বরফ চূড়ায় কু-ঝিকঝিক

ইউরোপের উঁচু রেলস্টেশন। চারদিকে বরফ। তার উপর রোদের ফুলঝুরি খেলা। আছে খাঁটি দুধের সুইস চকলেটও। অপূর্ব তার স্বাদ।ইউরোপের সর্বোচ্চ রেল স্টেশন হল ইউংফ্রাউ। উচ্চতা ৩,৪৫৪ মিটার বা ১১,৩৩৩ ফুট। ১৮৯৩ সালে সুইস শিল্পপতি অ্যাডলফ গুয়ার জেলারের মাথায় আসে, টানেল ব্লাস্ট করিয়ে এখানে কগ-হুইল রেলওয়ে চালু করলে ব্যাপার মন্দ হয় না!

Advertisement

রামপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:০০
Share:

ইউরোপের সর্বোচ্চ রেল স্টেশন হল ইউংফ্রাউ। উচ্চতা ৩,৪৫৪ মিটার বা ১১,৩৩৩ ফুট। ১৮৯৩ সালে সুইস শিল্পপতি অ্যাডলফ গুয়ার জেলারের মাথায় আসে, টানেল ব্লাস্ট করিয়ে এখানে কগ-হুইল রেলওয়ে চালু করলে ব্যাপার মন্দ হয় না! আল্পস পর্বতের এই সুউচ্চ চুড়ো তা হলে মনোরম পর্যটন কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। তিন বছর পর, ১৮৯৬ সালে ১০০ জন ইতালিয়ান শ্রমিক নিয়ে প্রথম কাজ শুরু করেন তিনি। মজুরি দিনে মাত্র ৪.৬০ ফ্রাঁ (এখনকার ১ ফ্রাঁ ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৬৩ টাকা)। ১৬ বছর ধরে ৩০০০ লোকের কঠোর পরিশ্রমে তৈরি হয় এই ইউংফ্রাউ রেল স্টেশনটি।

Advertisement

ইউংফ্রাউ স্টেশন চত্বরে যেতে হলে সুইটজারল্যান্ডের সাজানো-গোছানো শহর জুরিখ হয়ে যেতে হয়। ইউরোপের সবচেয়ে লম্বা হিমবাহ ‘দ্য গ্রেট অ্যাসেচ গ্লেসিয়ার’ (লম্বায় ১৪ মাইল বা ২৩ কিলোমিটার) শুরু হয়েছে এই ইউংফ্রাউ থেকেই। শুধু তাই নয়, এই রেল স্টেশন থেকে নীচে তাকালেই দেখতে পাবে ফ্রান্স এবং জার্মানিরও বেশ কিছু শহরকে।

ইউংফ্রাউ মানেই চার দিকে শুধু সাদা বরফ। স্টেশনের গায়ে চলছে রোদের ফুলঝুরি খেলা। কখনও কখনও দেখছি রেললাইনের দু’পাশে বরফ জমে আছে। মাঝখান দিয়ে ট্রেন চলেছে। আর আছে আকাশ থেকে অনবরত সাদা তুলোর মতো তুষারপাত বা স্নো-ফল। প্রকৃতি এখানে নিজের রূপের ডালি উজাড় করে সাজিয়ে রেখেছে পর্যটকদের জন্য। চার দিকে সীমাহীন শীতল বরফ প্রান্তর, কী ভীষণ নির্জন, নিস্তব্ধ! স্টেশনে ট্রেন থামলে বরফ-জমা কাচের জানলা পরিষ্কার করা হচ্ছে। রেলযাত্রা শেষে যখন প্রত্যেক যাত্রী স্টেশনে নামেন, তাঁর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় সেই দিনের তারিখ সহ স্ট্যাম্প-মারা একটা স্মারক-পুস্তিকা, যা সেই যাত্রী-পর্যটক সারা জীবন স্মারক হিসেবে নিজের কাছে রেখে দিতে পারেন। এ ছাড়াও স্টেশনে আছে ভেন্ডিং মেশিনও, যাতে কিছু ফ্রাঁ জমা করলেই বেরিয়ে আসে ইউংফ্রাউ-এর সিলমোহর লাগানো সংগ্রহযোগ্য স্মারক মুদ্রা। উত্‌সাহী পর্যটকরা এই উচ্চতার শিখর-প্রান্তের ডাকঘর থেকে পিকচার পোস্টকার্ড কিনে পোস্ট করলেই সেটা যথানিয়মে পৌঁছে যাবে নির্দিষ্ট ঠিকানায়।

Advertisement

শুধু প্রকৃতিই নয়, দেখতে হয় এখানকার মানুষদেরও। অনেক শেখার আছে তাঁদের কাছে। এই প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যেও পর্যটনকে কী ভাবে আকর্ষণীয় করে তোলা যায়, তার অদম্য প্রয়াসকে কুর্নিশ করতেই হয়। ট্রেনের টিকিট-চেকাররা প্রতিটি বিদেশি ভ্রমণার্থীকে স্বাগত জানান আন্তরিক ভাবে। স্টেশনের কাছেই আছে শপিং মল, সুইস চকলেট আর ঘড়ির দোকান, দারুণ রেস্তরাঁ। সুইটজারল্যান্ড প্রধানত দুটি জিনিসের জন্য বিখ্যাত। সুইস চকলেট, আর সুইস ঘড়ি ‘কু কু ক্লক’। সুইটজারল্যান্ডের দুগ্ধজাত দ্রব্য তো তুলনাহীন। দুধ থেকেই তৈরি হয় সুইস চকলেট তার স্বাদই আলাদা! চোখে পড়ে সবুজ পাহাড়ের কোলে সাজানো ছবির মতো সুন্দর গ্রামগুলো। ঘাসের পুরু সবুজ গালিচায় চরছে গরু আর ভেড়ার দল। বছরের বেশির ভাগ সময়ই এখানকার তাপমাত্রা শূন্যের নীচে থাকে। স্থানীয়দের বিশ্বাস, গরুগুলো যে দিন স্থির দাঁড়িয়ে থাকে, বেশি নড়েচড়ে না, তার পরের দিনটা নাকি রোদ-ঝলমলে হয়।

এখানেই আছে ‘প্যানোরামা’। চার মিনিটে সারা অঞ্চলটা ৩৬০ ডিগ্রি দেখার দারুণ সিনেম্যাটিক অভিজ্ঞতা। আছে অ্যালপাইন সেনসেশন রাউন্ড, লাইট মিউজিক সহ এই রেলওয়ের ইতিবৃত্তান্ত-সংবলিত গ্যালারি। আছে স্ফিংস অবজারভেটরি সুইটজারল্যান্ডের দ্রুততম লিফ্‌টে চড়ে ২৭ সেকেন্ডে ফ্রান্স আর জার্মানির ব্ল্যাক ফরেস্ট দেখে নেওয়া। আছে চোখ ধাঁধানো আইস প্যালেস ১০০০ বর্গমিটার বিস্তৃত লম্বা বরফের চ্যানেল, তাপমাত্রা মাইনাস তিন ডিগ্রি বা তারও কম। বরফের তৈরি ক্রিস্টাল দিয়ে বানানো ঈগল আর পেঙ্গুইন, দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। বরফ কেটেই তৈরি হয়েছে দশ ফুট উচ্চতার শার্লক হোমসের মূর্তি। তার সামনে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকদের ছবি তোলার হিড়িকও দেখার মতো। সীমাহীন বরফ-রাজ্য, তারই মধ্যে বরফ কেটে অগুনতি মূর্তি আর কারুকাজ যেন এক রূপকথার দেশ! শিল্প যে কোন উচ্চতায় পৌঁছতে পারে, না দেখলে বিশ্বাসই হয় না।

আছে স্লেজ পার্ক। স্কি করার প্রশস্ত জায়গা। গ্লেসিয়ারের ওপর দিয়ে স্টিল কেব্‌ল-এর সঙ্গে জিপ লাইনে ২৫০ মিটার ওড়া। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩,৪৫৪ মিটার ওপরে অবাধ বিচরণ। বরফের চূড়ায় পতপত করে ওড়া সুইস পতাকা। আলেটস্‌ক গ্লেসিয়ারের কাছে স্নো-ফল’এর মধ্যে দাঁড়িয়ে ইউংফ্রাউ স্টেশন দেখা যত দূর চোখ যায় ধবধবে সাদা বরফের চাদর পাতা যেন। তারই ওপরে রোদ এসে আপন মনে কাটাকুটি খেলে চলেছে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে আনমনা মন প্রশ্ন করে, স্বর্গ কোথায়, এইখানটায় না হলে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement