কাল প্রধানমন্ত্রী নিজের দফতরে বসে কম্পিউটারে একটি ক্লিক করে দেশের ছ’টি শহরের প্রধান জেলগুলিতে (থুড়ি, সংশোধনাগার) একশো শতাংশ শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এইমস্ ধাঁচের হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন। শহরগুলি হল— দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই, কলকাতা, বেঙ্গালুরু ও আমেদাবাদ। কিছু দিনের মধ্যে আরও কিছু শহরে এই ধরনের হাসপাতাল তৈরি হবে। হাসপাতাল পিছু দশ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। জেলে বন্দি নেতা, মন্ত্রী, আমলা এবং ভিভিআইপি’রাই এখানে চিকিৎসার সুযোগ পাবেন। বিগত বেশ কয়েক দশক ধরে এ রকম বন্দির সংখ্যা যে হারে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে এবং জেলে আসামাত্র তাঁরা যে ভাবে অজানা অসুখে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাতেই এই সিদ্ধান্ত। চিকিৎসা ছাড়াও এই হাসপাতালগুলিতে বেশ কিছু অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়া যাবে। এখানে কফি শপ, টেনিস কোর্ট, বিলিয়ার্ড রুম, সুইমিং পুল থাকবে, ব্যাংকোয়েট হলে বুফে সিস্টেমে ব্রেকফাস্ট-লাঞ্চ-ডিনারও মিলবে। একটি মাল্টিপ্লেক্সও থাকবে। সেখানে হল-এ রিলিজের আগেই সব সিনেমা দেখানো হবে। সব বিরোধী দলই সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছে। তবে তাঁরা একজোট হয়ে এই সব হাসপাতালে অন্তত একটি করে দামি ‘বার’ তৈরির আবেদন জানিয়েছেন, যেখানে বিদেশি দামি মদের ঢালাও ব্যবস্থা থাকবে। প্রধানমন্ত্রীও এ বিষয়ে খুব শিগগিরিই চিন্তাভাবনা করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। তবে, সাধারণ বন্দিরা সংগঠিত হয়ে তাদের অসুখ-বিসুখে এই সব সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়ার জন্য যে দাবিদাওয়া জানিয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে তা সরাসরি নাকচ হয়ে গিয়েছে। এমনকী জেনারেল কোটার বন্দিরা যাতে এই সব হাসপাতালের ধারেকাছে ঘেঁষতে না পারে, তার জন্য হাসপাতালের প্রধান গেটে কুকুরসহ সশস্ত্র পুলিশবাহিনী মোতায়েন করা হবে বলে জানা গেছে।
স্বাক্ষর ভট্টাচার্য, বড়িশা, কলকাতা
লিখে পাঠাতে চান ভবিষ্যতের রিপোর্ট? ঠিকানা:
টাইম মেশিন, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। অথবা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in
রবি ঘোষের শটে ঢুকে পড়েছিলাম
১৯৭০-’৭১ সাল হবে। কলেজ থেকে এনসিসি ক্যাম্পে এসেছি দিঘায়। রাতে টেন্টে শুয়ে শুয়ে সমুদ্রের গর্জন শুনতে পেলেও, জলে নামা তো দূরস্থান, সমুদ্র দেখতে যাওয়ারই অনুমতি ছিল না কারও। কিন্তু তা তো আর সত্যি সত্যি মেনে নেওয়া যায় না! এখানে এসে সমুদ্র না দেখে ফিরে গেলে নিজের কাছেই মুখ দেখাব কী করে? অগত্যা এক দিন প্ল্যান করে, ট্রেনিং ফাঁকি দিয়ে, আমরা তিন বন্ধু দিঘার সমুদ্র দর্শনে রওনা হলাম।
ক্যাম্পের লাগোয়া মাঠ পেরিয়ে বালিয়াড়ির ওপরে উঠতেই ঝাউবনের ফাঁক দিয়ে দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র চোখে পড়ল। কিন্তু তার পরেই, সমুদ্রে নয়, চোখটা আটকে গেল দূরে একটা জটলার দিকে। প্রথমে ভাবলাম, কোনও দুর্ঘটনা ঘটেছে বুঝি, কেউ কি সমুদ্রে ডুবে গেল? কৌতূহলবশত সবাই এগিয়ে গেলাম সে দিকে। কিন্তু কাছে যেতেই বিস্ময়ে হতবাক! আরে, এ কাকে দেখছি! সত্যি, না স্বপ্ন! আমাদের সামনে এ যে সমস্ত বাঙালির হার্টথ্রব, আমাদের এক ও একমাত্তর গুরু, স্বয়ং উত্তমকুমার!
জানা গেল, ‘বিকেলে ভোরের ফুল’ সিনেমার শুটিং চলছে। সমরেশ বসুর গল্প, পরিচালক পীযূষ বসু। আমরা তো দেখেশুনে ভয়ানক উত্তেজিত। এসেছি নীরস এনসিসি করতে, এ দিকে মহানায়ককে এত কাছ থেকে দেখার জলজ্যান্ত সুযোগ! আর সিনেমার শুটিং-এর মতো ইন্টারেস্টিং একটা জিনিসেরও সাক্ষী থাকা যাবে! সেই টানে পর দিন সকাল হতে না হতেই আমরা সবাই সি-বিচে হাজির। আমাদের প্রথম টার্গেট হল উত্তমকুমারের ছবি তোলা আর অটোগ্রাফ নেওয়া। সারা ক্ষণ সুযোগ খুঁজছি। তক্কে তক্কে থেকে ছবি তোলা গেল বটে, কিন্তু মহা মুশকিল, শুটিংয়ের লোকজন কিছুতেই অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য উত্তমকুমারের ধারেকাছেও ঘেঁষতে দেবে না। এতে নাকি তাঁর অভিনয়ের মনঃসংযোগের ব্যাঘাত ঘটবে। উনি একটা বড় ছাতার নীচে হাতদুটো বুকের কাছে আড়াআড়ি ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখদুটো আধবোজা, যেন কিছু ভাবছেন গভীর ভাবে। আমরা ‘গুরু! গুরু!’ করে ডাকতে থাকলাম। কিন্তু সত্যিই কী কনসেনট্রেশন, অমন চিৎকারেও গুরু এক বারও ফিরে তাকালেন না।
‘বিকেলে ভোরের ফুল’ ছবির একটি দৃশ্যে রবি ঘোষ ও গীতা দে। অকৃতদার মাস্টারমশাই ভাব জমাচ্ছেন অবিবাহিতা দিদিমণির সঙ্গে।
আমরা তাতে বিন্দুমাত্র দমলাম না। উনি উত্তমকুমার, আর আমরা কোথাকার কোন চুনোপুঁটি। অপেক্ষা করতে থাকলাম, কখন শুটিং শুরু হবে, গুরুর অ্যাক্টিং দেখব এক্কেবারে সামনাসামনি। এক সময় শুরুও হল শুটিং। ক্যামেরা জোন-এর মধ্যে উত্তমকুমার আর সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়। শটটা এ রকম: ওঁরা দুজনে সি-বিচ ধরে হাঁটছেন। উলটো দিক থেকে এগিয়ে আসছে কয়েক জন মদ্যপ যুবক, তাদের এক জনের চরিত্রে কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়। সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়কে লক্ষ্য করে তিনি কোনও অশালীন মন্তব্য করতেই উত্তমকুমার সপাটে কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়ের গালে এক চড় মারলেন। সত্যি সত্যি চড়। কিন্তু চড় মারার পর মাতাল লোকগুলোর চোখমুখের ভঙ্গি বা প্রতিক্রিয়া পরিচালকের মনে ধরল না। তাই শটটা আবারও নেওয়া হল। উত্তমকুমার ফের চড় কষালেন। চড়টা এ বার বেশ জোরেই হয়েছিল, শট শেষে দেখলাম, কল্যাণ চট্টোপাধ্যায়ের পিঠে হাত রেখে উত্তমকুমার সস্নেহে বললেন, ‘খুব লেগেছে, না?’ কল্যাণ চট্টোপাধ্যায় উত্তর দিলেন, ‘আপনার হাতের চড় তো আমার কাছে আশীর্বাদ। আর এক বার মারুন, দাদা।’
উত্তমকুমারের ধারেকাছে ঘেঁষতে না পারলেও অন্য আর্টিস্টদের কাছে যেতে খুব একটা বাধা পাইনি। একটা দৃশ্যের শুটিং হচ্ছিল— ছেলেদের কলেজের স্যর রবি ঘোষ, কলেজের ম্যাডাম গীতা দে’কে ঝাউবনে একান্তে প্রেম নিবেদনের চেষ্টায় রত। এ দিকে নির্জন স্থান, সন্ধে নেমে আসছে, দেখে ছেলেরা সব ‘স্যর, স্যর’ করে রবি ঘোষকে খুঁজতে বেরিয়েছে। তাদের গলার আওয়াজ পেয়ে রবি ঘোষ অকুস্থল থেকে ছুটে পালাচ্ছেন, পালাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবেন। আর তক্ষুনি ছেলের দল ভূপতিত রবি ঘোষের ওপর হুমড়ি খেয়ে সমস্বরে বলে উঠবে, ‘স্যর, কী হল!’ শুটিং দেখার উপরি সিনেমার এক্সট্রা-র রোলেও শামিল হওয়ার এমন দারুণ মওকা হাতের সামনে পেয়ে আমরাও ছেলেদের দলে ভিড়ে তাদের সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলাম: ‘স্যর, কী হল!’ আমাদের এই কাণ্ড দেখে অবশ্য শুটিংয়ের লোকজন যারপরনাই বিরক্ত হল। পইপই করে সাবধান করে দিল— খবরদার, এমনটা আর করতে যেয়ো না।
আমরা শুনতে হয় শুনে নিলাম, কিন্তু থোড়াই কেয়ার। একটু পরেই দৃশ্যটা রি-টেক হচ্ছে, ছেলের দল যেই না আবার হুমড়ি খেয়ে রবি ঘোষের ওপর পড়ে গেল, আমরা নিষেধের তোয়াক্কা না করে একদৌড়ে ওই ভিড়ে ঢুকে গলা মেলালাম: ‘স্যর, কী হল!’ এ বার প্রোডাকশনের এক জন রে-রে করে আমাদের দিকে তেড়ে এল। আমরা পড়ি কি মরি ছুটে পালিয়ে দূরে একটা বালির ঢিপির ওপর চড়ে বসলাম।
তখনও ওই শটটাই রি-টেক হচ্ছে, তৃতীয় বার। আবার সেই ছেলের দলের খোঁজাখুঁজি, রবি ঘোষের পালানো শুরু হল। কিন্তু এ বার একটা কাণ্ড ঘটল— উনি শটে পালাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন ঠিকই, তবে ঠিক আমাদের বালির ঢিপির নীচেই। ছেলের দলও যথারীতি হুমড়ি খেয়ে রবি ঘোষের ওপর পড়বে পড়বে করছে, আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। ঝাঁপ মারলাম বালির ঢিপির ওপর থেকে। ছেলের দলের পায়ের জটলা ভেদ করে, মুন্ডুটা গলিয়ে দিয়ে, ওদেরই সঙ্গে জোরে চেঁচিয়ে উঠলাম: ‘স্যর, কী হল!’
ধীরেন্দ্রমোহন সাহা, কসবা গোলপার্ক, কলকাতা
dhirensaha@yahoo.com
সৎতরের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 70’s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান
এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in