সময়ের ফাঁদে

ইন্দ্রনীলের আজ খুব আনন্দ। প্রায় কুড়ি বছর পর ফিরে আসছে ছোটকাকা। কুড়িটা বছর কম নয়! এর মধ্যে কলকাতার অনেক কিছু বদলে গিয়েছে। ছোটকাকা যখন এখান থেকে গিয়েছিল, তখন যারা ছিল পুচকে, তারা আজ বড় হয়ে গিয়েছে। সে সময় তো ইন্দ্রনীলও খুব ছোট ছিল।

Advertisement

জয় সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৫ ০০:২৪
Share:

ইন্দ্রনীলের আজ খুব আনন্দ। প্রায় কুড়ি বছর পর ফিরে আসছে ছোটকাকা। কুড়িটা বছর কম নয়! এর মধ্যে কলকাতার অনেক কিছু বদলে গিয়েছে। ছোটকাকা যখন এখান থেকে গিয়েছিল, তখন যারা ছিল পুচকে, তারা আজ বড় হয়ে গিয়েছে। সে সময় তো ইন্দ্রনীলও খুব ছোট ছিল। ছ’বছরের ইন্দ্রনীল ছোটকাকাকে ছাড়তেই চাইছিল না। আসলে ছোটকাকা ইন্দ্রনীলের চেয়ে পঁচিশ বছরের বড় হলে কী হবে, সে ছিল ইন্দ্রনীলের একেবারে বন্ধুর মতো।

Advertisement

ছোটকাকা তখন কলেজে পদার্থবিদ্যা পড়ায় আর মহাকাশ-বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করে। সেই সময় আমেরিকা আর ভারতের বিজ্ঞানীরা ঠিক করলেন পৃথিবী থেকে কয়েক আলোকবর্ষ দূরের একটি গ্রহে মহাকাশযান পাঠাবেন, আর সেই মহাকাশযানে থাকবেন তিন জন বিজ্ঞানী— দু’জন আমেরিকান, আর ভারত থেকে যাবে সুব্রত সেনশর্মা, মানে ইন্দ্রনীলের এই ছোটকাকা। দুই দেশের যৌথ উদ্যোগে তৈরি এই মহাকাশযান চলবে প্রায় আলোর গতিতে। এই আলোর গতি এবং আলোকবর্ষের ব্যাপারটা ইন্দ্রনীলকে তখনই বুঝিয়ে দিয়েছিল ছোটকাকা। আলো সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার গতিতে ছোটে। তো, এই গতিবেগে আলো এক বছরে যতটা পথ অতিক্রম করতে পারে, তাকেই বলে এক আলোকবর্ষ। এক আলোকবর্ষ পথ মানে অকল্পনীয় দূরত্ব। সুতরাং কয়েক আলোকবর্ষ পথ পাড়ি দিয়ে, তার পর পৃথিবীতে ফিরে আসতে অনেক বছর লেগে যাবে। যদিও যে মহাকাশযানে চেপে যাবেন বিজ্ঞানীরা, সেটি ছুটবে প্রায় আলোর গতিতে, অর্থাৎ সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটারের চেয়ে খুব সামান্য কম গতিবেগে, তা সত্ত্বেও, কয়েক আলোকবর্ষ অতিক্রম করে সেই গ্রহে গিয়ে তার পর সেখানে কিছু দিন থেকে, পৃথিবীতে ফিরে আসতে-আসতে লেগে যাবে প্রায় কুড়ি বছর।

সেই থেকে অপেক্ষা করে আছে সকলে। সকলেরই চেহারার পরিবর্তন হয়েছে— ছোটরা বড় হয়েছে, যারা তরুণ ছিল, তারা এখন প্রৌঢ়, পাড়ায় যাঁদের কাকু-জেঠু বলে ডাকা হত, তাঁরা বৃদ্ধ হয়েছেন, অনেকে বেঁচেও নেই। ইন্দ্রনীলকে তো এখন ছোটকাকা চিনতেই পারবে না। ইন্দ্রনীল কি আর এখন সেই এগারো বছরের ছোট্টটি আছে? সে আজ একত্রিশ বছরের যুবক, ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেছে, এখন কলকাতার একটা নামী কলেজের অধ্যাপক। ছোটকাকারও তো নিশ্চয়ই চেহারার অনেক পরিবর্তন হয়েছে।

Advertisement

আজ সেই দিন। ছোটকাকাদের মহাকাশযান নিরাপদে নেমে এসেছে পৃথিবীর মাটিতে। বাড়ি ফিরছে ছোটকাকা। ইন্দ্রনীলের বাবা-মা, বড়মামা, ইন্দ্রনীলের ছোটবোন মিঠু, আত্মীয়রা, ছোটকাকার পুরনো বন্ধুবান্ধব— সকলেই জড়ো হয়েছে ইন্দ্রনীলের বাড়ির সামনে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তারা। ছোটকাকাকে বিমানবন্দর থেকে নিয়ে আসতে গিয়েছে ইন্দ্রনীলের বোন মিলি আর মেজকাকা।

মিনিট কুড়ি পরেই একটা বড় গাড়ি এসে থামল ইন্দ্রনীলদের বাড়ির সামনে। গাড়ির দরজা খুলে নেমে এল মিলি, মেজকাকা, আর... আর... ওই তো ছোটকাকা। সেই এগারো বছর বয়সে ছোটকাকাকে দেখেছিল ইন্দ্রনীল। তবে ছোটকাকাকে চিনতে কোনও অসুবিধে হয়নি তার। কিন্তু আর সকলে যেন একটু অবাক। বাবা এগিয়ে এসে এক বার ছোটকাকার দিকে, আর এক বার ইন্দ্রনীলের দিকে তাকালেন, তার পর একটু যেন অবাক হয়ে বললেন, ‘সুব্রত, তোকে তো ইন্দ্রর বয়সিই মনে হচ্ছে। সেই কুড়ি বছর আগে যেমন ছিলি এখনও তেমনই আছিস! আমি তো ভেবেছিলাম তোকে আমরা চিনতেই পারব না।’

মা-ও বললেন, ‘হ্যাঁ, ঠিকই তো, তোমার তো একটুও বয়স বাড়েনি সুব্রত। যখন তুমি এখান থেকে মহাকাশযানে উঠেছিলে, তখন তোমার বয়স ছিল একত্রিশ। এখন তো তোমার বয়স হওয়া উচিত একান্ন। কিন্তু তুমি তো সেই একত্রিশেই আটকে আছ দেখছি! তোমার আর ইন্দ্রের মনে হচ্ছে একই বয়স!’

বাবা বললেন, ‘ঠিকই। ইন্দ্র আর তুই পাশাপাশি দাঁড়ালে তো দুই বন্ধু মনে হবে! তুই যখন এখান থেকে রওনা দিলে তখন ইন্দ্র ছিল মাত্র ছ’বছরের।’

ছোটকাকা হাসল। মুচকি হাসল মিলি আর মেজকাকাও। ছোটকাকা বলল, ‘তোমরা ঠিকই বলেছ। গাড়িতে আসতে-আসতে বিষয়টা আমি বুঝিয়ে দিয়েছি মিলি আর মেজদাকে। তোমাদেরও বলছি এ বার, মন দিয়ে শোনো।’

‘তোমরা ভাবছ কুড়ি বছর পর আমার চেহারা এ রকম রইল কী ভাবে! চেহারায় বয়সের কোনও ছাপ নেই— সে সময় তোমরা যেমন আমায় দেখেছিলে, সে রকমই আছি! আসলে বয়স সত্যিই আমার বাড়েনি বললেই হয়। যা বেড়েছে, খুব সামান্য। এটা বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের স্পেশাল থিয়োরি অব রিলেটিভিটির বিষয়। এই থিয়োরি অনুযায়ী, আলোর গতিতে বা তার প্রায় কাছাকাছি গতিতে যদি কোনও মানুষ মহাকাশ ভ্রমণ করে, তা হলে তার বয়স পৃথিবীর মানুষের বয়সের তুলনায় অনেক কম বাড়বে। যদি পৃথিবীতে কেটে যায় পঞ্চাশ বছর, তা হলে সেই মহাকাশচারীর বয়স হয়তো বাড়বে বছরখানেক, কিংবা আরও কম। তাই আলোর গতিতে কুড়ি বছর মহাকাশ ভ্রমণ করে আমার বয়স বেড়েছে সাকুল্যে দু’চার মাস। আমি পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার সময় যাদের বয়স ছিল ছয়, তারা এখন ছাব্বিশের তরুণ। যাদের বয়স ছিল ছাব্বিশ, তাদের এখন ছেচল্লিশ। যারা ছিল ছেচল্লিশ, তারা এখন ছেষট্টি বছরের বৃদ্ধ। কিন্তু এই কুড়ি বছরে আমার বয়স বাড়েনি বললেই চলে। বলতে পারো, সময়ের ফাঁদে আটকে গিয়েছিলাম আমরা। তাই আমার বয়সি বন্ধুবান্ধব, বা আমার চেয়ে ছোট আত্মীয়স্বজনরা বয়সে এখন আমার চেয়ে অনেক বড়। ইন্দ্রকে এখন আমার সমবয়সি বলেই মনে হবে। আমার সঙ্গে আর যে দু’জন বিজ্ঞানী গিয়েছিলেন, তাঁদেরও আমার মতোই থেমে থেকেছে বয়স,’ একটানা বলে গেল ছোটকাকা।

ইন্দ্রনীল ভাবল এই কুড়ি বছরে সব কিছু কেমন পালটে গিয়েছে— রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, পরিবেশ, মানুষজন শুধু পালটায়নি ছোটকাকা! বিজ্ঞানের কী অমোঘ নিয়ম— যে ছোটকাকাকে দুর্গাপুজোর পর বিজয়ার দিন পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করত সে, সেই ছোটকাকা আর তার বয়স এখন সমান সমান।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement