তিন দিনের ভারতসফরে এসেছেন লিয়োনেল মেসি। দেশের বিভিন্ন শহরে পা রেখেছেন ফুটবলের রাজপুত্র। ১৩ থেকে ১৫ ডিসেম্বর কলকাতা, হায়দরাবাদ, মুম্বই, দিল্লির বাসিন্দারা ছিলেন মেসি-জ্বরে আক্রান্ত। শুক্রবার রাত ১.৩০ মিনিটে কলকাতা বিমানবন্দরের মাটি ছুঁয়েছিল লিয়োনেল মেসির ব্যক্তিগত বিমান। দীর্ঘ দিনের সতীর্থ লুইস সুয়ারেজ এবং আর্জেন্টিনা দলের রদ্রিগো ডি পলের সঙ্গে মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য কলকাতায় এসেছিলেন বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার।
মেসি ও তাঁর সফর, ‘গোট ট্যুর ইন্ডিয়া’র খুঁটিনাটি নিয়ে যেমন আলোচনার অন্ত ছিল না, তেমনই নজর কেড়েছে মেসির ‘উড়ন্ত রাজপ্রাসাদ’টিও। কিংবদন্তি ফুটবলারকে একঝলক দেখার জন্য ভক্তেরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। কড়া নিরাপত্তা এবং ভক্তদের ভিড়ের মধ্যে যেটি সকলের বিস্ময়ের উদ্রেক ঘটিয়েছিল সেটি হল মেসির ব্যক্তিগত বিমান ‘গাল্ফস্ট্রিম ভি’।
মেসির ভারতসফরের পর এই দূরপাল্লার বিলাসবহুল বিমানটিকে ঘিরে উৎসুক জনতার কৌতূহল তুঙ্গে। আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে তাঁর বিলাসবহুল ‘বাহনটি’। এলভি-আইকিউ নামে নিবন্ধিত বিমানটি ২০০৪ সালে তৈরি করা হয়েছিল। ২০১৮ সালে এটির মালিক হন মেসি। ‘গাল্ফস্ট্রিম ভি’ হল ‘গাল্ফস্ট্রিম ৪’-এর একটি উন্নত সংস্করণ।
লিয়োনেলের এই ব্যক্তিগত জেটটি ৫১ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়তে পারে। ফলে আকাশপথে বিমানজটে পড়তে হয় না এটিকে। ‘গাল্ফস্ট্রিম ভি’ হল একটি অত্যন্ত বিলাসবহুল বিমান। এর রেঞ্জ প্রায় ৬,৫০০ নটিক্যাল মাইল। আল্ট্রা-লং-রেঞ্জ বিজ়নেস জেট গোত্রের এই বিমান নিউ ইয়র্ক থেকে টোকিয়ো অথবা লন্ডন থেকে সিঙ্গাপুরের মধ্যে কোনও বিরতি না নিয়েই অবিরাম উড়তে সক্ষম। ঘণ্টায় ৫৫০ মাইল বা ৮৮৫ কিলোমিটার গতিতে ছুটতে সক্ষম এই জেট।
বিমানটির অন্দরসজ্জা যেমন চোখ ধাঁধিয়ে দিতে পারে, তেমনই এর বহিরঙ্গে মেসির ব্যক্তিগত ছোঁয়া রয়েছে। বিমানের লেজের ডানায় তাঁর বিখ্যাত জার্সির নম্বর খোদাই করা রয়েছে। এমনকি বিমানের সিঁড়িতে ফুটবল তারকার স্ত্রী আন্তোনেলা এবং তিন সন্তান থিয়াগো, মাতেও এবং সিরোর নাম লেখা আছে। ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় একটি ব্যক্তিগত মাত্রা যোগ করে এই চিহ্নগুলি। যে কোনও বিমানবন্দরে বিমানটিকে একনজরেই চিনে নেওয়া যায়।
ক্লাব ও আন্তর্জাতিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য প্রায়ই মেসিকে নানা মহাদেশে ঘুরে বেড়াতে হয়। দীর্ঘ ভ্রমণের জন্য অত্যন্ত কার্যকর উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ও নির্ভরযোগ্য এই গাল্ফস্ট্রিম বিমানটি। জেটটিতে রয়েছে রোলস-রয়েসের তৈরি টার্বোফ্যান ইঞ্জিন। প্রতিটি ইঞ্জিন ১৫ হাজার পাউন্ড থ্রাস্ট সরবরাহ করে। এর উন্নত ও ডানার জটিল নকশা বিমানটির পূর্ব সংস্করণের চেয়ে বেশি জ্বালানি বহনে সক্ষম করে তুলেছে। এর বিশেষ নকশা ও কর্মক্ষমতার জন্য ‘হাই প্রোফাইল’ এই বিমানটিকে বিশ্বব্যাপী ভ্রমণকারীদের মধ্যে অনেকেই ব্যক্তিগত বিমান হিসাবে বেছে নিয়েছেন।
১৯৯৭ সালে এই বিমানটির মাধ্যমেই অতি দীর্ঘপাল্লার জেট বিমানের বাজারে পা রেখেছিল গাল্ফস্ট্রিম অ্যারোস্পেস কর্পোরেশন। এই বিশেষ মডেলটির ১৫৩টি ইউনিট তৈরি করেছিল সংস্থাটি। এর পর সংস্থার পক্ষ থেকে আরও একটি উন্নত মডেল ‘গাল্ফস্ট্রিম জি৫৫০’ বাজারে এনেছিল তারা।
মেসির বিমানের তাকলাগানো অন্দরসজ্জার একঝলক সমাজমাধ্যমে প্রকাশ্যে এনেছে ‘’। এই সংস্থাটি ব্যবসায়ী এবং তারকাদের প্রাইভেট জেট ভাড়া দেয়, বিলাসবহুল ভ্রমণের বিশ্বব্যাপী পরিষেবাও প্রদান করে। ইনস্টাগ্রামের একটি পোস্টে দেখা গিয়েছে, ফুটবলার ও তাঁর সতীর্থদের আরাম, বিশ্রাম ও বিলাসিতা নিশ্চিত করার জন্য বিমানের অভ্যন্তরীণ অংশগুলি বিশেষ ভাবে সজ্জিত।
বিমানের ভিতরে রয়েছে ১৪টি আসন। প্রতিটি আসনই আইভরি রঙের মহার্ঘ চামড়া দিয়ে মো়ড়া। ১৪টি আসনকে ৬টি শয্যায় রূপান্তরিত করা সম্ভব, যা যাত্রীদের দীর্ঘ দূরত্বের যাত্রায় আরামে বিশ্রাম নিতে সাহায্য করে।
১৫ থেকে ১৯ জন যাত্রী বহন করতে পারে বিমানটি। জেটটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৯৬.৪ ফুট (২৯.৪ মিটার)। উচ্চতা ২৬.৮৫ ফুট (৮.১৮ মিটার)। অন্যান্য বিমানের তুলনায় আরও প্রশস্ত। একটি রান্নাঘর, দুটি শৌচাগার রয়েছে বিলাসবহুল বিমানটিতে। মেসি ও তাঁর পরিবার কিংবা দলীয় সতীর্থদের সমস্ত ধরনের প্রয়োজন মেটানোর আধুনিক উপকরণ দিয়ে সাজানো রয়েছে এই বিমানটি।
কনভেকশন অভেন, মাইক্রোওয়েভ, সিঙ্ক, কফি মেকার এবং ক্যাবিনেট দিয়ে সজ্জিত বিমানের রান্নাঘরটি। বিমানের পিছনে একটি ওয়াক-ইন ব্যাগেজ কম্পার্টমেন্ট রয়েছে। স্নান করার সুব্যবস্থাও রয়েছে এখানে। এমনকি জামাকাপড় রাখার জন্য আলাদা ওয়াড্রোবের বন্দোবস্তও আছে।
বিমানটিতে ক্রু বা বিমানকর্মীদের জন্য বিশ্রামের জায়গাও রয়েছে। ইন্টারনেটের জন্য পুরো বিমানে ওয়াইফাই রয়েছে। বিমানের পিছনের ডিভানটিকে বিছানায় পরিণত করা যেতে পারে। গোপনীয়তার জন্য দরজা ব্যবহার করে এটিকে একটি ব্যক্তিগত স্যুটে পরিণত করা যেতে পারে। একটি দরজা কেবিন থেকে একে আলাদা করে দেয়।
বড় বড় ডিম্বাকৃতির জানালাগুলি রাখা হয়েছে যাতে কেবিনে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে। বিমানে ১০০ শতাংশ তাজা বাতাস ঢোকার সুবিধা রয়েছে। আছে স্যাটেলাইট ফোনেরও ব্যবস্থা। বড় মনিটর-সহ একটি বিনোদন ব্যবস্থাও রয়েছে।
এই অত্যাধুনিক জেটের দাম বাজারদর অনুযায়ী ১.৫ কোটি ডলার। নতুন মডেলের দাম আরও বেশি। প্রায় ৪ কোটি ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১৩২ কোটি টাকার কাছাকাছি। বিলাসবহুল এই বিমানটির পরিচালনা খরচও বেশ মোটা। ২০০ ঘণ্টা উড়ানের জন্য ১৮ লক্ষ ৩২ হাজার ১৬১ (প্রতি মাইলে খরচ ১৯.৫৮ ডলার) ডলার খরচ হয়। অর্থাৎ, ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১৬ কোটি ৬২ লক্ষ টাকা।
সাধারণত বিমানটি বুয়েনস আইরেসের কাছে অবস্থিত সান ফার্নান্দো বিমানবন্দর থেকে যাত্রা করে। একটি বেসরকারি চার্টার্ড অপারেটর বিমান সংস্থা এটি পরিচালনা করে। কিছু সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মেসি এবং তাঁর পরিবার যখন বিমানটি ব্যবহার করেন না তখন তিনি বিমানটি ভাড়ায় দিয়ে দেন, যাতে বিমান পরিচালনার খরচ এর থেকে উঠে আসে।
সোমবার সকালে দিল্লি যান লিয়োনেল মেসি। ভারতসফরে এটাই ছিল তাঁর শেষ গন্তব্য। সোমবার বিকেলেই ভারত সফর সেরে বার্সেলোনার উদ্দেশে উড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল লিয়োনেলের। শেষ মুহূর্তে সফরসূচিতে পরিবর্তন ঘটানো হয়। আর্জেন্টিনার বিশ্বজয়ী অধিনায়ককে গুজরাতের জামনগরে আমন্ত্রণ জানান মুকেশ অম্বানী।
অম্বানী গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে মেসিকে আমন্ত্রণ জানানো হয় জামনগরের ‘বনতারা’য়। তার বিনিময়ে মোটা অর্থের প্রস্তাব দেওয়া হয় আর্জেন্টিনার বিশ্বজয়ী অধিনায়ককে। অম্বানী গোষ্ঠীর প্রস্তাবে রাজি হন মেসি। তার পর সফরসূচি বাড়িয়ে মঙ্গলবার দিল্লি থেকে জামনগরের যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। প্রথমে স্থির করা হয়েছিল মঙ্গলবার সকালে জামনগর যাবেন মেসি। পরে সূচি পরিবর্তন করে সোমবার রাতেই পৌঁছোনোর সিদ্ধান্ত নেন
জামনগরে রয়েছে অম্বানী গোষ্ঠীর বিশেষ প্রকল্প ‘বনতারা’। ‘বনতারা’ দিয়ে শেষ হবে মেসির এ বারের ভারত সফর। অম্বানী গোষ্ঠীর আতিথেয়তা গ্রহণ করে ভারত ছাড়বেন মেসি।