স্ট্রিক্ট ফলমূল সাঁটাল, এয়ার হোস্টেসরা অবধি সাত্ত্বিক ধরাকাট দেখে টুলটুল। তার পর ফরেন গিয়ে বাথটবে চানটান করে যখন পেল্লায় আত্মহারা, ধোঁয়া-ভাত উপস্থিত। এনেছে তাদের দলেরই তিন-চারটে ছেলে, সস্তায় পেয়েছে বলে সুপারমার্কেট গিয়ে পর্ক ফ্রায়েড রাইস খাবলে হাজির। চনমনে খিদের লগ্নে খেতে পাওয়ার গরমাগরম নোলায়, পাঁইপাঁই সাপটে দিতে দিতে মাঝপথে ড্রামার সবে মণ্ড-মুখে আউআউ: জানো তো তোমরা, এ দেশে নাকি লোকে শুয়োরও খায়! আর যায় কোথা! ছেলেরা হয় নিষ্ঠুর প্লাস ফগড়া, প্যাঁটপ্যাঁট বাখারি-খোঁচার স্কোপ কে ছাড়বে? সমস্বরে ও সোল্লাসে সত্যি যখন অ্যানাউন্স করা হল, ব্রাহ্মিন-ছা করে কী? জাত এক বার সড়াৎ চলে গেলে তো আর অসৈরনকণা গলায় আঙুল দিয়ে উগরোনো যায় না! তদুপরি খেতে সাংঘাতিক ভাল। সেই
সু-সোয়াদের ডাল ধরে তুড়ুক তুড়ুক ক্লাইম্ব করতঃ এখন সে বিফস্টেক পেলে কোনও স্টেক না রেখে ঝাঁপিয়ে পড়ে, বিদেশে আমন্ত্রণ তার থট-বাব্‌ল’এ আজি এক খণ্ড ইয়া গরুফ্লেশের লাল মলমলের ’পর রেকারিং সুখবিহার!

আসল কথা হল, যা অপরিচিত তাকে নিয়ে ভয় সব্বাইই দেখায়, হেঁদু বলে: বেহ্মদের বাড়ি যাবি নে, হোথা মেয়েরা বেলাউজ গায়ে দেয়! আর আমেরিকা কমিউনিস্টদের এলিয়েন সাজিয়ে মগজ-দখলকারী ভিনগ্রহীর সায়েন্স ফিকশন ৩৫ মিমি-তে ছোড়ে। শিক্ষিত মানুষের কর্তব্য একটাই, এ সব ভিতুর ডিমডিমানিতে না ভড়কে, সরেজমিন পরিচয় করে, ব্যাপারটা যাচিয়ে নেওয়া। ক’দিন আগে ফেসবুকে ছবি বেরোল,
চিন-এ, কুকুরদের মেরে খাওয়া হবে বলে খাঁচায় রাখা হয়েছে। সব্বাই কেঁদেকেটে স্ক্রিন জবজবে করে দিল। অমন জুলজুলিয়ে নেত্রপাত করছে, এদের চিবোতে পারে কোন পাষণ্ড? আরে ভাই, সারি সারি ছাগলকেও তো আঁধার কুঠুরিতে ঠায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়, তুমি এক কেজি আগলি রাং চাইলেই টেনে এনে ঘচাং। শুধু ছাগল কিউট নয় বলে তার প্রাণের মূল্য কমে গেল? মুরগির চোখ ছলছলে টানা টানা নয় বলে সে তব দয়া হতে ডিসকোয়ালি? ওহে হাঁউমাউ, তোমার হ্যাবিট-টাকেই পৃথিবীর নীতিদণ্ড ধরছ কী করে? তোমার ছাগল খাওয়ার অভ্যাস আছে বলে সেটায় পাপ নেই, আর তোমার কুকুর খাওয়ার অভ্যাস নেই বলে সেটা পাপ: ব্যাপার যদি এত কিন্ডারগার্টেন হয়, তা হলে কুকুরখেকোর কাছে পাঁঠাখোরও তো সমান ঘৃণ্য। তার আন্তরিক ওয়াক-কে এড়িয়ে যাচ্ছ কোন মুভমেন্টে? যুক্তিটা এত সরল যে বলতে গেলেই মনে হয় অবান্তর পাইপে ফুঁ দিচ্ছি। যদি একটা জানোয়ারকে কেটে খাওয়া যায়, তবে সব জানোয়ারকেই কেটে খাওয়া যায়। যদি শাক খাওয়া ভাল হয়, পুঁই ভি দারুণ, পালং ভি অচ্ছা। আর যদি হিংসায় অ্যালার্জি, তাইলে কোনও জন্তুকেই খেয়ো না। শুধু ভেজ চিবোও। কিন্তু ভেজেরও প্রাণ আছে, সে আজিব বাত শুনেছ কি? তবে হাতে রইল হরিমটর। অবশ্য হরিকেও খাওয়া নির্ঘাত হেভি ক্রাইম।

ফুটন্ত কড়ায় তর্ক বুগিয়ে পড়ে থাকে সার ক্বাথ: আমি এই পৃথিবীর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বাকিরা পিলপিলে হাবিজাবি। আমি গরু খাই না, তাই যে খায় সে খারাপ। যদি বলো, আরে, সে তো তোমারই মতো সংস্কারাচ্ছন্ন দু’হাত দু’পা ওলা বুরবক, তবে ব্যাটা কম হল কীসে? উত্তর তুরন্ত এঁড়ে: ও কম, কারণ ও হল ও। আমি ইম্পর্ট্যান্ট ও মহাবিশ্বের কেন্দ্রে গ্যাঁট, কারণ আমি আমি। তবে হে গোবরবুদ্ধি, ঘুঁটেব্রেনুয়া, তোমাকে একটাই উপদেশ: নিজেকে অত সিরিয়াসলি নিয়ো না। ইতিহাসের শিক বাতাসে নড়ে (হিটলার অবধি ইন্টারভ্যালের পর আর দাপাতে পারেনি), কবে ক্যাৎ গিঁথে স্ট্রেট কাবাব করে দেবে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement