গবেষণাগারে রানা অধিকারী। ছবি: ক্যালটেক
সালটা ১৯১৬। ‘জেনারেল থিয়োরি অব রিলেটিভিটি’-তে আলবার্ট আইনস্টাইন প্রথম অনুমান করেছিলেন, মহাশূন্যে ভেসে বেড়ায় ‘মাধ্যাকর্ষণ-স্রোত’ বা ‘গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভস’। যদিও তার অস্তিত্বের জোরদার প্রমাণ মিলেছিল ’৭৪ সালে। তার প্রায় বিশ বছর আগেই মারা যান আইনস্টাইন।
মহাকাশ বিজ্ঞানের সেই দিগন্ত ছুঁয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন এক বাঙালি। ‘ক্যালিফর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’ (ক্যালটেক)-এর পদার্থবিজ্ঞানী রানা অধিকারী। সেখানে তাঁর নিজস্ব গবেষকদলের নাম ‘অধিকারী রিসার্চ গ্রুপ’। আমেরিকার পাশাপাশি ভারতেও গবেষণার কাজে যুক্ত। ‘লেজ়ার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল-ওয়েভ অবজ়ারভেটরি’ (এলআইজিও বা লাইগো) নিয়ে গবেষণার জন্য এ বছরের ‘নিউ হরাইজনস ইন ফিজিক্স’ খেতাব তাঁর ঝুলিতে।
আদতে রায়গঞ্জের ছেলে রানা। তবে জন্ম প্রবাসে। মা-বাবা আমেরিকা চলে যাওয়ার পরে সেখানেই জন্ম। পড়াশোনা, বড় হওয়া সবই ভিন্দেশে। আত্মীয়-স্বজনেরা অবশ্য উত্তরবঙ্গ ও কলকাতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন। তাই মাঝেমধ্যেই এ দেশে আসা হয়ে যায়। তা ছাড়া, ইন্ডিয়া-লাইগো প্রকল্পেরও অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রানা। বললেন, ‘‘কলকাতায় গেলে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই।’’
রানা জানান, আগে জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার থেকেও মৌলিক পদার্থবিদ্যা বেশি ভাল লাগত। কিন্তু মহাবিশ্বের রহস্য জানতে হলে, জ্যোতিপদার্থবিদ্যা সব চেয়ে শক্তিশালী ক্ষেত্র। বিজ্ঞানের প্রতি ভালবাসাটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল ছোট থেকেই। রানা বলেন, ‘‘যখন তিন বছর বয়স, মায়ের হাত ধরে অঙ্কের প্রতি টান তৈরি হয়। আর একটু বড় হতে বাবার সঙ্গে গাড়ি, কম্পিউটার, বাড়ির এটাওটা সারাতে শুরু করি। ১০ বছর বয়সে নাসার ব্যবহার করা পুরনো একটা কম্পিউটার পাই। ভিডিয়ো গেম প্রোগ্রামিং করা শুরু করি তাতে। ওই ভাবেই ধীরে ধীরে পদার্থবিদ্যার প্রতি ভালবাসা এসে যায়।’’ তার পর ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, ‘ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’ (এমআইটি)-তে পিএইচডি। ভারতের সঙ্গে যোগসূত্র বছর দশেক। পুণের আইইউসিসিএ-তে তৈরি হয় ‘ইন্ডিয়ান কনসর্শিয়াম ফর গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভস’। বললেন, ‘‘আমিও প্রতিষ্ঠাতাদের এক জন। যুক্ত রয়েছি। ভারতে বহু প্রতিভা রয়েছে। আমি নিশ্চিত, ‘লাইগো-ইন্ডিয়া’ পৃথিবীর সেরা হবে।’’
কী এই ‘লাইগো’? রানা জানান, দূরত্ব মাপতে সাহায্য করে এই যন্ত্রটি। স্মার্টফোনে যেমন ‘মোশন সেন্সর’ থাকে, এতেও রয়েছে। তবে তার থেকে অন্তত ১ লক্ষ কোটি গুণ বেশি শক্তিশালী। রানাদের গবেষকদলটিই ২০১৫ সালে ‘গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভস’ বা ‘মাধ্যাকর্ষণ স্রোত’ লক্ষ্য করেন ‘অবজারভেটরি’তে। বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যায়, পুকুরের জলে ঢিল ছুড়লে যেমন ছোট-ছোট স্রোত খেলে যায় জলের উপরে, ঠিক তেমনই দু’টি ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষে মাধ্যাকর্ষণ স্রোত তৈরি হয়। ‘লাইগো’ লক্ষ করেছে, অন্যান্য মহাজাগতিক ঘটনাতেও এ ধরনের স্রোত তৈরি হয়। যেমন, দু’টি নিউট্রন নক্ষত্রের সংঘর্ষেও মাধ্যাকর্ষণ স্রোত সৃষ্টি হতে পারে। নিউট্রন নক্ষত্র হল খুব ছোট ব্যাসার্ধের মহাজাগতিক বস্তু। এদের ঘনত্ব খুব বেশি।
কিন্তু ঠিক কী খুঁজছেন ওঁরা? রানার কথায়, ‘‘যা হয়তো কল্পনাও করতে পারি না, মহাবিশ্বে নজরদারি চালিয়ে তেমনই হয়তো কিছু খুঁজে পেয়ে যাব আমরা।’’ ব্যাপারটা এ রকম— আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে, কেউ কি কল্পনাও করতে পারতেন, একটা ছোট্ট মুঠোফোনে হাজার মাইল দূরের কারও সঙ্গে কথা হয়ে যাবে! রানার কথায়, ‘‘বলা যায় না, এ ভাবেই হয়তো খুঁজে পেয়ে যাব মহাবিশ্বের উৎস।’’