রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০৩
Share:

অনলাইনে শপিং, টিকিট কাটা, গাড়ি চড়া, বাড়ি কেনা তো ছিলই। কিন্তু আজ থেকে ভারত সরকার টাকার ব্যবহার পুরোপুরিই তুলে দিল। চুরি ডাকাতি ইত্যাদি অপরাধ বন্ধ করতে এই ব্যবস্থা। প্রাইভেট টিউটরের ফি, শ্মশানে ইলেকট্রিক চুল্লির বিল, কাজের মাসির মাইনে থেকে শুরু করে পেপারওয়ালার টাকা, মশলামুড়ির দাম এমনকী রেডলাইট এরিয়ার এসকর্টের বিলও বাধ্যতামূলক ভাবে ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মেটানোর নির্দেশিকা জারি করল সরকার। ফলে জাল টাকার কারবারিরা নিতান্তই বেকার হয়ে পড়বে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যাংকে লাইন দিয়ে টাকা তোলা-জমার বিরক্তিকর সিস্টেমও উঠে যাবে। গতকাল থেকেই দেশ জুড়ে ব্যাংকগুলোয় মানুষ শেষ বারের মতো তাঁদের সমস্ত ক্যাশ টাকা জমা দেওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। গ্রাহকদের সুবিধার জন্য আগামী সাত দিন সারা দিন সারা রাত ব্যাংকগুলো খুলে রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আগেই জনধনরতনযোজনা প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের সব মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে ক্যাশলেস প্রকল্পটি শুরু হয়ে গিয়েছিল। আজকের নির্দেশিকায় বলা হল, টাঁকশাল-কর্মচারীদের বিভিন্ন কেন্দ্রীয় দফতরে নিয়োগ করা হবে। টাঁকশালগুলোকে ‘হেরিটেজ বিল্ডিং’ বলে ঘোষণাও করা হল। আগামীকাল সিমা গ্যালারিতে ‘মেমরিজ অব মানি’ নামে একটি কারেন্সি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। নোট ও মুদ্রা ছাপানো বাবদ সরকারের যে বিশাল টাকা খরচা হত, তা এ বার নানা রকম সেবামূলক প্রকল্পে ব্যয় করা হবে, তাতে দেশের উন্নয়ন বহু ধাপ এগিয়ে যাবে। সকলে এই সাহসী পদক্ষেপে খুশি হলেও, গতকাল থেকে ‘জাতীয় পকেটমার সমিতি’ অনির্দিষ্ট কালের জন্য অবরোধ ও চাক্কা জ্যাম শুরু করেছে। দাবি, তাদের পুনর্বাসন ও সাইট-হ্যাকিংয়ের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এ বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘সব কুটিরশিল্পই হস্তশিল্প, কিন্তু সব হস্তশিল্প শিল্প নয়।’

Advertisement

সন্দীপন নন্দী, বালুরঘাট

Advertisement

লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা:
টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

এসটিডি আইএসডি পিসিও

এটা কি টু ফোর ফোর ওয়ান ওয়ান থ্রি নাইন/ দিন না ডেকে বেলাকে একটি বার/ মিটার যাচ্ছে বেড়ে এই পাবলিক টেলিফোনে/ জরুরি, খুব জরুরি দরকার...’ অবশ্য জরুরি দরকার ছাড়া কে আর বুথে আসবে! অঞ্জন দত্তের গানটা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল আমাদের ওপরেই। নতুন কোনও মেয়ের ফোন নম্বর পেলেই আমরা হানা দিতাম বুথে। যদি আমাদের ভাগ্যেও এক জন ‘বেলা বোস’ জোটে!

কারও সঙ্গে আলাপ হলেই প্রশ্ন ছুড়তাম, সবচেয়ে ছোট কাচের ঘর কোনটা? প্রশ্ন শুনে সবাই ভ্যাবাচ্যাকা। আমরাই দিয়ে দিতাম উত্তর: এসটিডি বুথ! তখন ১৯৯৪-’৯৫ সাল, বাজারে ল্যান্ডফোন দাপাচ্ছে। মোবাইল তখনও এমন পেঁচিয়ে ধরেনি, কালো গাবদা ফোনই ভরসা। অনেক শৌখিন ডিজাইনের ফোন-সেট বেরিয়েছিল, তবে তাদের দেখা মিলত শুধু সিনেমার পরদায় আর নানান এসটিডি বুথ-এ। আমাদের বাড়িতে ফোন ছিল না। তাই শীতগ্রীষ্মবর্ষা, এসটিডি বুথই ভরসা!

ছোট্ট চৌকো ঘর। চেপেচুপে বড়জোর দুজনের জায়গা। তিন দিক কাচ, নীচটা কাঠ দিয়ে ঘেরা। কাচের গায়ে বড় লাল হরফে ইংরেজিতে পর পর লেখা: এসটিডি, আইএসডি, পিসিও, ফ্যাক্স। কোনও কোনও বুথ-এ আবার একটা বড় রিসিভারের ছবিও আঁকা থাকত। দেওয়ালে কাঠের র‌্যাকে টেলিফোন। লাল নীল কালো কালিতে গোটা দেওয়াল জুড়ে কারুকাজ! মানব মনের গভীর গ্রাফিত্তি। গাদা টেলিফোন নম্বর, মেয়ের মুখ, তলায় শুকদেব+অতসী, বাড়ি বা অফিসের ঠিকানা, সিনেমার নাম, গানের লাইন থেকে আরম্ভ করে মুদিখানার হিসেব পর্যন্ত। প্রায় সব বুথেই ‘কমন’ একটা ছবি— একটা তির এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে গাঢ় লাল কালিতে আঁকা একটি হৃদয়কে। কোনও কোনও বুথে আবার তা থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্তও চুঁইয়ে পড়ত। বোঝা যেত, কত মান-অভিমান, মন জোড়া-ভাঙার সাক্ষী এই বুথগুলো।

বহরমপুর টেক্সটাইল কলেজে পড়ি, থাকি মেস-এ। বাড়িতে কথা বলতে রোজ বুথে যেতাম। মিনিটে দু’টাকা কল চার্জ। মাথার ওপর দেওয়ালে লাল আলোর, সময় মাপার ইলেকট্রনিক মেশিন। কথা বলতে বলতে চোখ আঠার মতো সেঁটে থাকত ওখানে। ৫০ সেকেন্ড হলেই কথার স্পিড বেড়ে যেত। ৫৮ সেকেন্ডে পৌঁছতেই ‘রাখছি, কাল কথা হবে’ বলেই লাইন কেটে দিতাম। ৬১ সেকেন্ড হয়ে গেলেই যে কল চার্জ ৪ টাকা!

এসটিডি বুথ। শুধু কি কথা বলার ছোট্ট কাচের ঘর? ফোনের দু’পারে মান-অভিমান,

মন জোড়া-ভাঙার সাক্ষীও ছিল তারা।

’৯৫-এর এক বিকেলে মাঠে আড্ডা মারছি, বন্ধু সুভাষ তার গভীর পর্যবেক্ষণের ফলাফল জানাল: প্রতিটি এসটিডি বুথেই একটি জেরক্স মেশিন থাকে, এবং অধিকাংশ ফোন বুথ চালায় মেয়েরা। সুভাষের আরও সংযোজন: এই মেয়েদের বয়স কুড়ি থেকে পঁচিশ, এবং প্রতি ছ’থেকে আট মাসে নতুন নতুন রিক্রুট। ‘কেন?’ ‘আরে, আগের মেয়েটার বিয়ে হয়ে যায়, তাই’— তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জবাব দিয়েছিল সুভাষ। মানে! কেন? ঘাড় নেড়েছিল সুভাষ, জানে না। সেই ‘কেন’র উত্তর পেয়েছি পরে।

উচ্চমাধ্যমিকে কো-এড স্কুল। মাসখানেকের মধ্যেই প্রায় সব জোড়ায়-জাড়ায়। স্কুল তো ছ’ঘণ্টা, তার পর! বাকি সময়ের বিরহব্যথা সইবে কেমনে? ত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভাব এসটিডি বুথগুলোর।

আমরা তিন বন্ধু একই বুথ থেকে ফোন করতাম। প্রথমে আমি, পরে সৌরভ, শেষে দেবাশিস। কোনও কালেই আমি তেমন বলিয়ে-কইয়ে ছিলাম না। তাই ফোনে আমাদের, মানে মেয়েটির সঙ্গে আমার বেশির ভাগ সময় কাটত চ্যানেল-না-ধরা রেডিয়োর মতো। একটানা চুপ থাকার পর কেউ এক জন হয়তো বললাম, ‘হ্যাঁ’। ও-পারে একটা ‘হুঁ’। আবার চুপচাপ। সবচেয়ে বেশি ক্ষণ কথা বলত সৌরভ। ননস্টপ। কী করছ? কী পড়ছ? আজ কী দিয়ে ভাত খেলে? আলুপোস্ত? ঝিঙেপোস্ত? চাটনি হয়নি? আলুভাতে কি পেঁয়াজ দিয়ে মাখা ছিল? কী মাছ হয়েছিল? ও, বৃহস্পতিবার তো নিরামিষ, না? এই তোমার ডিম খেতে ভাল লাগে? আরে, অমলেট তো আমারও ফেভারিট! ডিমের ভুজিয়া খেয়েছ কখনও? আরও কত কী। অধৈর্য দেবাশিস পেছন থেকে খোঁচা মারত, প্রেম করছিস না ছাতার মাথা। রেস্টুরেন্ট খোলগে যা হতভাগা!

দেবাশিস আবার জাত রোমান্টিক। প্রেমিকাকে ফোনে স্বরচিত কবিতা শোনাত। বিচার-বিশ্লেষণও ফোনেই। পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাঁধা। হঠাৎ এক দিন সৌরভ লক্ষ করল, দেবাশিস ফোনে আর বেশি কথা বলছে না। কবিতাও শোনাচ্ছে না। শুধু তা-ই না, সৌরভ বেশি ক্ষণ কথা বললে বিরক্তও হচ্ছে না আগের মতো। উলটে হাত দেখিয়ে আশ্বস্ত করছে! তার পরই দেখা গেল, এসটিডি বুথের মেয়েটার সঙ্গে দেবা-র বেশ জমে গেছে। খুব হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলা আর হাসাহাসি। আমরা কলেজ যাওয়ার সময় মেয়েটা দোকানের বাইরেও এসে দাঁড়ায়! এক দিন টিউশন-ফেরত চেপে ধরলাম, কেসটা কী বল তো? লাজুক হেসে দেবা বলেছিল, ধুস, তোরা পাগল হলি না কি! আমাদের সরল মন, বিশ্বাসও করলাম।

তিন দিনের মাথায় দেবাশিস ভ্যানিশ। বুথের মেয়েটাকেও দেখা যাচ্ছে না। নেহাতই কাকতালীয় কি না, ভাবতে ভাবতে দিন পনেরো কাবার। সঞ্জু খবর আনল, দেবাশিস ফিরেছে। গেলাম ওর বাড়ি। সে দিনের সেই লাজুক হাসি নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে দেবাশিস। ঘরের ভেতরে ঢুকে আমরা থ। বুথের সেই মেয়েটা না? কপালে লাল টিপ, মাথায় ঘোমটা, একদম অন্য রকম লাগছে! আমাদের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, বসুন, চা নিয়ে আসি।

কৌশিক ভট্টাচার্য, মাকড়দহ, হাওড়া

kausik2013@gmail.com

নইয়ের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 90’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement