ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
পলাশপুরের রিম্পারা খুব ধনী। ওদের অনেক চাষের জমি, পুকুর, বাগান, গরু, মোষ এবং একটা চার চাকার গাড়িও আছে। রিম্পা বাড়ির খুব আদুরে মেয়ে। কিন্তু রিম্পা পড়াশোনাটা ভাল ভাবেই করে, রেজাল্টও ভাল করে। ওর এখন ক্লাস টেন।
রিম্পা ওর বাবাকে আগেই বলে রেখেছে, ‘এ বছর আমাকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে করে রামনগরের বাজারে সরস্বতী ঠাকুর কিনতে যেতে হবে, সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা, আমি পছন্দ করে বড় ঠাকুর কিনব, ভ্যান-রিকশা ভাড়া করে ঠাকুর আনা হবে।’
রিম্পার আব্দারটা ওর বাবা-মা মেনে নিয়েছেন। সরস্বতী পুজোর আগের দিন দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে রিম্পার বাবা রিম্পাকে নিয়ে গাড়িতে করে রওনা দিলেন সরস্বতী ঠাকুর কিনতে। মোরামের রাস্তাটার দু’দিকেই ঘর-বাড়ি, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি কোনও কিছুই বাদ নেই। ঘিঞ্জি পাড়াটা পার হওয়ার সময় উনি সতর্ক হয়েই গাড়ি ড্রাইভ করছিলেন। হঠাৎ একটা বাঁকের মুখে গাড়িটা ঘুরতেই একটা হাঁস গাড়ির পিছনের চাকার একেবারে সামনে। ভয়ে হাঁসটা এত জোরে ‘প্যাঁক প্যাঁক’ করে উঠল, যেন হাঁসটাকে অলকেশবাবুর গাড়িটা চাপা দিয়ে ফেলল। ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে ছেলেদের চিৎকার, ‘গাড়ি থামান, গাড়ি থামান, হাঁসটার ধাক্কা লেগেছে...’ অলকেশবাবু হাঁসের চিৎকার শুনেই তখুনি গাড়িটাকে থামিয়েও দিয়েছেন।
ওদের মধ্যে একটি ছেলে অলকেশবাবুকে বলল, ‘আপনার গাড়ির পিছনের চাকাটা হাঁসটার ডানায় লাগতেই হাঁসটা ছটফট করছে, এই হাঁসটা যদি মারা যেত, আমাদের কালকের সমস্ত প্রোগ্রামই ভেস্তে যেত, কিন্তু হাঁসটাকে সুস্থ করতে এখুনি ওকে পশু-চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে, হাঁসটার চিকিৎসার জন্য টাকা-পয়সা সবই আপনি দেবেন।’
অলকেশবাবু বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমরা টাকা-পয়সা নাও, তবে আর দেরি না করে পশু-চিকিৎসকের কাছে নিয়ে চলে যাও।’ ওরা হাঁসটাকে নিয়ে দু’জন ছেলে মিলে এক জন হাঁসটাকে বুকে নিয়ে সাইকেলের পিছনে বসে, অন্য জন সাইকেল চালিয়ে গেল ডাক্তারখানা। দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলিকে অলকেশবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা তোমরা যে বলছিলে হাঁসটার জন্য তোমাদের কী যেন প্রোগ্রাম ভেস্তে যাবে, ব্যাপারটা কী?’
ওদের এক জন বলল, ‘আগামী কাল আমাদের পাড়ার মণ্ডপে সরস্বতী পুজোয় জীবন্ত সরস্বতী হবে, এবং এই হাঁসটাই বাহন হবে। এখানে পাঁচ-ছ’জন মেয়েকে সরস্বতী সেজে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে পারার অভ্যাস করানো হয়েছে আর হাঁসটাকে প্রায় এক মাস ধরে আমরা ট্রেনিং দিয়েছি জীবন্ত সরস্বতীর পাশে একদম চুপটি করে বসে থাকার জন্য। হাঁসটাকে আমরা অত্যন্ত যত্ন তো করিই এবং সব সময় চোখে চোখেই রাখি, কিন্তু আজকে আমরা সবাই মণ্ডপ তৈরিতে ব্যস্ত থাকার জন্যই হাঁসটা রাস্তার ধারে চলে গিয়েছিল, তাতেই এই বিপত্তি! হাঁসটা যদি সুস্থ না হয় আমাদের এত দিনের চিন্তাভাবনা সবই মাটি হয়ে যাবে।
অলকেশবাবু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে সব কথা শোনার পর বললেন, ‘তোমাদের এই জীবন্ত সরস্বতীর ভাবনাটা সত্যিই একেবারে নতুন এবং বেশ অভিনব। আচ্ছা, পাঁচ-ছ’জন মেয়েরা কী ভাবে সরস্বতী হবে?’ ছেলেরা বলল, আমাদের মণ্ডপটি পর্দা ঝোলানো সিস্টেমে তৈরি করা হচ্ছে। প্রথমে এক জন মেয়ে বীণা হাতে নিয়ে সরস্বতীর পোজে দাঁড়াবে এবং পাশে ওই জ্যান্ত হাঁসটিকে বসিয়ে দেওয়া হবে। সব সেটিং করে তার পর দর্শকদের জন্য পর্দা ওঠানো হবে। একটি মেয়ে এক-দেড় ঘণ্টা দাঁড়ানোর পর আবার পর্দা ফেলে দেওয়া হবে, দ্বিতীয় জন মেয়ে একই ভাবে দাঁড়াবে এবং প্রথম জন বিশ্রামে যাবে। এরই ফাঁকে হাঁসটাকে কিছু খাইয়ে দেওয়া হবে, তার পর আবার পর্দা ওঠানো হবে, এ ভাবেই সারা দিন সরস্বতী প্রদর্শনের কাজ চলবে।
অলকেশবাবু বললেন, ‘বাঃ, চমৎকার।’ এখানে সময় চলে যাচ্ছে দেখে রিম্পার অস্থিরতা বেড়ে গিয়েছে, কারণ বাজারে গিয়ে তাকে পছন্দ করে ঠাকুর কিনেত হবে যে, তাই বাবার জামাটা ধরে বলল, ‘ও বাবা এ বার চলো না, অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে!’ ‘চল, চল’ বলে অলকেশবাবু রিম্পাকে নিয়ে রামনগরের পথে চললেন।
বাজারে পৌঁছে রিম্পা তার পছন্দ মতোই সরস্বতী ঠাকুর কিনল। অলকেশবাবু ফল-মূল আর দশকর্মার জিনিসপত্রগুলো কিনলেন।
একটা ভ্যান-রিকশা ঠিক করা হল। ভ্যানে ঠাকুর তুলে ভ্যানচালক সব জিনিসপত্র ঠিকঠাক সাজিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে রিম্পাদের বাড়ির দিকে রওনা দিলেন।
রামনগরের বাজার ছাড়িয়ে রিম্পারা সেই মোরামের পথ দিয়েই ফিরছে। মনে মনে রিম্পা খুব খুশি, বাড়িতে এ বারের সরস্বতী পুজোটা ওর পছন্দ মাফিক হচ্ছে বলে। দেখতে দেখতে ওরা অনেক দূরে চলে এসেছে, হঠাৎ অলকেশবাবু গাড়িটা থামালেন, যাবার সময় ঠিক যেখানটায় হাঁস নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল। গাড়ি থেকেই দেখতে পেলেন সেই চেনা মুখ ছেলেগুলো মণ্ডপ তৈরির কাজে ব্যস্ত।
অলকেশবাবু রিম্পাকে বললেন, ‘তুই গাড়িতেই বস, আমি হাঁসটার একটু খবর নিয়ে আসি।’ অলকেশবাবু মণ্ডপের সামনে যেতেই ছেলেরা ওঁকে দেখে বলল, ‘হাঁসটা ভাল আছে, ডাক্তারবাবু ইনজেকশন দিয়েছিলেন। আশাকরি আমাদের কালকের অনুষ্ঠানে আর কোনও অসুবিধে হবে না।’ মণ্ডপের সামনে রিম্পার বয়সি পাঁচ-ছ’জন মেয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গল্প আর হাসাহাসি করছে। একটি ছেলে মেয়েগুলির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল,
‘ওরাই কালকে সরস্বতী হবে।’ অলকেশবাবু বললেন, ‘বাঃ, খুব ভাল। কিচ্ছু ভেবো না তোমাদের অনুষ্ঠান নিশ্চয় ভাল হবে, ঠাকুর সাজার অনুষ্ঠান যে! তবে হাঁসটাকে খুব নজরে রেখো। এই বলে গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে চলে গেলেন অলকেশবাবু।
একেবারে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয় হয়। রিম্পা আর ওর বাবা বাড়িতে ফিরল। রিম্পার মা গাড়ির আওয়াজ পেয়েই বাইরে বেরিয়ে এলেন। রিম্পাকে বললেন, ‘ঠাকুর কই রে?’ রিম্পা বলল, ‘ভ্যানে করে আসছে। তুমি আগে বাড়ির ভেতরে চলো, যাওয়ার সময় রাস্তায় আমাদের কী ঝামেলাই না হয়েছিল।’ রিম্পার মা রিম্পাকে নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বলছেন, ‘কী হয়েছিল, কী...?’ রিম্পা বলল বলছি, বাবা বাড়িতে আসুক না বলছি। বলতে বলতেই অলকেশবাবুও বাড়ি ঢুকলেন।
রিম্পার মুখে হাঁস-বিভ্রাটের সব কথা শোনার পর ওর মা রিম্পার বাবাকে বললেন, হাঁসটা চাপা পড়লে কী হত বলো তো? ওদের তো সত্যিই সর্বনাশ হয়ে যেত, তার ওপর তোমাদের কপালেও যে কী জুটত, ভগবান জানেন! যাক গে, ঠাকুরই বাঁচিয়ে দিয়েছেন আর কী! সন্ধে পেরিয়ে গিয়েছে, রিম্পারা বাড়ি এসেছে এক ঘণ্টার ওপর প্রায়। ইতিমধ্যেই বাইরে ভ্যানের পিঁক পিঁক আওয়াজ, রিম্পা চিৎকার করে বলে, ‘ওমা, ওমা, ঠাকুর এসে গিয়েছে। বাইরে গেটের লাইটটা জ্বালিয়ে দাও।’ অলকেশবাবু দরজা খুললেন, রিম্পার মা, দাদু, ঠাম্মা সবাই মিলে বাইরে এলেন, ভ্যানে বসানো বেশ বড়সড় সরস্বতী, মুখটা খবরের কাগজে ঢাকা। ভ্যানচালক ফলটলের ব্যাগগুলো নামিয়ে দিয়ে অলকেশবাবুকে বলল, ‘বাবু একটু ধরুন গো, ঠাকুরটা নামিয়ে দিই। দু’জনে মিলে ঠাকুরটা একেবারে ঠাকুর ঘরের ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। তার পর চা-টা খেয়ে ভাড়া নিয়ে চলে গেলেন ভ্যানচালক।
পরের দিন সকাল থেকেই রিম্পা ব্যস্ত হয়ে পড়ল পুজোর জোগাড় করতে। ওর মা-ও পুজোর জোগাড়ে বসে পড়ল। কারণ, শ্রীপঞ্চমী তিথি মেনে পুরোহিতমশায় ঠিক আটটায় আসবেন, তার আগেই সব কিছু রেডি করতে হবে।
বেলা দশটা নাগাদ পুজো, পুষ্পাঞ্জলি সারা হয়ে গেল। দুপুরে রিম্পারা যখন একসঙ্গে খিঁচুড়ি খাচ্ছে রিম্পার বাবা রিম্পার দিকে তাকিয়ে বললেন, যাবি নাকি ওই জীবন্ত সরস্বতী আর হাঁসটাকে দেখতে? রিম্পা তো সঙ্গে সঙ্গেই ‘হ্যাঁ যাব, হ্যাঁ যাব’ বলে উঠল। রিম্পার মা বললেন, আমিও যাব তোমাদের সঙ্গে। অলকেশবাবু বললেন, ঠিক আছে, রেডি হয়ে নাও।
ওরা সবাই মিলে সে দিন বিকেলে জীবন্ত সরস্বতী হওয়া সেই পাড়াটায় এসে পৌঁছল। গাড়ি থামিয়ে অলকেশবাবু নামতেই ছেলেগুলো চিনতে পেরে বলল, ‘আসুন আসুন।’ পিছনে পিছনে রিম্পা ও রিম্পার মাও। সাগ্রহে অলকেশবাবু মণ্ডপের সামনে গিয়ে দেখলেন সত্যিই তো জীবন্ত সরস্বতীকে একেবারে সত্যি ঠাকুরের মতোই লাগছে। আর পাশে জ্যান্ত হাঁসটা যেন মাটির তৈরি হাঁসের মতোই চুপচাপ। এমন সত্যি সরস্বতীকে অলকেশবাবু তাঁর ক্যামেরায় ধরে রাখলেন। জীবন্ত সরস্বতীর কথাটা প্রচার হওয়াতে বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষজন এসে ভিড় জমাচ্ছেন। ওখান থেকে ফিরে আসার আগে অলকেশবাবু মণ্ডপের আরও কাছে গিয়ে হাঁসটার সামনে ক্যামেরাটা ধরলেন, হাঁসটা এক বার পিটির-পিটির করে চাইল, হাঁসটা যেন অলকেশবাবুর দিকেই তাকিয়ে বলছে, ‘তোমাদের মতন মানুষদের ভালবাসা পেয়েই ভাল থাকব আমরা।’