বৌবাজারের বেহালার সুর ছড়িয়ে পড়ে নক্ষত্রলোকে

সে যুগের অনেক সম্ভ্রান্ত বাবুরাও নিজেদের বাগানবাড়িতে বড়দিন উপলক্ষে খানাপিনা, নাচ গানের আসর বসাতেন স্রেফ সাহেবদের তুষ্ট করতে। সেখানে বাদ যেত না বাঈ নাচও। বড়দিনে বো ব্যারাকের পাশাপাশি পুরনো কলকাতার ইতিহাসে কান পাতলেন বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্যসে যুগের অনেক সম্ভ্রান্ত বাবুরাও নিজেদের বাগানবাড়িতে বড়দিন উপলক্ষে খানাপিনা, নাচ গানের আসর বসাতেন স্রেফ সাহেবদের তুষ্ট করতে। সেখানে বাদ যেত না বাঈ নাচও। বড়দিনে বো ব্যারাকের পাশাপাশি পুরনো কলকাতার ইতিহাসে কান পাতলেন বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share:

‘খ্রীষ্টের জনম দিন, বড়দিন নাম। বহুসুখে পরিপূর্ণ, কলিকাতা ধাম। কেরানী দেওয়ান আদি বড় বড় মেট। সাহেবের ঘরে ঘরে পাঠাতেছে ভেট। ভেটকী কমলা আদি, মিছরি বাদাম। ভালো দেখে কিনে লয়, দিয়ে ভাল দাম।’ সে কালের বড়দিনের প্রসঙ্গে এমনটাই লিখেছিলেন কবি ঈশ্বর গুপ্ত।

Advertisement

কলকাতায় বড়দিন উৎসব কবে থেকে শুরু হয়েছিল, সে কথা সঠিক ভাবে জানা যায় না। তবে, শোনা যায় ইংরেজরা এ দেশে আসার অনেক আগেই খ্রিস্টধর্মাবলম্বী আর্মেনিয়ান ও পর্তুগিজরা বাংলায় এসেছিল। পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে ফিরিঙ্গি বণিকদের আনাগোনা শুরু হয় কলকাতায়।

ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ তৈরির পরে তার ভেতর প্রার্থনার জন্য ইংরেজরা সেন্ট অ্যান’স চার্চ তৈরি করেছিল ১৭০৯-এ। পরে ১৭৫৬-এ সিরাজ-উদ-দৌলার কলকাতা আক্রমণে সেটি ধবংস হয়ে যায়। শোনা যায়, তার পরে ইংরেজরা মুরগিহাটার পর্তুগিজ চার্চে উপাসনার জন্য যেত। কিন্তু, পর্তুগিজদের ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে, ১৭৬০-এ কেল্লার ফটকের কাছেই একটি ঘর তৈরি করে সেটিকে উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহার করত তারা। পরে ইংরেজ তথা খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় গড়ে তোলা হয়েছিল শহরের বিভিন্ন গির্জা। যেমন, সেন্ট জন’স চার্চ, সেন্ট এনড্রুজ স্কটিশ চার্চ, সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল, সেন্ট জেমস চার্চ প্রভৃতি। বড়দিনকে কেন্দ্র করে বিশেষ উপাসনা হত এই সব গির্জায়।

Advertisement

বড়দিনের আগে থেকে, এ দেশে বসবাসকারী সাহেব-মেমদের মনে পড়ত তাঁদের ‘নেটিভ ল্যান্ডের কথা’। ১৭৮১ সালে এলিজাবেথ ফে-র লেখা একটি চিঠি থেকে জানা যায়, বড়দিনের আগে সাহেবরা প্রতি বছরই ঘরবাড়ি মেরামতি ও চুনকাম করাতেন। বড়দিন উপলক্ষে সাজানো হত তাঁদের ঘরবাড়ি। বাড়ির প্রধান ফটক এবং দরজার দু’পাশে কলাগাছ দিয়ে সাজানো হত। থামগুলো সাজানো হত দেবদারু ও অন্যান্য গাছের লতাপাতা, ফুলের তোড়া ও মালায়।

কলকাতার প্রথম আর্চ বিশপ রেজিনাল্ড হেবার ১৮২৩-এ তাঁর বিখ্যাত জার্নালে উল্লেখ করেছেন, সেই সময় ডালহৌসি এবং চৌরঙ্গি অঞ্চলের প্রত্যেক সাহেব বাড়িই দেবদারু গাছের ডাল, ফুল লতাপাতা, রুপোলি ও নানা রঙের কাগজের চেন দিয়ে সাজানো হত।

সে যুগে আর একটা জিনিস দেখা যেত বড়দিনে। ইংরেজরা তাকে বলত ‘ডলি’। হিন্দি ডালি শব্দ থেকে এসেছিল সেটি। সেটা হল, মূলত বড়দিনের উপহার বা ভেট। প্যানি পার্কস-এর লেখায় এর উল্লেখ মেলে। সাহেববাড়ির বেয়ারা, খানসামা ও অন্য কাজের লোকেরা বড়দিনে তাঁদের ইংরেজ মনিবদের ‘ডলি’ বা ভেট পাঠাতেন। তাতে থাকত ফলমূল, কেক থেকে শুরু করে মাছ-মাংস ইত্যাদি। এ ছাড়াও, বড়দিনে ডলি পাঠাতেন কাজ বা ব্যবসা সূত্রে ইংরেজদের সঙ্গে যুক্ত কিছু মানুষ। আসলে এগুলি দিয়ে সেকেলে ‘কেরানি, বেনিয়ান, মূৎসুদ্দি ও দালাল’রা সাহেব প্রভুদের প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রকাশ করতেন।


বড়দিনের বো ব্যারাক।

সে কালে বড়দিনের ভোজও ছিল অন্য রকম। রাধাপ্রসাদ গুপ্তের একটি লেখা থেকে জানা যায়, ‘খ্রিস্টমাস ডিনার বা সারা বছরের সবচেয়ে বড় ভোজের একটা বিশেষ চরিত্র ছিল। কলকাতাতেও এই ভোজে খাবারের মধ্যে একটা প্রধান জিনিস ছিল “বোরস্ হেড” বা শুয়োরের মাথা যা রোজমেরি, বে-লিফ (তেজপাতা), আপেল আর অন্যান্য উপকরণ দিয়ে সাজিয়েগুজিয়ে পরিবেশন করা হত।...অপরিহার্য টার্কি ছাড়া ডাক রোস্ট, যত রাজ্যের জিনিস দিয়ে তৈরি বিরাট খ্রিসমাস পাই, প্লাম পুডিং, ট্যাঞ্জারিন লেবু, খেজুর, বাদাম, কিসমিস, চকোলেট ইত্যাদি।’

পুরনো কলকাতার বড়দিনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভোজ হত বড়লাটের প্রাসাদে। কলকাতার পাশাপাশি সুবে বাংলার বহু জায়গার রাজকর্মচারী ও সেনা কর্তারা এতে নিমন্ত্রিত থাকতেন। ১৭৭৪-এ আলেকজান্ডার ম্যাক্রাবি অন্য একটি প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘The Governer (Warren Hastings) gave a public breakfast, dinner, ball and supper at all which we assiated.’। তবে শোনা যায় বড়লাটদের মধ্যে লর্ড কর্নওয়ালিস বড়দিনের এই ফুর্তির ঘোর বিরোধী ছিলেন। কেননা, তিনি মনে করতেন পবিত্র দিনটিতে উপাসনা এবং পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো উচিত। সে জন্য ১৭৮৫-তে তাঁর শাসনকাল পর্যন্ত তিনি লাটভবনে বড়দিন উৎসব বন্ধ করে দেন। এতে সাহেব-মেমরা যে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তা অনুমান করা যায়। তবে কর্নওয়ালিস বিলেত চলে গেলে আবার সেই উৎসব শুরু হয়। এতে সে কালের সাহেব-মেমরা যেন হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন।

ইতিহাসে কান পাতলে শোনা যায় সে যুগের অনেক সম্ভ্রান্ত বাবুরাও নিজেদের বাগানবাড়িতে বড়দিন উপলক্ষে খানাপিনা, নাচ গানের আসর বসাতেন স্রেফ সাহেবদের তুষ্ট করতে। সেখানে বাদ যেত না বাঈ নাচও।

সে কালের বড়দিন আর নিউ ইয়ারে আমোদ-প্রমোদের কোনও খামতি ছিল না এই শহরে। অপেরা, থিয়েটার, বোটরেস, পিকনিক, ক্রিকেট সব কিছুরই ব্যবস্থা ছিল। আর ছিল রেস। সেই সময় রেস হত এলেনবরা কোর্স, খিদিরপুরের আখড়ার মাঠে, তার পরে আজকের রেসকোর্সে।

তবে এ দেশ থেকে সাহেবরা বিদায় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে বড়দিনের সেই সাহেবি ঐতিহ্যের ছবিটা। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে কলকাতার নাম করা হোটেলগুলিতে দেখা যেত বড়দিনের বিশেষ চমক। পার্ক স্ট্রিটের পুরনো বাসিন্দা জিমি ওয়েল্স স্মৃতি হাতড়ে বলছিলেন, “তখন বড়দিনে একটা সাহেবি বনেদিয়ানা দেখা যেত। সেই সময় গ্র্যান্ড, গ্রেট ইস্টার্ন কিংবা স্পেনসার্স হোটেলে বড়দিন এবং নিউইয়ার্স উপলক্ষে বিদেশ থেকে আসা সুন্দরী নর্তকীদের ক্যাবারে ড্যান্স ছিল মুখ্য আকর্ষণ। আর ছিল বলড্যান্স।” সেই সময় সাহেব-মেমদের পাশাপাশি অভিজাত উচ্চমধ্যবিত্ত বাঙলির ভিড়ও দেখা যেত এই সব হোটেলে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতার সাহেবি বড়দিন তার কৌলিন্য হারিয়েছে।


কলকাতার নাম করা হোটেলগুলিতে দেখা যেত বড়দিনের বিশেষ চমক।

জাতিধর্ম নির্বিশেষে বড়দিন আজও সকলের উৎসব। আর আটপৌরে মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে বড়দিন মানে তো সপরিবার ময়দানে কিংবা চিড়িয়াখানা বেড়াতে যাওয়া, নিউমার্কেট থেকে কেক কেনা। তা না হলে পুজোয় ঠাকুর দেখার মতোই এক বার পার্ক স্ট্রিটে বড়দিনের আলো দেখে আসা।

তবে কিছুটা হলেও বড়দিনের সেই আমেজটা পাওয়া যায় বো ব্যারাকে। যা কিনা এ শহরে টিকে থাকা অ্যাংলো সমাজে তীর্থক্ষেত্রের সমান। হারিয়ে যাওয়া সেই সাহেবি সংস্কৃতির কিছুটা ছোঁয়া আজও মেলে এখানকার মানুষদের বড়দিন উদযাপনের মধ্যে।

বৌবাজারের রনি জোন্সের কথায়, “সে কালের বড়দিনের একটা অন্য মেজাজ ছিল। সেটা আজ উধাও। কোথায় মিলবে মা-ঠাকুমার হাতে তৈরি চকোলেট, ভ্যানিলা কিংবা অনবদ্য সেই ফ্রুটকেক, বাড়িতে তৈরি কুকিজ? সে সময় বড়দিনের দুপুরের পাতে পড়ত পিজ পোলাও, মাটন ভিন্দালু এবং বিশেষ কাটলেট। সে সব আজ স্মৃতি! একে একে চলে গিয়েছেন সকলেই।” বড়দিনের স্মৃতি হাতড়ে সাতাশি বছরের রনি জোন্সের তখন চোখ ভরা জল। কেননা, সারা বছরের মতো বড়দিনেও তাঁর একমাত্র সঙ্গী সখের বেহালাটি। বড়দিনের নিশুতি রাতের কনকনে উত্তুরে হাওয়া যখন গ্রাস করে শহরের গলি থেকে রাজপথ, তখন বৌবাজারের এঁদো গলির জানলা দিয়ে সেই সুর ছড়িয়ে পড়ে নক্ষত্রলোকে।

সেই সুরের শ্রোতা তখন শুধুই বড়দিনের তারারা।

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন