অবন ঠাকুরের নাম আজও লোকের মুখে মুখে, কিন্তু তাঁর দাদা গগন ঠাকুরের নাম ততটা প্রচার পায়নি। শুধু রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ বইটার টুকরো-টাকরা ছবি আঁকার জন্য তাঁকে মনে রেখেছেন কেউ কেউ। অথচ, এই মানুষটার মধ্যে ঠাকুরবাড়ির শিল্পী-রক্ত কম ছিল না কিছু। তাঁর তুলি-কলমের জীবনের গল্পগুলিও ভারী চমত্কার।
গগনেন্দ্রনাথ ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রপৌত্র। তিনি গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ সন্তান। সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাইপো। গগন ঠাকুর জন্মেছিলেন ১৮৬৭ সালে। প্রথাগত বিদ্যায় তাঁরও ছিল ভয়ানক অরুচি। সে সময়ের বিখ্যাত শিল্পী ছিলেন হরিনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়। জলরঙের ছবি আঁকতে তাঁর জুড়ি ছিল না। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কাছেই নাড়া বেঁধেছিলেন।
গগনেন্দ্রনাথের চোখে মোহনবাগানের খেলা।
পরিণত বয়সে, ছোট ভাই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে মিলে, গগন ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আটর্’। গগন ঠাকুরের নিজের আঁকাতে, তাঁর তৈরি ব্যঙ্গচিত্রে বাঙালিয়ানার প্রভাব ছিল খুব স্পষ্ট। তাঁর আঁকায় দেখা যেত জাপানি চিত্রকলার কেরামতিও। হবে না? ১৯০৬ থেকে ’১০-এর মধ্যে শিল্পী কত কষ্ট করে জাপানি ব্রাশ টেকনিক শিখেছিলেন। চিনে-জাপানি অঙ্কনরীতির সঙ্গে নিজস্বতার রং মিশিয়ে কত ছবি উপহার দিয়ে গেছেন আমাদের। তার কতগুলো যে কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে, ভাবলেও মন খারাপ হয়ে যায়।
খুব থিয়েটার ভালবাসতেন গগন ঠাকুর। লেখালেখিও করেছেন কখনও কখনও। ‘ভোঁদড় বাহাদুর’ বলে একটা ছোটদের বই লিখে ফেলেছেন এই আঁকা নিয়ে মেতে থাকার ফাঁকেই। সেই লেখায় লুইস ক্যারলের ঘরানার সঙ্গে মিল পাওয়া যায়।
ঠাকুরবাড়ির ছেলে, সমাজ বদলানোর ঝোঁকটাও তো থাকবেই। সময়ের থেকে অনেকখানি এগিয়ে ছিল তাঁর শিল্পী-মন। সব সময়ে নতুন রকম কিছু করার ভাবনায় মেতে থাকতেন। একটা গল্প বললেই তার আন্দাজ পাওয়া যাবে। নিজের মেয়ে সুজাতার বিয়ে নিয়ে গগনেন্দ্র বড় মাপের বাজি ধরেছিলেন। সে সময় হিন্দু বিয়ে এবং শ্রাদ্ধে সেলাই করা বস্ত্র পরিধানের রেওয়াজ ছিল না। পুরোহিতরা চাদর পরতেন, জামা বা পাঞ্জাবি পরতেন না। শ্রাদ্ধ এবং বিয়ের সময় মেয়েরা শাড়ি ও চাদরে নিজেদের আবৃত রাখতেন। ব্লাউজ বা সেমিজ পরতেনই না। কারণ, ওই যে! শাস্ত্রীয় কাজে ছুঁচ-সুতোয় বোনা কাপড় পরা বারণ ছিল। কারণ ছুঁচে সুতো পরাতে হলে জিভের লালায় ভিজিয়ে নিয়ে সুতোকে ছুঁচের ফুটোয় পরাতে হয়। এই অশুচি ব্যাপারটা হিন্দু শাস্ত্র মানতে পারেনি। তাই বিয়ের অনুষ্ঠানে এক সময় এ ধরনের জামা পরা ঘোর নিষিদ্ধ বলে গণ্য হত।
গগনেন্দ্রনাথ তাঁর মেয়ে সুজাতাকে ব্লাউজ পরিয়ে পাত্রস্থ করার ব্যবস্থা করলেন। পাত্রের পিতার এতে ঘোরতর আপত্তি। বিবাহসভায় সুজাতা এসে দাঁড়াতেই পাত্রের পিতা বিয়েতে আপত্তি জানালেন। মেয়ে ব্লাউজ পরে বিয়ে করলে তাঁরা বিয়ে মেনে নেবেন না। গগনেন্দ্রনাথ পালটা দাবি করলেন মেয়েকে সেলাই করা কাপড় পরানো হয়নি। যদি বেয়াইমশাই প্রমাণ করতে পারেন যে কন্যার পরিধানে ওই বস্ত্র আছে, তা হলে নগদ এক লাখ টাকা বাজি ধরবেন।
শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, গগনেন্দ্র ঠিকই বলেছেন। কন্যার ব্লাউজে কোথাও সেলাই নেই। সর্বত্র আঠা দিয়ে নিপুণ কৌশলে প্রয়োজন মতো বস্ত্রখণ্ড জোড়া দেওয়া হয়েছিল। এখন যাঁদের গড়পড়তা বয়স আশি, তাঁরা অনেকেই কলেজ স্ট্রিট মিউজিয়মে সুজাতা দেবীর বিয়ের সেই বিখ্যাত ব্লাউজ এবং শাড়িটা হয়তো দেখে থাকবেন। আমি এই বস্ত্রখণ্ড দুটি দেখেছি এবং গল্পটি শুনেছি ব্রাহ্মনেতা সমাজসেবী জ্ঞানাঞ্জন নিয়োগীর কাছে।
রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’র গল্পের খসড়া
অলংকরণ হিসেবে গগন ঠাকুরের আঁকা ছবি।
যাঁরা গগন ঠাকুরের আঁকা ক্যারিকেচার-সিরিজ দেখেছেন, তাঁরা সব্বাই জানেন, ভারী অন্য ধাঁচের রসবোধ ছিল তাঁর। ১৯১১ সালে মোহনবাগান ক্লাব আইএফএ শিল্ড জয় করে ভারতীয় ফুটবলে ইতিহাস করল। আগুনে যেন ঘি পড়ল, বাঙালির রক্তে ফুটবলপ্রীতি দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছল যে, পাড়ায় পাড়ায় ফুটবল ক্লাব প্রতিষ্ঠা হতে শুরু করল এবং বাঙালি চরিত্রের প্রধান পরিচয় হয়ে দাঁড়াল যে, সে ফুটবলের সমর্থক এবং সমঝদার। মোহনবাগান ক্লাবের খেলা যে দেখেনি, সে বাঙালিই নয়। ঠাকুরবাড়িতেও সেই হুজুগের ঢেউ পৌঁছল।
রবীন্দ্রনাথ অবশ্য সেই হুজুগে মেতে কোনও কবিতা লেখেননি। কিন্তু গগনেন্দ্র নিজের জুড়িগাড়ি নিয়ে মোহনবাগান মাঠে খেলা দেখতে গিয়েছিলেন। তাঁর দুর্ভাগ্য, খেলার দিন, ঠিক খেলার সময়েই শুরু হল ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এবং মোহনবাগানের ছেলেরা তাদের স্বভাবমত খালি পায়ে সেই কাদা-মাঠে খুব ভালই খেলল। গগনেন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত জীবনে খেলাধুলোর তেমন ভক্ত কোনও দিনই ছিলেন না। জুড়িগাড়ি থেকে খেলা দেখতে আদৌ নামলেন না। সঙ্গে ছাতাও ছিল না। যারা বারো মাস মাঠে খেলা দেখতে যায়, তারা ছাতা সঙ্গে নিয়েই যায়। ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে অতি যত্নে প্রতিপালিত গগনেন্দ্রনাথ কি আর মাঠ-ঘাটের খবর রাখা হাটুরে মানুষ? তিনি তো ছাতা নিয়ে যাননি। তবে দেখেছিলেন অনেক কিছু। বাড়ি ফিরেই স্বভাব-কার্টুনিস্ট গগনেন্দ্র একটি মজার কার্টুন এঁকে ফেললেন যে দিক তাকাই, ছাতা আর ছাতা। বল কই! গোলপোস্ট কই!
গগনেন্দ্রনাথের নাতি, আমাদের দ্বারিকদা, বেশ রসিয়ে গল্পটা বলেছিলেন। পারিবারিক মহলে এই মজার গল্পটি অনেক দিন চালু ছিল।