রবিবাসরীয় ম্যাগাজিন

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০৩
Share:

গত পরশু গঙ্গায় প্রতিমা বিসর্জনের সঙ্গে শেষ হয়েছে দুর্গাপুজো। এ বছর পুজোর মুখ্য সমস্যা ছিল, পুরোহিতের অভাব। এখন শহরে ত্রিশ কোটির কাছাকাছি দুর্গাপুজো হয়। কিন্তু এই মুহূর্তে অত পুরোহিত ঠাকুরের জোগান নেই। বাড়ির পুজোগুলি ঠাকুরমশাই পেলেও, অধিকাংশ বারোয়ারি পুজোর উদ্যোক্তারা পুরোহিত জোগাড় করে উঠতে পারেননি। তাঁরা মণ্ডপে সংস্কৃত সিডি বা ক্যাসেট চালিয়ে দেবীর বোধন থেকে শুরু করে অষ্টমীর অঞ্জলি, সন্ধিপুজো, দশমীর বিসর্জন সেরে নিয়েছেন। এতে তাঁরা চরম অসন্তুষ্ট। এর জন্য তাঁরা সরকারের ভুল নীতিকে দায়ী করছেন। এর প্রতিবাদে পুজো উদ্যোক্তাদের মিছিল গতকাল দুপুরে শহর পরিক্রমা করে শহিদ মিনারের পাদদেশে এসে শেষ হয়। সেখানে তাঁরা বলেন, শহরে চোর-ছ্যাঁচড়, গুন্ডা, বদমাশদের বাড়-বাড়ন্ত। অথচ পুরোহিতের দেখা নেই! সরকার এর বিহিত না করলে তাঁরা দেশ জুড়ে আন্দোলনে নামবেন। তাঁরা স্লোগান দেন ‘পুরোহিত লাও/ দেশ বাঁচাও।’ সমাবেশ শেষে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে স্মারকলিপিও দেন। মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস, আগামী বছর থেকে যাতে এই সমস্যা না হয়, তার জন্য সরকার জেলায় জেলায় পুরোহিত-কলেজ স্থাপন করবে। যাঁরা পাশ করে বেরোবেন, ‘পুরোহিত সার্ভিস কমিশন’ পরীক্ষার মাধ্যমে তাঁদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ করা হবে। পুরুতরা কলকাতা পুরসভা ও গ্রামপঞ্চায়েতের দফতরে আলাদা ‘ঠাকুরঘর’ পাবেন। এর পর দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী, শনি, গণেশ, কার্তিক, সন্তোষী মা, অন্নপূর্ণা, বজরংবলি— বাড়ি বা বারোয়ারি পুজো প্যান্ডালে যে পুজোয় যখনই পুরুতের দরকার হবে, দু’মাস আগে নির্দেশাবলি মেনে আবেদন করলেই মিলে যাবে জলজ্যান্ত পুরোহিত ঠাকুর। বিনামূল্যে। তবে দক্ষিণাস্বরূপ, সকল বারোয়ারি পুজোর ও বাড়ির ঠাকুরের মুকুটে ‘বিশ্ববাংলা’ ব্র্যান্ডের ‘ব’ লোগোটি খোদাই করতে হবে।

Advertisement

অতীশচন্দ্র ভাওয়াল, কোন্নগর, হুগলি

Advertisement

লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা:
টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

ট্রেন থেকেই ডেলি গঙ্গাদর্শন

দমদম থেকে প্রিন্সেপ ঘাট, ভায়া বিবাদিবাগ। দূরপাল্লার ট্রেনের বাতিল কোচ জুড়ে বানানো, কাঠের বগির, ডিজেল ইঞ্জিনে টানা রেল। চক্ররেল। বিধানচন্দ্র রায়ের স্বপ্নকে সত্যি করতে তৎকালীন ইস্টার্ন রেলের শিয়ালদহ সেকশনের ম্যানেজারের তত্ত্বাবধানে সূচনা হয়েছিল এই সাব-সেকশন, মূলত শিয়ালদহ নর্থ-এর ওপর থেকে চাপ কমাতে। আশির দশকের মাঝামাঝি, চাকরিবাকরির কারণে আমরা যারা রোজ ডালহৌসি অফিসপাড়ায় আসতাম, তাদের মধ্যে খুব আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল চক্ররেল নিয়ে।

তখন দমদম থেকে অফিসপাড়ায় যাতায়াত খুব মুশকিল ছিল। বাস-রাস্তা ওয়ান-ওয়ে ছিল না, মারাত্মক যানজট। সময়ে পৌঁছনো যেত না। আর শিয়ালদহ নর্থ-এ বারাসত, ডানকুনি, ব্যারাকপুর এমনকী ক্যান্টনমেন্ট লোকাল চালু থাকলেও ‘দমদম লোকাল’ বলে কিছু ছিল না। অফিস টাইমে তাই দমদমে ভিড় ট্রেনে ওঠানামা করতে খুব বেগ পেতে হত। মুশকিল আসান হয়ে এল চক্ররেল। দমদমের পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্ম, আর নতুন তৈরি আরও ন’টা স্টেশন। সব মিলিয়ে দশটা: দমদম, পাতিপুকুর, উল্টোডাঙা, টালা, বাগবাজার, শোভাবাজার, বড়বাজার, বিবাদিবাগ, ইডেন আর প্রিন্সেপ ঘাট। চক্ররেলই হয়ে উঠেছিল অলিখিত ‘দমদম স্পেশাল’। দমদম স্টেশনের পূর্ব আর পশ্চিম দিককার প্রচুর অফিসযাত্রী, পূর্ব সিঁথি, সাউথ সিঁথি, এমনকী নাগেরবাজার, চিড়িয়া মোড় এলাকার বহু মানুষকে দেখেছি রোজ হইহই করে চক্ররেলে উঠতে। ডানকুনি, বনগাঁ আর মেন লাইনের প্রচুর লোকও রোজ দমদম এসে ট্রেন চেঞ্জ করে চক্ররেল ধরতেন। ভাঙাচোরা রেক (পরের দিকে অবশ্য ডিএমইউ গাড়ি দেওয়া হয়েছিল) হলেও, শহরের ময়লা-আবর্জনা ভরা এলাকার মধ্য দিয়ে যাতায়াত করলেও, ডেলি প্যাসেঞ্জারদের খুব আপন হয়ে উঠেছিল চক্ররেল।

রোজ একসঙ্গে ট্রেনে গেলে যেমন হয়, বয়স নির্বিশেষে বন্ধুতা গড়ে উঠেছিল সহযাত্রীদের মধ্যে। অমুক ট্রেন, তমুক কামরা নির্দিষ্ট থাকত। আমাদের দশ-পনেরো জনের দলটা যেতাম সকাল ন’টা পাঁচের ট্রেনে। দমদম টু বিবাদিবাগ চল্লিশ মিনিটের যাত্রাপথ পৌঁছতে লেগে যেত প্রায় এক ঘণ্টা। নির্ভেজাল আড্ডায় বয়ে যেত সময়। ট্রেনে উঠেই শুনতে পেতাম মিস্টার গনজালভেসের গান। অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, একটা হাওয়াইয়ান গিটার বাজিয়ে দারুণ সব ইংরেজি গান গাইতেন। পরে শুনেছিলাম, বিবিসিতে চান্স পেয়ে লন্ডনে চলে গেছেন। প্যাসেঞ্জারদের অনেকগুলো দল ছিল, কোথাও আবৃত্তি চলছে, কোথাও গান, কোথাও স্রেফ বকবক। এক ভদ্রলোক ছিলেন, টালা থেকে উঠতেন। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা কক্ষনও কামাই করতেন না। দারুণ গানের গলা ছিল, দুর্গাপুজোর আগে রেডিয়োর মহালয়ার এক-একটা অংশ এক এক দিন গেয়ে শোনাতেন। কাজ থেকে অবসর নেওয়ার পর ওঁর ট্রেনে ওঠা বন্ধ হয়ে গেল, আমাদের গান শোনা-ও। এক দিন দমদমে ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে, হঠাৎ দেখি, প্ল্যাটফর্মের এক কোনায় প্রায় লুকিয়ে দাঁড়িয়ে, উদাস তাকিয়ে আছেন আমাদের ছেড়ে-যাওয়া ট্রেনের দিকে।

চক্ররেলের প্রিন্সেপ ঘাট স্টেশন, ১৯৮৪ সালে। গঙ্গার ধার দিয়ে এ ভাবেই চলত ডিজেল ইঞ্জিনের কুঝিকঝিক।

কত খুনসুটি, প্রেম-ভালবাসা, বিয়ে অবধি জড়িয়ে আছে চক্ররেল ঘিরে। গঙ্গার পাড় ধরে ট্রেন যেত, রোজ গঙ্গাদর্শন তো হতই, ট্রেন থেকেই দেখা যেত পুজো, আরতি। ক্রসিংয়ের জন্য বাগবাজার স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াত কিছু ক্ষণ। স্টেশনের ঠিক সামনে এক মাছবিক্রেতা ইলিশ মাছ নিয়ে বসত। সেই মাছ কেনা নিয়ে দারুণ উত্তেজনা দেখেছিলাম এক সহযাত্রীর মধ্যে। জোর গলায় দাবি করেছিলেন, কেনার সময় ইলিশটা একদম জ্যান্ত ছিল ও চোখ পিটপিট করছিল। দমদম পৌঁছেও মাছ-হাতে ওই ভদ্রলোককে ঘিরে ছিল অনেকে। তর্ক চলছিল, জল থেকে তোলার পর ইলিশ মাছ বাঁচে কি না, সে নিয়ে।

সন্ধে সাতটার আশেপাশে যে ট্রেনটা বিবাদিবাগ ছেড়ে দমদমের দিকে যেত, আমাদের দলটা সেটা চেপে বাড়ি ফিরতাম। কোনও দিন মিস হলে বেজায় আপশোস, যাহ্‌, ফেরার আড্ডাটাও মিস! এক দিন সবার চোখের সামনে চলন্ত ট্রেন থেকে ব্যানার্জিদা পড়ে গেলেন, ট্রেনের হাতল ছিঁড়ে। আমরা হতভম্ব। সম্বিৎ ফিরতে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। ট্রেন তখন পাতিপুকুর ছেড়ে দমদমের দিকে যাচ্ছে। অন্ধকার, লাইনের পাশে ঝোপজঙ্গল, অনেকটা নীচে শেঠবাগান-পাতিপুকুর রোড। আতঙ্কে মাথা কাজ করছিল না। দমদম আসতেই দৌড়ে গার্ডকে গিয়ে জানাতে তিনি বললেন, তিনি কিচ্ছু দেখেননি, ফিল-ও করেননি, ওঁর কিছু করার নেই। আমরা দুটো দলে ভাগ হয়ে চললাম ‘স্পট’-এর দিকে। এক দল লাইন ধরে, এক দল রাস্তা বেয়ে। অবাক কাণ্ড, তন্নতন্ন খুঁজেও ব্যানার্জিদাকে পাওয়া গেল না। অগত্যা সিদ্ধান্ত হল, ওঁর বাড়িতে খবর দিতে হবে। গেলাম। সদর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম: ব্যানার্জিদা সোফায় বসে মুড়ি খাচ্ছেন, সামনে ধোঁয়া-ওঠা চায়ের কাপ! আমাদের দেখেই উঠে বাইরে বেরিয়ে এলেন। ওঁকে দেখে আমাদের ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল, আবার কৌতূহলের পারাও চড়চড়। বললেন, ঘন ঝোপের মধ্যে পড়ায় তেমন কোনও চোট লাগেনি। এমনকী গতি কম থাকায় উনি ওই ট্রেনেরই শেষের কামরায় উঠেও পড়েছিলেন। তার পর সোজা বাড়ি, এবং অবশ্যই কাউকে কিছু জানাননি। আমাদের বললেন চলে যেতে, নইলে এতগুলো ছেলেকে একসঙ্গে দেখে বাড়ির লোকের সন্দেহ হবে। এর পর থেকে আমাদের রোজকার ট্রেন-যাত্রায় ব্যানার্জিদাই হট টপিক ছিলেন, কিন্তু এর পর ওঁকে চক্ররেলের ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেখিনি আর কোনও দিন!

সুজিত কুমার সাধ্য, রাজরাজেশ্বরী রোড, দমদম

piyalisahana@gmail.com

আশির দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 80’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement